১৯৫০ সালের পর বিশ্বে উৎপাদিত প্রায় ৮.৩ বিলিয়ন টন প্লাস্টিকের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ শেষ পর্যন্ত নয়তো মাটি, নদী বা সমুদ্রে মিশে দূষণের কারণ হয়েছে। কেবল দূষণই নয়, জ্বালানি খাতেও চাপের সৃষ্টি করেছে প্লাস্টিক। অধিকাংশ প্লাস্টিক তৈরি হয় জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। বর্তমান গতিতে উৎপাদন চলতে থাকলে চলতি শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ ২০ শতাংশ জ্বালানি তেল স্রেফ প্লাস্টিক উৎপাদনেই ব্যয় হবে।
পাশাপাশি সমস্যা হলো জীবাশ্ম জ্বালানি-নির্ভর এই প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলা সহজ নয়। প্লাস্টিক সত্যিই জাদুকরী এক জিনিস। উৎপাদনে সস্তা, হালকা ওজন ও টেকসই হওয়ায় প্লাস্টিকের চাহিদাও অনেক। আবার প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে টেকসই ও সহজে ক্ষয়প্রাপ্ত কোনো উপাদান খুঁজে পাওয়াও কঠিন। তবে, অসংখ্য বিজ্ঞানী ও প্রতিষ্ঠান এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দেখে নেওয়া যাক প্লাস্টিকের কিছু বিকল্প উপাদান।
বায়োপ্লাস্টিক
প্লাস্টিকের জনপ্রিয় বিকল্প হতে পারে বায়োপ্লাস্টিক। আখ, শৈবাল এমনকি কলার খোসা এবং চিংড়ি বা শামুকের মতো শক্ত খোসার শেলফিস থেকে নির্মিত হয় এই প্লাস্টিক।
জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর পাশাপাশি সহজেই মাটিতে মিশে যায় বলে বায়োপ্লাস্টিকের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। তবে বায়োপ্লাস্টিকের কাঁচামালের আরও ভালো বিকল্প পাওয়া না গেলে শেষ পর্যন্ত তা বন উজাড়ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এমনকি মানুষের খাদ্য সংস্থানেও বসাতে পারে ভাগ। এছাড়া প্লাস্টিক যত সহজে প্রকৃতিতে মিশে যায় বলে প্রচারিত হয়, তা অনেকটাই বাড়িয়ে বলা। বায়োপ্লাস্টিক ক্ষয় হতেও কয়েক বছর সময় লাগে। অনেকক্ষেত্রে যান্ত্রিক কমপোস্টিংয়েরও প্রয়োজন হতে পারে, যা সহজলভ্য নয়।
উদ্ভিজ্জ প্লাস্টিক
কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের দাবি, তারা এই সমস্যাগুলোর সমাধান পেয়ে গেছে। ডাচ বায়োকেমিক্যাল প্রতিষ্ঠান অ্যাভানটিয়াম ১০০ শতাংশ উদ্ভিজ্জ প্লাস্টিক উদ্ভাবন করেছে। চিনি থেকে তৈরি এই প্লাস্টিক বোতল ও ফিল্ম তৈরিতে ব্যবহার করা সম্ভব। প্রতিষ্ঠানটির দাবি অনুসারে এই প্লাস্টিক ১০০ শতাংশ পুনঃব্যবহারযোগ্য।
জীবাশ্ম জ্বালানি-নির্ভর প্লাস্টিকের চেয়ে এর কার্বন ফুটপ্রিন্টও উল্লেখযোগ্যহারে কম। আর প্লাস্টিকের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত গাছপালাও টেকসই চাষাবাদের মাধ্যমে উৎপাদিত হবে।
ব্যাকটেরিয়া থেকে উৎপাদিত প্লাস্টিক
উদ্ভিদ-নির্ভর প্লাস্টিকের বাইরে গিয়েও অনেক প্রতিষ্ঠান প্লাস্টিক উৎপাদনের চেষ্টা করছে। যুক্তরাজ্যের ‘শেলওয়ার্কস’ সমুদ্র ও মাটিতে পাওয়া জীবাণু থেকে প্লাস্টিক উৎপাদন শুরু করেছে। কার্বন উৎসের ওপর নির্ভরশীল এই জীবাণু নিজেদের মধ্যে চর্বির মতো শক্তি সঞ্চয় করে। এই চর্বি বের করা হলে ঠিক প্লাস্টিকের রূপ ধারণ করে করে বলে জানান শেলওয়ার্কসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা আমির আফসার।
জানা যায়, যখন এই প্লাস্টিক প্রকৃতিতে ফিরে যায় তখন ঠিক একই ব্যাকটেরিয়া একে খাবার হিসেবে বেছে নিয়ে খেতে শুরু করে। এটা ব্যাকটেরিয়া থেকে আসে, ব্যাকটেরিয়ার কাছেই ফিরে যায়। বিভিন্ন প্রসাধন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে টিউব, বোতল ও কমপ্যাক্ট উৎপাদনের চুক্তি করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
গ্রিনহাউজ গ্যাস থেকে উৎপাদিত প্লাস্টিক
বিজ্ঞানীদের অনেকে জলবায়ু সংকট নিরসনে গ্রিনহাউজ গ্যাস থেকে প্লাস্টিক উৎপাদনের চেষ্টাও করছেন। ভবিষ্যতে বায়ু থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিয়ে তা থেকে প্লাস্টিক উৎপাদনই তাদের উদ্দেশ্য।
রাটগারজ ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা এমন এক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন, যার মাধ্যমে পানি ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড থেকে বিভিন্ন প্লাস্টিকের উৎপাদন সম্ভব। এটি পিইটি এবং পলিয়েস্টার সুতাকেও প্রতিস্থাপন করতে পারবে। ফ্যাশন শিল্পে অন্তত ৬০ শতাংশ পোশাকের কাঁচামাল হলো প্লাস্টিক। ফলে, প্লাস্টিকের দূষণ বহুলভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
কাগজের তৈরি বোতল
বিশ্বব্যাপীই বাড়ছে প্লাস্টিক সচেতনতা। গ্রাহকদের চাপের মুখে আন্তর্জাতিক বহু প্রতিষ্ঠানই এখন প্লাস্টিকের বিকল্প উপাদান খুঁজছে। মারস এবং ইউনিলিভার প্লাস্টিকের বদলে কাগজ দিয়ে পরীক্ষামূলক উৎপাদন চালাচ্ছে।
চলতি বছর কোকাকোলাও হাঙেরিতে কাগজের বোতল নিয়ে পরীক্ষা চালানো শুরু করে। কাগজের পাল্প থেকে তৈরি বোতলগুলোর ক্যাপ অবশ্য প্লাস্টিকেরই রাখা হয়েছে।
তবে কাগজের তৈরি প্লাস্টিকের বিকল্প সহজে পরিবেশে মিশলেও তা বনায়নকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এছাড়া, এই উপাদানগুলো বছরে ৩০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিকের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে কি না, সেই প্রশ্নও থাকছে।
আপনার মতামত জানানঃ