সে যে নরঘাতী উন্মাদ হতে পারে এটা কেউ ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেনি। নারীদের কাছে হ্যান্ডসাম লুক, চমৎকার চোখের অধিকারী টেড বান্ডি ছিল প্রেম করার জন্য আদর্শ পুরুষ। তরুণদের চোখে সে ছিল আদর্শ বন্ধু, মায়েদের চোখে আদর্শ সন্তান। অথচ এরকম একজন সুদর্শন, হ্যান্ডসাম পুরুষ আড়ালে একজন নৃশংস খুনী, সিরিয়াল কিলারের ভূমিকা পালন করতো! থিওডোর রবার্ট বান্ডি’র ক্রাইম ফাইলটা এজন্যই এত ইন্টারেস্টিং হয়ে উঠেছিল।
থিওডোর রবার্ট বান্ডি’র ডাক নাম ছিল টেড। তার অতীত ইতিহাসে অবশ্য কিছু সূত্র ছিল, যেগুলো তার পরবর্তী জীবনে দানব হয়ে ওঠার দিকে ইঙ্গিত করে। ১৯৪৬ সালের ২৪ নভেম্বর, ফিলাডেলফিয়া’র বাসিন্দা ১৯ বছর বয়সী লুইস কাউয়েল-এর কোল আলো করে টেডের জন্ম হয়েছিল। তবে তার বাবার পরিচয় কখনো জানা যায়নি। ধারণা করা হয়, সে সশস্ত্র বাহিনীর কোনো সদস্য ছিল। লুইস-এর বাবা, মা স্যাম এবং এলেনোর ছিলেন কঠোরভাবে রক্ষণশীল। অবিবাহিত মেয়ের সন্তান প্রসব সংক্রান্ত কেলেঙ্কারি এড়ানোর জন্য তারা লুইসকে বারলিংটন, ভারমন-এর এক সেবাকেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেবাকেন্দ্রটি মূলত অবিবাহিত মায়েদের সেবা দিতো।
সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তারা মেয়ে এবং নাতিকে নিয়ে ফিলাডেলফিয়াতে ফিরে আসেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, নাতিকে তারা নিজেদের দত্তক নেওয়া সন্তান হিসেবে পরিচয় দিয়ে ছিলেন। টেড তার নানাকে অনেক ভালবাসতো। নানার আদর-স্নেহে বড় হচ্ছিল সে। নানা তাকে নিয়ে সমুদ্র উপকূলে ভ্রমণে বেরুতো, নদীতে মাছ ধরতো কিংবা গ্রাম্য অঞ্চলে গিয়ে ক্যাম্পিং করতো। তবে নানুর সাথে টেডের সম্পর্ক অতটা ভাল ছিল না। টেডের নানুর অ্যাগ্রোফোবিয়া (কোথাও আটকা পড়ার ভয়, সেখান থেকে সহজে বের না হতে পারার আশংকা ইত্যাদি) ছিল, তাই বাড়িতে তিনি প্রায় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন।
নানা, নানুর অধীনে থাকাবস্থায় ছোট্ট টেড একবার অস্বস্তিকর কাজ করে বসেছিল। হয়তো সেই ঘটনার মাধ্যমে সামনে বেরিয়ে এসেছিল টেডের আসল চেহারা। তার ১৫ বছর বছর বয়সী খালামণি জানায়, একবার গভীর রাতে ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখে টেড তার গায়ের চাদর সরিয়ে শরীরের চারপাশে মাংস কাটার ছুরি রাখছে। “টেড স্রেফ দাঁড়িয়ে হাসছিল। আমি তাকে রুম থেকে তাড়িয়ে দিয়ে, ছুরিগুলো রান্নাঘরে রেখে দিয়েছিলাম। ছোট্ট একটা ছেলের পক্ষে এধরনের কাজ করাকে খুব অদ্ভুত বলে মনে হয়েছিল।”
১৯৫০ সালে ভাল চাকরির আশায় টেডের মা তাকে নিয়ে ৩০০০ মাইল দূরে ওয়াশিংটন স্টেটে পাড়ি জমায় এবং জনি বান্ডি নামের এক ব্যক্তিকে বিয়ে করে। জন বান্ডি একজন রাঁধুনী হিসেবে ম্যাডিগান আর্মি হাসপাতালে কাজ করতো। জন বান্ডি টেডের দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং তাকে নিয়ে টাকোমা’য় অবস্থিত বাড়িতে সংসার শুরু করে টেডের মা লুইসের সাথে। সেই সংসারে পরবর্তীতে তাদের আরো চারজন সন্তান জন্মগ্রহণ করে। সৎ বাবার নামের পদবী (বান্ডি) নিজের নামের সাথে জুড়ে দেয় টেড।
ধীরে ধীরে টেড এজন আদর্শ আমেরিকান বালক হয়ে ওঠে। স্থানীয় চার্চে সে সক্রিয় ছিল। মেথোডিস্ট ইয়ুথ ফেলোশিপ-এ সে ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিল। তারপর যোগ দিয়েছিল বয় স্কাউট অব আমেরিকা’য়। মানুষের বাড়ি বাড়ি পত্রিকা সংবরাহ করার কাজ করেছিল। সপ্তাহান্তে ছুটির দিনগুলোতে লনের ঘাস কাটার নিজস্ব ব্যবসায়ও দাঁড় করিয়েছিল সে। হাই স্কুলে সে ভাল অ্যাথলেট ছিল। ট্র্যাক টিমে একটা পুরষ্কারও জিতেছিল। পরবর্তীতে সিয়াটলে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব পুগেট সাউন্ড-এ ভর্তি হয়েছিল সে। পরে সেখান থেকে সরে গিয়ে ভর্তি হয়েছিল ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন-এ।
১৯৬৭ সালে সে ড্রপআউট হয়। নিজের ইউনিভার্সিটির পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে সে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে চীনা ভাষায় একটি নন-ডিগ্রি কোর্স নেয়। অল্প কিছুদিন যেতে না যেতেই সে সেখান থেকেও ড্রপআউট হয় এবং সিয়াটলে ফিরে যায়। সেখানে গিয়ে শীতকাল জুড়ে সে বিভিন্ন ধরনের নিম্নমানের কাজ করে। তারপর রাজনীতিতে ঢোকে টেড। রিপাবলিকান পার্টি’র হয়ে প্রচার কর্মী হিসেবে কাজ করে।
টেডের এরকম উড়ু-উড়ু মন, অমনোযোগী স্বভাব এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের অভাব ইত্যাদি থেকে তার চরিত্রের ব্যাপারে কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। টেডের স্টুডেন্ট রিপোর্টেও একই দৃশ্য ফুটে উঠেছিল, অস্থির প্রকৃতির মেজাজ ছিল তার। অবশ্য স্মার্ট চেহারা ও ফিল্ম-স্টারদের মতো লুকের বদৌলতে তার কখনো প্রেমিকার অভাব হয়নি। তবে তার কোনো কোনো প্রেমিকা বলেছিল সে প্রেমিক হিসেবে ছিল ধর্ষকামী। সে তাদেরকে অদ্ভুতভাবে এটা-সেটা দিয়ে বেঁধে তারপর শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হতো। এগুলো ছিল তার ফ্যান্টাসি।
নিজে এধরনের মানসিকতার হওয়া সত্ত্বেও টেড ১৯৭১ সালে সিয়াটলের রেপ ক্রাইসিস সেন্টারে সেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করার জন্য আবেদন করে। মানসিক পরিপক্বতা এবং ভারসাম্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় তাকে সেখানে কাউন্সিলর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
বেস্টসেলার ক্রাইম রাইটার অ্যান রুল ব্যক্তিগতভাবে টেড বান্ডিকে চিনতেন। ১৯৭০-এর দশকে তিনি টেড বান্ডি’র সাথে ক্রাইসিস হটলাইনে কাজ করেছিলেন। অ্যান রুল তার বইগুলোতে আমেরিকার সবচেয়ে জঘন্য ক্রিমিনালদের ইতিহাস তুলে ধরতেন। টেড বান্ডি’র ব্যাপারে তিনি লিখেছিলেন, “যখন মানুষ আমাকে টেডের ব্যাপারে প্রশ্ন করে তখন আমার মনে হয় আমি যদি তাদেরকে টেডের চমৎকার দিকটা দেখাতে পারতাম! একজন ২২ বছর বয়সী তরুণের কাছ থেকে যা যা ভাল আচরণ পাওয়া সম্ভব তার সবই টেডের মাঝে ছিল। সে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল, ফোনে সুন্দর করে কথা বলতো, দেখতে হ্যান্ডসাম ছিল, সুদর্শন ছিল, মজা করতে পারতো। আমি টেড বান্ডি’র বন্ধু ছিলাম, কখনো ভাবিনি সে একজন সিরিয়াল হয়ে যাবে! মৃতুদন্ড হওয়ার আগে তার সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল। তার চেহারায় সেই আগের মতোই বিনয়ের ছাপ দেখতে পেয়েছিলাম। তার মাথা নাড়ানোর ভঙ্গি, লুক দেখে তখনো মনে হচ্ছিল- এই ব্যক্তিকে বিশ্বাস করা যায়।”
ক্রাইসিস সেন্টার কাজ করা অবস্থায় টেড ধর্ষণের ওপর একটি বুকলেট লিখেছিল। সেখানে এরকম বাক্য ছিল, “অনেক ধর্ষক দেখতে মোটেও লম্পটের মতো নয়। কিন্তু তারা বিশ্বাস করে নিজেদের কামনা জোরপূর্বক অন্যের ওপর দিয়ে মিটিয়ে নেওয়া যাবে।”
সে কাগজে আসলে নিজের চিন্তা-ভাবনাকে বিশ্লেষণ করেছিল মাত্র। অবশ্য তার সাবেক সহকর্মীরা একসময় ভাবতো টেড হয়তো শেষমেশ একজন প্রথম শ্রেণির উকিল হবে কিংবা নামকরা রাজনীতিবিদ হবে বা একজন সিনেটরও হয়ে যেতে পারে! কিন্তু ততদিনে টেড বান্ডি’র ক্যারিয়ারের জাহাজ আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর সিরিয়াল কিলার হওয়ার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছে!
মোট কতজন টেডের হামলার শিকার হয়েছিল তা কখনো জানা সম্ভব নয়। তবে ধারণা করা হয় কমপক্ষে ৩০ জন থেকে শুরু করে ১০০ জন নারী এবং মেয়েকে সে খুন করেছিল। অফিসিয়ালি তার এই অপকর্মের ব্যাপ্তি ছিল মাত্র চার বছর। তবে অ্যান রুলের ধারণা সে হয়তো নিজের কৈশোর থেকেই খুনোখুনি শুরু করেছিল। অবশ্য বান্ডি এটা সবসময় অস্বীকার করেছে। ডেথ সেলে স্বীকারোক্তি দেওয়ার সময় সে বলেছিল, ১৯৬৯ সালে সে প্রথম কোনো নারীকে অপহরণ করার চেষ্টা করে এবং তার প্রথম খুন ছিল ১৯৭২ সালে।
কাগজে-কলমে বান্ডি’র সবচেয়ে পুরোনো খুনটি ছিল ১৯৭৪ সালে, তখন তার বয়স ২৭ বছর। ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ ১৯৭৪ সাল, ভোরে লিন্ডা অ্যান হিলি নামের ২১ বছর বয়সী একজন ছাত্রীর রুমে ঢুকেছিল টেড। লিন্ডা ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের ছাত্রী ছিল। তাকে আচ্ছামতো পিটিয়ে অজ্ঞান করার পর, জিন্স আর শার্ট পরিয়ে একটা বিছানার চাদরের ভেতরে মুড়িয়ে তুলে নিয়েছিল টেড। সেদিন সকালে কলেজের বন্ধুরা লিন্ডা’র খোঁজ করতে শুরু করার পর তারা লিন্ডার বালিশে এক ইঞ্চি রক্তের দাগ দেখতে পায়। সেই দাগ সাক্ষী দিচ্ছিল যে লিন্ডা গতরাতে এখানেই ছিল।
প্রায় প্রতি মাসে একজন তরুণী নিখোঁজ হতে শুরু করল। ১২ মার্চ, ডোনা গেইল ম্যানসন নামের ১৯ বছর বয়সী এক তরুণী নিজের হোস্টেল থেকে অলিম্পিয়া’য় অবস্থিত এভারগ্রিন স্টেট কলেজ ক্যাম্পাসের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল। কলেজে ছাত্র অনুষদের সঙ্গীত আবৃত্তি অনুষ্ঠান ছিল সেদিন। কিন্তু ডোনাকে আর কখনো দেখা যায়নি।
১৭ এপ্রিল, সুস্যান র্যানকোর্ট নামের ১৮ বছর বয়সী এক তরুণী সেন্ট্রাল ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস থেকে একটি মিটিং শেষ করে ১২০০ ফুট দূরে অবস্থিত সিনেমা হলে গিয়েছিল। তাকেও আর কখনো দেখা যায়নি।
রবার্টা পার্কস, বয়স ২২ বছর। করভ্যালিস-এ অবস্থিত ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটি’র ছাত্রী। ৬ মে গভীর রাতে ক্যাম্পাসে হাটতে বেরিয়েছিল সে। কিন্তু কখনো ফিরে আসেনি।
২২ বছর বয়সী ব্রেন্ডা বল, পহেলা জুন সিয়াটল বার থেকে একজন অজ্ঞাত পুরুষের সাথে বেরিয়ে গিয়েছিল। তাকেও আর কখনো দেখা যায়নি।
জর্জিয়ান হকিন্স, বয়স ১৮। ১১ জুন প্রেমিকের বাসা থেকে নিজের হোস্টেলে ফেরার পথে গায়েব হয়ে গিয়েছিল। ওই এলাকায় হাতে প্লাস্টার করা একজন ব্যক্তিকে দেখা গিয়েছিল সেই রাতে। লোকটি আরেকজন ছাত্রকে একটি ব্রিফকেস বহন করে গাড়ির কাছে নেওয়ার জন্য সাহায্য করতে বলেছিল। তার গাড়িটি ছিল ভক্সওয়াগন বিটল।
টেড বান্ডি এই একই ছদ্মবেশ ১৪ জুলাইতেও ব্যবহার করেছিল। ৮ জন মানুষ বলেছিল তারা ভিএ বিটল গাড়ির সাথে একজন হ্যান্ডসাম পুরুষকে দেখেছিল। একহাত প্লাস্টার করা থাকায় সাহায্য চেয়েছিল সে। ঘটনাস্থল লেক স্যামামিশ স্টেট পার্ক, সিয়াটলের কাছেই। সেখানে তাপমাত্রা ছিল নব্বইয়ের (ফারেনহাইট) ঘরে। প্রায় ৪০ হাজার মানুষ পানিতে নেমে সাঁতার কাটছিল এবং সূর্যস্নান করছিল সেখানে।
তাদের মাঝে একজন ছিল জেনিস গ্রাহাম। বয়স ২২ বছর, একটা অফিসে কাজ করতো। রীতিমতো মৃত্যু মুখ থেকে ফিরে এসেছিল। সে টেড বান্ডির নিখুঁত বর্ণনা দিতে সক্ষম হয়েছিল। পুলিশকে জানিয়েছিল, সে পার্কের ব্যান্ডস্ট্যান্ডের (বাদ্যমঞ্চ) কাছে দাঁড়িয়েছিল, তখন আনুমানিক ২৫ বছর বয়সী একজন তরুণ তার কাছে আসে। সে খেয়াল করে দেখল তরুণটির পরনে রয়েছে জিন্স, একটা সাদা টি-শার্ট এবং তার বাম হাতটা প্লাস্টার করে ঝোলানো। তরুণটি তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “আমার সাহায্য করার মতো এক মিনিট সময় হবে? পালতোলা নৌকাটাকে আমার গাড়ির ওপরে তুলতে সাহায্য করবেন, প্লিজ?” জেনিস সাহায্য করতে রাজি হয়েছিল। তাকে নিকটস্থ পার্কিং লটে রাখা ভিডব্লিউ বিটল গাড়ির কাছে নিয়ে গিয়েছিল তরুণটি। কিন্তু সেখানে গিয়ে কোনো সেইলবোট বা পালতোলা নৌকার দেখা মেলেনি। অবশ্য বান্ডি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিল এই বলে, “বলতে ভুলে গেছি নৌকাটা আমার বন্ধুর বাসায় রয়েছে। পাহাড়ের ওপরের দিকে ওর বাসা।”
এই কথাটা শুনে ইতস্তত করতে শুরু করেছিল জেনিস, একটা অজুহাত দেখিয়ে সেখান থেকে সরে গিয়ে বেঁচে গিয়েছিল সে। “আমার স্বামীর সাথে দেখা করতে হবে। এমনিতেও অনেক দেরি হয়ে গেছে।” বলেছিল জেনিস। অবশ্য সে পুলিশকে এটাও বলেছিল অচেনা তরুণটি এতটাই সুদর্শন ছিল যে, আরেকটু হলেই সে নিজের মত বদলে তার সাথে যাবে বলে মনস্থির করে ফেলেছিল। “সে আসলে অনেক বন্ধুসুলভ ছিল, সবসময় বিনয়ের সাথে কথা বলছিল, আন্তরিকতা ছিল তার কথায়, তার সাথে সহজেই আলাপ করতে পারছিলাম। অনেক সুন্দর ছিল তার হাসিটা।”
বান্ডি’র সুদর্শনের ফাঁদে না পড়ে ব্যান্ডস্ট্যান্ডে ফিরে গিয়েছিল জেনিস। সেখান থেকে দেখেছিল বান্ডি অন্য একটি মেয়ের সাথে কথা বলছে। তাকে নিয়ে ভিডব্লিউয়ের দিকে যাচ্ছে সে। জেনিস মনে মনে ভেবেছিল, “খুব চালু পুরুষ তো!”
টেড বান্ডি’র দ্বিতীয় শিকারের নামও ছিল জেনিস। ২৩ বছর বয়সী জেনিস অট ছিল একজন শিক্ষনবীশ অফিস কর্মচারী। বান্ডি যখন তার কাছে কথা বলার জন্য যায় তখন সে সূর্যস্নান করছিল। আশেপাশে যারা ছিল তাদের কয়েকজন বান্ডি আর জেনিসের কথোপকথন শুনতে পেয়েছিল। এক হাত প্লাস্টার করা একজন তরুণ নিজেকে ‘টেড’ নামে পরিচয় দিয়েছিল এবং জেনিসকে তার নৌকা তোলার ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করেছিল সে। জেনিস তার দিকে তাকিয়ে হেসেছিল, তারপর উঠে নিজের বাইসাইকেল নিয়ে বান্ডি’র গাড়ির কাছে গিয়েছিল। তাকে আর কখনো জীবিত দেখা যায়নি।
ওই দিন পরে আরেকটা অঘটন ঘটেছিল। ডেনিস নাসলান্ড নামের ১৮ বছর বয়সী একজন সেক্রেটারি তার এক ঝাঁক বন্ধুদেরকে নিয়ে একটা জলপ্রবাহের কাছে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। একটা হ্রদে গিয়ে মিশেছিল জলপ্রবাহটি। শেষ বিকেল পর্যন্ত পানিতে নেমে সাঁতার কেটেছিল তারা। সাঁতার কাটা শেষে ডেনিস নিকটস্থ পাবলিক রেস্টরুমে পোশাক বদলাতে গিয়েছিল। বান্ডি’র ৮ম শিকার ছিল সে।
দুই মাস পর, সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখে একদল পাখি শিকারি গাছের ঝোঁপের নিচে ডেনিস এবং জেনিসের দেহাবশেষ খুঁজে পায়। তাদের দুজনকেই যৌন উন্মাদনার সাথে হত্যা করা হয়েছিল। দুজনের শরীরে কোনো কাপড় ছিল না। তাদের শরীরে থাকা অলংকারগুলো চুরি হয়ে গিয়েছিল।
১২ অক্টোবর, একই এলাকায় আরো দুজন নারীর লাশ পাওয়া যায়। এবারো লাশের আবিষ্কারকর্তা একজন শিকারি। মৃত দুজনের মাঝে একজনের পরিচয় জানা গিয়েছিল। তার নাম ক্যারল ভ্যালেনজুলা, বয়স ২০ বছর। দুই মাস আগে ওয়াশিংটন-ওরেগন সীমান্ত থেকে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল সে। অপর লাশটির পরিচয় কখনো জানা যায়নি।
একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে বান্ডি বেশ সাহসী হয়ে উঠেছিল। এতটাই সাহসী যে সে প্রকাশ্য দিবালোকে এবং নিজের আসল নাম ব্যবহার অঘটন ঘটাতে শুরু করেছিল। “হাই, আমি টেড।” বলে সে আলাপ শুরু করতো।
লেক স্যামামিশে সংগঠিত অপহরণে ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে ডিটেকটিভরা আবিষ্কার করেন- সেদিন কয়েকজন নারীর কাছে একজন হ্যান্ডসাম তরুণ আলাপ জমাতে গিয়েছিল। তার এক হাত প্লাস্টার করা ছিল। খুনী এবং তার গাড়ির যথাযথ বর্ণনা পাওয়ায় কিং কাউন্টি মেজর ক্রাইম ইউনিট জনস্বার্থে ছবি এঁকে প্রকাশ করে। পুলিশের হটলাইনে ৩ হাজারেও বেশি ফোন এসেছিল। তার মধ্যে একজন ফোন করে জানিয়েছিল, সন্দেহভাজন তরুণ একজন আইনের ছাত্র, নাম টেড বান্ডি। যদি এই ফোনকলটি না আসতো, তাহলে টেড বান্ডিকে হয়তো কখনো সন্দেহভাজন হিসেবে ভাবাই হতো কিংবা ভাবলেও তাকে সন্দেহভাজনদের তালিকার একদম নিচের দিকে রাখা হতো।
সাম্প্রতিক সময়ে খুনের ঘটনা সংগঠিত হওয়ার স্থানগুলোতে “হাই, আমি টেড।” সংলাপটি ব্যবহৃত হয়েছে। ৩০ আগস্ট, বান্ডি তার ওয়াশিংটন স্টেট অফিস অব ইমার্জেন্সি সার্ভিসেস-এর চাকরিটি ছেড়ে দিয়েছিল। নিজের রিজাইন লেটারে লিখেছিল, “আমাকে পৃথিবীর প্রয়োজন।” চাকরি ছেড়ে দিয়ে সে ইউটা’য় চলে গিয়েছিল। সল্ট লেক সিটিতে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব ইউটা ল স্কুলে ভর্তি হয় টেড। ঠিক তারপরেই সেখানে খুনোখুনি শুরু হয়। নতুন এলাকায় হ্যান্ডসাম টেড যেন একজন যাযাবর যমদূত রূপে আবির্ভাব হয়েছিল।
এবারের হত্যাকান্ড সমূহ ছিল অত্যন্ত নৃশংস প্রকৃতি। টেড সাধারণত তার শিকারদেরকে মুগুর দিয়ে আঘাত করে তারপর শ্বাসরোধ করে হত্যা করতো। খুন এবং ধর্ষণের পাশাপাশি সে মৃত নারীদের সাথে শারীরিক সম্পর্কও স্থাপন করতো। তার ভিকটিমরা যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছিল। কিন্তু তার নির্যাতনের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে লোকে তাকে ওয়্যারউলফ স্লেয়ার, ভ্যাম্পায়ার স্লেয়ার, রিপার স্লেয়ার ইত্যাদি নামে ডাকতে শুরু করেছিল।
সেপ্টেম্বর ২ তারিখে ওয়েস্ট কোস্ট থেকে ইউটা যাচ্ছিল বান্ডি। যাওয়ার পথে সে আইডাহো থেকে এক নারীকে লিফট দেওয়ার জন্য গাড়িতে তুলে নিয়েছিল। তারপর ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছিল তাকে। পরবর্তীতে টেড খুন করার বিষয়টি স্বীকার করলেও সেই নারীর লাশ কখনো পাওয়া যায়নি এবং তার পরিচয় অজানাই রয়ে গেছে।
ইউটায় মাঝেমধ্যেই খুন-খারাপি হচ্ছিল। ১৯৭৪ সালের ২ অক্টোবর, ১৬ বছর বয়সী ন্যান্সি উইলকক্স ভিডব্লিউ বিটল গাড়িতে লিফট নেওয়ার পর নিখোঁজ হয়েছিল। ১৮ অক্টোবর, ধর্ষিত এবং খুন হয়েছিল ১৮ বছর বয়সী মেলিসা স্মিথ। ৩১ অক্টোবর, ১৭ বছর বয়সী লরা এ্যামিকে পেটানোর পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছিল। ৮ নভেম্বরে প্রাণ হারিয়েছিল ১৭ বছর বয়সী ডেবি কেন্ট।
একই দিনে ১৮ বছর বয়সী ক্যারল দা রঞ্চ নামের এক তরুণীর ওপর ব্যর্থ হামলা চালিয়েছিল বান্ডি। ঘটনাস্থল ম্যরে, ইউটা। বান্ডি পুলিশ অফিসার সেজে তরুণীকে বলেছিল তার গাড়ির কাগজপত্রে সমস্যা আছে, তাই তাকে এখন পুলিশ স্টেশনে যেতে হবে। তরুণী বান্ডির নির্দেশ মতো বিটল গাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে বান্ডি তার হাতে হাতকড়া পরানোর চেষ্টা করে কিন্তু ব্যর্থ হয়। এবার বান্ডি একটা ধাতব বার দিয়ে তরুণীর মাথা ফাটাতে উদ্ধত হয়। কিন্তু চটপটে তরুণীটি প্রতিরোধ করে এবং একটা মোড়ে গাড়ির কিছুটা গতি কমতেই সে গাড়ির দরজা খুলে লাফ দেয়!
ইউটা ছাড়িয়ে বান্ডি’র খুনোখুনি কলোরাডোতেও ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯৭৫ সালে জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যে কমপক্ষে ৫ জন নারী নিখোঁজ হয়।
⚫ ১২ জানুয়ারি : ক্যারেন ক্যাম্পবেল, বয়স ২৩
⚫ ১৫ মার্চ : জুলি কানিংহাম, বয়স ২৬
⚫ ৬ এপ্রিল : ডেনিস অলিভারসন, বয়স ২৫
⚫ ১৬ এপ্রিল : মেলানি কুলি, বয়স ১৮
⚫ ১ জুলাই : শেলি রবার্টসন, বয়স ২৪
পুলিশ কাউকে অপরাধী হিসেবে শনাক্ত করতে পারেনি। শুধু এতটুকু আন্দাজ করতে পেরেছিল- খুনী ফর্মূলা মেনে খুন করছে এবং সে সম্ভবত এক প্রদেশ থেকে আরেক প্রদেশে ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছে। মনে হয় তার কোনো নির্দিষ্ট বাসস্থান নেই। দীর্ঘদিন পুলিশের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া সিরিয়াল কিলার অবশেষে পুলিশের সবচেয়ে সাদামাটা প্রক্রিয়ায় (রুটিন চেক) ধরা পড়েছিল।
১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট, ভোরে হাইওয়ে পেট্রোলম্যান রবার্ট হেওয়ার্ড ইউটা’য় অবস্থিত তার নিজের এলাকা গ্রাঞ্জার-এর একটি রুটিন কলের উত্তর দিচ্ছিলেন। তখন দেখলেন লাইট বন্ধ করে রাখা একটা ভিডব্লিউ গাড়ি দ্রুত গতিতে তার সামনে রাখা গতিরোধককে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। তিনি বিষয়টা রেডিওতে জানানোর কথা ভুলে গেলেন এবং পুলিশি সাইরেন চালু করে সেই গাড়িকে ধাওয়া করতে শুরু করলেন। ১২ ব্লক পর টেড বান্ডি তার গাড়ি থামায়। অফিসার হেওয়ার্ড পুলিশের গাড়ি দিয়ে ভিডব্লিউতে ধাক্কা মারেন এবং হাতে অস্ত্র নিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। তিনি বান্ডিকে জিজ্ঞেস করেন, গাড়ির ভেতরে কী আছে? বান্ডি জবাব দেয় “কিছু ভাঙ্গারি আছে।” পরে সেই “কিছু ভাঙ্গারি” হিসেবে বেরিয়ে এলো এক জোড়া হাতকড়া, একটি ক্রোবার, একটি স্কি মাস্ক এবং একটি নাইলন স্টকিং (মোজা)। চুরি করার সরঞ্জাম কিংবা ধর্ষকের আলামত সুলভ দৃশ্যমান জিনিসপত্র পাওয়া সত্ত্বেও বান্ডি’র বিরুদ্ধে শুধু পুলিশের নির্দেশে যথাসময়ে গাড়ি না থামানোর অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। বান্ডি দ্রুত জামিনে বেরিয়ে এসেছিল, তা বলাই বাহুল্য।
পরবর্তীতে একদিন বান্ডি ৫৬৫ ফার্স্ট এভিনিউতে অবস্থিত তার অ্যাপার্টমেন্টে গ্রেফতার হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে চুরির সরঞ্জাম রাখার অভিযোগ করা হয়েছিল এবার। অভিযোগটা গুরুতর না হলে বান্ডিকে ধরার জাল ধীরে ধীরে গুটিয়ে আসছিল।
ক্যারল দা রঞ্চ নামের তরুণীটির পুনরায় সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় এবং সে বান্ডির ড্রাইভিং লাইসেন্সে থাকা ছবি দেখে তার ওপর হামলাকারীকে শনাক্ত করে। ফলশ্রুতিতে টেড বান্ডি’র জামিন বাতিল হয়ে যায় এবং নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাকে থানায় ডেকে আনা হয়। দেখামাত্র ক্যারল দা রঞ্চ তাকে চিনে ফেলে।
অবশ্য পুলিশ তখনো তাদের কয়েদীর ওপরে খুনের অভিযোগ আনতে পারেনি। তবে তার ওপর অপহরণ এবং চুরি করার সরঞ্জাম রাখার অভিযোগ আনা হয়েছিল। কয়েক মাস ব্যাপী চলমান আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে টেড আরেকবার জামিন পেয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। সেই সুযোগে সে তার পুরোনো শিকার এলাকা সিয়াটলে চলে গিয়েছিল। অবশেষে ১৯৭৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি, ইউটা’র আদালতে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছিল টেড।
বিচারকগণ টেড বান্ডি’র নিরীহ-দর্শন চেহারা দেখে অবাক হয়েছিলেন। হাসি হাসি মুখের অধিকারী বাকপটু টেড আদালতেও নিজের নিরীহ-দর্শন চেহারাকে পুঁজি করে বিচারকদেরকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিল। তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল টেডের কাছে নারীদেরকে অপহরণ এবং হত্যা করার কোনো কারণই নেই। সে বেশ গর্ব করে বলেছিল, “আমি কেন নারীদেরকে আক্রমণ করতে যাব? আমার যত নারীসঙ্গ প্রয়োজন তা আমি পেয়েছি। কয়েক ডজন নারীর সাথে শুয়েছি আমি এবং তাদের সবাই নিজের ইচ্ছায় আমার সাথে বিছানায় গিয়েছিল।”
তখন বান্ডি’র বয়স ছিল ২৯ বছর। আদালতে সে নিজেকে চমৎকার ব্যক্তিত্বের অধিকারী হিসেবে প্রদর্শন করেছিল। সে ছিল বিনয়ী, কথা বলায় পটু এবং তার কথাগুলো খুবই বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হতো। কেসটি প্রায় তার পক্ষে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু সৌভাগ্যবশতঃ সে অপহরণকারী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত হয় এবং ১ থেকে ১৫ বছরের সাজা দেওয়া হয়।
এরপর আরেকটি কেসের বিচারকার্যের জন্য পুলিশ তাকে ইউটা থেকে কলোরাডোতে নিয়ে গিয়েছিল। ২৩ বছর বয়সী ক্যারিন ক্যাম্পবেল হত্যার অভিযোগ ছিল টেড বান্ডির বিরুদ্ধে। ১৯৭৫ সালের ১২ জানুয়ারি রাতে টেড তাকে একটি স্কি রিসোর্ট থেকে অপহরণ করেছিল।
কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো মুক্তি পেয়েছিল টেড; একবার নয়, দুবার! অ্যাসপেন-এর আদালতে শুনানি চলাকালীন সময়ে এক বিরতির ফাঁকে জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল সে। ৮ দিন পর পুলিশ তাকে পুনরায় গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয়বার সে জেল কক্ষের সিলিং প্যানেল কেটে সেখান দিয়ে বের হয়ে, একটা পুলিশের গাড়ি নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। প্রথমে শিকাগো, তারপর ফ্লোরিডায় যাত্রা করেছিল। পথিমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় যাত্রা বিরতি করে নিজের পরিচয় বদলে নিয়েছিল টেড বান্ডি।
আমেরিকার ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকার শীর্ষে ছিল সে, তারপরেও ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডা’র কাছে একটা রুম ভাড়া নেওয়ার সময় তাকে কেউ চিনতে পারেনি। বলাই বাহুল্য, টেড বান্ডি সেখান থেকে পুনরায় তান্ডব চালাতে শুরু করেছিল। ১৯৭৮ সালের ১৫ জানুয়ারি সে চুপিচুপি ইউনিভার্সিটির ছাত্রাবাসে ঢুকে কাঠের তৈরি ভারী একটা মুগুর দিয়ে চারজন ছাত্রকে নৃশংসভাবে পেটায়। টেড বান্ডি তাদের মধ্যে দুজনকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে এবং অদ্ভুতভাবে, এই দুজনের মাঝে একজনের পাছায় কামড় বসায়! প্রথমে মারা যায় ২১ বছর বয়সী মার্গারেট বোম্যান। তার পাছায় কামড় দেওয়ার আগে টেড তাকে নিষ্ঠুরভাবে পেটায় এবং তারই পরনে থাকা টাইটস দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। একইভাবে সে ২০ বছর বয়সী লিসা লেভি-কে হত্যা করে। ক্যারেন চান্ডলার এবং ক্যাথি কাইনার নামের দুজনকে প্রচন্ড মারধোর করে। তাদেরকে মারাত্মকভাবে জখম করে সেখান থেকে কেটে পড়ে টেড।
তার সর্বশেষ শিকার ছিল সবচেয়ে কম বয়সী; একজন কিশোরী। নাম : কিম্বারলি লিচ, বয়স : ১২ বছর। ৮ ফেব্রুয়ারি, লেক সিটি, ফ্লোরিডায় যৌন নির্যাতনের পাশাপাশি শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছিল তাকে। শূকরের জন্য ব্যবহৃত এক ছাউনিতে তার মৃতদেহ ফেলে রাখা হয়েছিল এবং লাশটি পচে গিয়েছিল।
টেডের সৌভাগ্যের মজুত শেষ হয়ে গিয়েছিল এক সপ্তাহ পর। তবে এবারো সেখানে কোনো ডিটেকটিভের চতুরতা বা কৌশলের ভূমিকা ছিল না। পুলিশের সাধারণ রুটিন টহলের মাধ্যমেই সে ধরা পড়েছিল। ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোরে পেনসিকোলা’র একজন পুলিশ সদস্য রেস্টুরেন্টের পার্কিং জোনে থাকা একটি ভিডব্লিউ গাড়ির নাম্বার প্লেট চেক করে দেখলেন সেটা কোনো চুরি হওয়া গাড়ির অংশ। ভিডব্লিউ গাড়ির চালক নিজেকে কেইন মিজনার নামে পরিচয় দিয়েছিল। টেড বান্ডি বিভিন্ন সময় যে ২১টি নাম ধারণ করতো এই নাম ছিল তার মধ্যে একটি। শুধু নাম-ই নয়, নামের সাথে মিলিয়ে ক্রেডিট কার্ড, চেকবই, পাসপোর্ট এবং কোম্পানির আইডি ছিল তার কাছে। বিস্তারিত প্রশ্ন করতেই টেড পুলিশ সদস্য ডেভিড লি-এর ওপর আক্রমণ করে পালানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ডেভিড তাকে আঘাত পূর্বক অজ্ঞান করে দিয়েছিলেন। টেডের জ্ঞান ফেরার পর ডেভিডকে বলেছিল, “আমাকে বরং মেরে ফেললেই ভাল করতেন।”
ইউনিভার্সিটির ছাত্রদেরকে খুন করার মামলায় টেড বান্ডিকে মিয়ামি’র আদালতে নিয়ে আসা হয়েছিল। তার পক্ষে লড়ার জন্য আদালত কর্তৃক প্রদত্ত ৫ জন আইনজীবি থাকা সত্ত্বেও টেড নিজেই নিজের মামলার অ্যাটর্নির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। আদালতে আগত সাক্ষীদেরকে জেরাও করেছিল সে। কিন্তু তারপরেও টেড দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল। তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করার পর বিচারক এডওয়ার্ড ডি. কাউয়ার্ট একটি বিশেষ বক্তৃতা প্রদান করেছিলেন। তার বক্তব্যে প্রমাণ হয়েছিল বিচারপতিগণও কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ব্যক্তির সৌন্দর্য এবং স্মার্টনেস দেখে মুগ্ধ হয়ে যেতে পারেন। এডওয়ার্ড বলেছিলেন,
“বিদ্যুতায়িত করার মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হলো। যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার মৃত্যু না হবে আপনার শরীরের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হবে। নিজের যত্ন নেবেন, ইয়াং ম্যান! আপনাকে আন্তরিকতার সাথে বলতে চাই- নিজের যত্ন নেবেন, প্লিজ। আজ আমি কোর্ট-রুমে যা দেখলাম, এটাকে মনুষত্ব্যের নিদারুণ অপচয় বললেও ভুল হবে না। আপনি যথেষ্ট মেধাবী, ইয়াং ম্যান! আইনজীবি হিসেবেও দারুণ। আমার সামনে আপনাকে ভবিষ্যতে আরো ওকালতি প্র্যাকটিস করতে দেখলে আমি বরং খুশি হতাম। কিন্তু আপনি এখন ভিন্ন পথের পথিক। নিজের যত্ন নেবেন। জেনে রাখুন, আপনার প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ নেই। আবারো বলছি, নিজের যত্ন নেবেন।”
পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে বান্ডি ১২ বছর বয়সী কিম্বারলি লিচ হত্যা মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল। আদালতে বিচারকগণ রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন কারণ কিশোরী কিম্বারলি’র শরীরে থাকা কামড়ের দাগ বান্ডি’র দাঁতের সাথে মিলে গিয়েছিল! বলাই বাহুল্য, এই মামলার রায়েও বান্ডির বিপক্ষে যায় এবং তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়।
ডেথ রো-তে মৃত্যুদন্ড হওয়ার অপেক্ষায় দীর্ঘদিন সিরিয়ালে ছিল টেড বান্ডি। ভয়ঙ্কর খুনী হওয়া সত্ত্বেও কারাগারে বান্ডি’র কাছে অসংখ্য সমর্থনমূলক চিঠি এবং বিয়ের প্রস্তাবও আসতো। অসংখ্য নারী তার কাছে চিঠি লিখতো। তারা বিশ্বাসই করতে পারতো না তার মতো মারাত্মক হ্যান্ডসাম পুরুষ এরকম জঘন্য অপরাধ করতে পারে।
বান্ডি বারবার আপিল করে নিজের মৃত্যুদন্ড প্রায় ১০ বছর বিলম্ব করাতে পেরেছিল। মামলাটি আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গিয়েছিল এবং মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে প্রায় ৭০ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছিল তার। কিন্তু শেষপর্যন্ত বান্ডি ৩০টি খুনের দায় স্বীকার করেছিল। বলেছিল, “এজন্য আমার মরণ হওয়া উচিত।”
ক্যালিফোর্নিয়া, মিশিগান, পেনসিলভেনিয়া, আইডাহো এবং ভারমন্ট এলাকা জুড়ে টেড খুন করে বেরিয়ে ছিল। তার মাঝে কয়েকটি খুন ছিল ডে ট্রিপের মতো। অর্থাৎ, বান্ডি কোনো একটা শহরে ঢুকতো, সেখানকার কোনো শিকার নির্বাচন করে তাকে খুন করতো এবং তারপর সেই শহর থেকে কেটে পড়তো।
জানুয়ারি, ১৯৮৯। কারাগারের নাম : ফ্লোরিডা স্টেট প্রিজন। অবশেষে কুখ্যাত খুনীর অন্তিম সময় ঘনিয়ে এলো। টেড বান্ডির জীবনের শেষ রাতটিতে তার সাথে সময় কাটিয়ে ছিলেন ধর্মপ্রচারক জেমস ডবসন। বান্ডি তার রাতের খাবার না খেয়ে প্রকাশ্যে চোখের জল ফেলেছিল। ডবসনকে জানিয়েছিল নিজের বিকৃত যৌন উন্মাদনার কথা।
পরবর্তীতে ডবসন লিখেছিলেন : “টেড বান্ডি বলেছিল, তার হামলা থেকে সমাজকে রক্ষা করার অধিকার সমাজের রয়েছে। প্রথম নারীকে হত্যা করার পর সে ৬ মাস প্রচন্ড যন্ত্রণা অনুভব করেছিল। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল, তার বিশ্বাসই হচ্ছিল না সে এরকম কিছু করে বসতে পারে। কিন্তু ধীরে ধীরে এই অনুভূতি প্রশমিত হয়ে গিয়েছিল। নিজের যৌন উন্মাদনাকে পরিতৃপ্ত করার জন্য আরেকজন নারীকে হত্যা করেছিল সে। খুনের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে অপরাধবোধের যন্ত্রণা হতে মুক্তি পেতে তার যে সময় প্রয়োজন হতো, সেটার পরিমাণ কমতে শুরু করে। একসময় সে এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছায়, যেখানে তার মাঝে আর কোনো অপরাধবোধই ছিল না।”
২৪ জানুয়ারি সকাল ৭টা ০৬ মিনিটে টেড বান্ডিকে ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। শেষবারের মতো সে অনুভব করেছিল পায়ের সাথে সংযুক্ত ঠান্ডা ধাতব ইলেকট্রোডের স্পর্শ। টেডের শেষ কথাগুলো ছিল, “দয়া করে আমার পরিবার ও বন্ধুদের কাছে আমার ভালবাসাটুকু পৌঁছে দেবেন।”
তবে কারাগারের বাইরের পরিবেশ ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। সবাই তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করছিল। কয়েক শ’ লোক জড়ো হয়ে শ্লোগান দিয়েছিল, “পোড়াও! বান্ডিকে পোড়াও!” কারাগারের নিকটে থাকা স্থানীয় এক ডিজে তার শ্রোতাদেরকে বলেছিল, “সবাই আপনাদের কফি মেকারগুলোকে বন্ধ করে রাখুন। আজকে কিন্তু অনেক বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে!”
অবশেষে দুই মিনিটেরও কম সময়ের জন্য খুনে টেড বান্ডি’র শরীরের ভেতর দিয়ে ২ হাজার থেকে ৩ হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হয়। ৭টা ১৬ মিনিটে মৃত ঘোষণা করা হয় তাকে। অতঃপর টেডি’র লাশ চাকাযুক্ত একটা ট্রলিতে করে সরিয়ে নেওয়া হয়। টেড পৃথিবী থেকে চলে গেলেও গোয়েন্দা ও ইতিহাসবিদদের জন্য সে এমন রহস্য রেখে গিয়েছে যা হয়তো কখনো ভেদ করা সম্ভব হবে না।
অফিসিয়ালি তাকে যে ৯টি খুনের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে সে কি শুধু ওই খুনগুলো করেছিল নাকি খুনের সংখ্যাটা আরো বেশি? যে ৩০টি খুনের কথা সে স্বীকার করেছিল, সেটাকে সত্য বলে ধরে নেওয়া যাবে? কয়েকজন তদন্তকারীর মতে সংখ্যাটা ১০০-এর ওপরে! তাহলে সত্য কোনটা? অবশ্য সর্ব-সম্মতিক্রমে খুনের আনুমানিক সংখ্যাটা হলো : ৩৫।
থিওডোর বান্ডি মারা গেলেও আমাদের জন্য একটি কলঙ্কজনক ধাঁধাঁ রেখে গেছে। ঠিক কোন কারণে সে ওরকম হয়ে গিয়েছিল? কী তাকে মুহূর্তের মধ্যে হ্যান্ডসাম প্রেমিক পুরুষ থেকে নৃশংস খুনীতে রূপান্তরিত করতো? তার মতো একজন আদর্শ আমেরিকান তরুণ, যার জীবনের সবকিছু কিনা তার পক্ষেই ঘটছিল। ঠিক কোন কারণে সে আমেরিকার সবচেয়ে নিন্দনীয় সিরিয়াল কিলারে পরিণত হয়েছিল? প্রশ্নগুলোর উত্তর হয়তো অজানাই রয়ে যাবে।
অনুবাদ : সাঈম শামস্
তথ্যসূত্র : BBC, Biography, Serial Killers: The World’s Most Evil
আপনার মতামত জানানঃ