রাজধানীর উপকণ্ঠ সাভারের আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় করা মামলার বিচার সাক্ষীর অভাবে থমকে আছে। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর তাজরীন ফ্যাশনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান ১১২ জন শ্রমিক। এ মামলায় সব শেষ গত বছরের ৭ মার্চ সাক্ষ্য গ্রহণ হয়। ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে এ মামলার বিচারকাজ চলছে। ওই আদালতে বর্তমানে রাষ্ট্র নিযুক্ত কোনো পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) নেই।
২০ মাসের মধ্যে এ মামলায় শুনানি হয়নি এক দিনও। রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, আদালত বারবার সমন দিলেও সাক্ষী হাজির হচ্ছে না। অগ্নিকাণ্ডের পর গত আট বছরে আলোচিত এ মামলায় ১০৪ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র আটজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। কবে এ মামলার বিচার শেষ হবে, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর। এদিকে গতকাল তাজরীন ট্রাজেডির আট বছর পূর্তিতে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা গণভবন অভিমুখে ‘জিন্দা লাশের মিছিল’ নিয়ে যেতে চাইলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। দিবসটি উপলক্ষে কিছু সংগঠন মোমবাতি জ্বালিয়ে কারখানার নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করেছে। এ সময় অনেক স্বজন কান্নায় ভেঙে পড়েন। নিহতদের আত্মার মাগফিরাতে দোয়া করা হয়।
মামলার অগ্রগতি সম্বন্ধে জানা যায়, গত বছরের ৭ মার্চ এ মামলায় সাভার থানার এসআই আবিদ হোসেনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। তিনি অগ্নিকাে নিহত শ্রমিকদের সুরতহাল তৈরি করেছিলেন। পরে আর কোনো সাক্ষীকে আদালতে হাজির করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। ফলে ২০ মাস ধরে কোনো সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি। আদালত বারবার ধার্য তারিখে সাক্ষী হাজিরের সমন দিলেও তদন্ত কর্মকর্তা তাকে উপস্থিত করতে সফল হননি। ২০১৫ সালে এ মামলায় অভিযোগ গঠনের পর থেকে এখন পর্যন্ত ৪২ দিন শুনানি হয়েছে। তাতে আটজনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। মামলার ১৩ আসামির মধ্যে আটজন জামিনে এবং পাঁচজন পলাতক। আগামী ১৩ জানুয়ারি এ মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।
সাক্ষী হাজির না হওয়া প্রসঙ্গে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের এক কর্মকর্তা জানান, আদালত থেকে সাক্ষীদের ঠিকানায় সমন পাঠানো হলেও তা ফেরত আসছে। হয়তো তারা আগের ঠিকানা বদলে ফেলেছেন। জানতে চাইলে ঢাকা জেলা ও দায়রা আদালতের চিফ পাবলিক প্রসিকিউটর খন্দকার আবদুল মান্নান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আদালত থেকে বারবার সমন দিয়েও সাক্ষী হাজির করা যাচ্ছে না। ওই আদালতে পিপি নেই, এটিও একটি সমস্যা। তা ছাড়া করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর বিচারের তেমন উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। মামলার বিচার শুরু এবং এর সমস্যা নিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের গাফিলতির কারণে এ মামলার বিচার এখনও শেষ হয়নি। সাক্ষী হাজিরেও তারা ব্যর্থ। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও পুলিশ- কেউ মামলাটি দ্রুত বিচারের জন্য আন্তরিক নন।
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১১২ জন নিহত এবং দুই শতাধিক শ্রমিক আহত ও দগ্ধ হন। এ ঘটনার মামলায় গত ২২ ডিসেম্বর তাজরীনের চেয়ারম্যান মাহমুদা, দেলোয়ারসহ ১৩ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। এতে দণ্ডবিধির ৩০৪ ও ৩০৪ (ক) ধারা অনুযায়ী আসামিদের বিরুদ্ধে ‘অপরাধজনক নরহত্যা’ ও ‘অবহেলার কারণে মৃত্যু’র অভিযোগ আনা হয়। এ ঘটনার প্রায় তিন বছর পর ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।
অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিরা হলেন, তাজরীন ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন, তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার, প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী এম মাহবুবুল মোর্শেদ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা দুলাল, স্টোর ইনচার্জ হামিদুল ইসলাম লাভলু, সিকিউরিটি সুপারভাইজার আল-আমিন, ইনচার্জ আনিসুর রহমান, স্টোর ইনচার্জ আল-আমিন, কারখানার ম্যানেজার আবদুর রাজ্জাক, প্রোডাকশন ম্যানেজার মোবারক হোসেন মঞ্জু, কোয়ালিটি ম্যানেজার শহিদুজ্জামান দুলাল, সিকিউরিটি গার্ড রানা ওরফে আনারুল ও লোডার শামীম মিয়া। তাদের মধ্যে পাঁচজন পলাতক। বাকিরা জামিনে আছেন।
২৪ নভেম্বর ২০২০, গতকাল মঙ্গলবার ছিল তাজরীন ট্র্যাজেডির অষ্টম বর্ষ। এদিন অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের স্মরণ করেছেন তাদের স্বজন, আহত শ্রমিক ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এ উপলক্ষে সকালে তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা তিন দফা দাবি নিয়ে রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে গণভবনে ‘জিন্দা লাশের মিছিল’ নিয়ে যেতে চাইলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। তাজরীনের সাবেক শ্রমিকরা এসব দাবি পূরণে দুই মাসের বেশি সময় ধরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান করছেন। তারা সুচিকিৎসা, এককালীন ক্ষতিপূরণ ও বাসস্থানের সুব্যবস্থার দাবি জানাচ্ছেন। শ্রমিকরা দুপুর সোয়া ১২টার দিকে গণভবনের দিকে যাওয়ার চেষ্টাকালে পুলিশ বাধা দিলে তারা সেখানে শুয়ে পড়েন। এ সময় শ্রমিকরা দাবি-দাওয়া নিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন।
তাজরীনের আহত শ্রমিক রেহানা আক্তার বলেন, তাজরীনের আগুনে তার পরিবারের চার সদস্য মারা গেছেন। তিনিও সেখানে কাজ করতেন। ভবন থেকে লাফ দিয়ে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। কথা বলতে বলতে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। জরিনা নামে এক শ্রমিক বলেন, ‘আমি আমার দুই সন্তানকে নিয়ে দুই মাসের বেশি সময় ধরে প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান করছি। তাজরীনে আগুন লাগার সময় আমি তিন তলা থেকে লাফ দিই। আশা ছিল, আমি মরে গেলেও আমার পরিবার লাশ খুঁজে পাবে। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলে তো আর কিছু পাবে না। এখন পা ভেঙে পঙ্গু হয়ে বেঁচে আছি।’
এদিন বিভিন্ন সংগঠন নিহতদের কবরে মোমবাতি জ্বালিয়ে ও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে। দিনের প্রথম প্রহরে কারখানার ফটকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন নিহতদের স্বজন, আহত শ্রমিক ও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা। নিহতদের কবরগুলো কালো ব্যানার ও ফুল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে জুরাইন কবরস্থানে আসেন বিভিন্ন সংগঠন ও পোশাক কারখানার নেতাকর্মীরা।
এসডাব্লিউ/আরা/১০৩০
আপনার মতামত জানানঃ