ক্ষমতাসীন সরকার কর্তৃক ও সরকারের প্রশ্রয়ে নানা অন্যায় অনিয়ম ও নির্যাতনের পারদের ঊর্ধ্বগতিতে একদিকে কথা বলার, প্রতিবাদ করার নানা রসদ জন্ম নিচ্ছে, অন্যদিকে কথা বলাবিরোধী বিভিন্ন আইন করে কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তেমনি একটি আইন— ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। সরকার বিরোধী কোনো কথা বা শিল্পকর্মকেই এই আইনের অধীনে অপরাধী হিসাবে সাব্যস্ত করা হচ্ছে এবং গ্রেপ্তার করে নানা নির্যাতনের মাধ্যমে উচিত শিক্ষা দেওয়ার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা এই আইনকে মূলত সরকার নিরাপত্তা আইন বলে মানতে চান। কেননা, এই আইনের অধীনে এ পর্যন্ত যত মামলা, আটক ও গ্রেপ্তার হয়েছে তার প্রায় সবকটাই সরকারের সমালোচনা করার প্রেক্ষিতে।
সম্প্রতি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, সাংবাদিক তাসনিম খলিল ও ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, সাংবাদিক তাসনিম খলিল ও ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের বিরুদ্ধে কঠোর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার ও তাদের পরিবারের সদস্যদের হয়রানি না করার আহ্বান জানিয়েছে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে)।
গতকাল মঙ্গলবার সংগঠনটির পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি এ আহ্বান জানানো হয়।
গত ৮ ও ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, সুইডেন-ভিত্তিক ‘নেত্র নিউজ’র সম্পাদক তাসনিম খলিল ও ফটোসাংবাদিক ও ‘দৈনিক পক্ষকাল’র সম্পাদক শফিকুল ইসলাম কাজলের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানো ও সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড চালানোর অভিযোগ গ্রহণ করেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, কার্টুনিস্ট কিশোর তার ‘আমি কিশোর’ ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেশের করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সরকারের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনামূলক কার্টুন-পোস্টার পোস্ট করতেন। মুশতাক তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে কিশোরের সেসব পোস্টের কয়েকটি শেয়ার করেছেন। আসামিরা ‘আই এম বাংলাদেশি’ নামে ফেসবুক পেজে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ন করতে বা বিভ্রান্তি ছড়ানোর উদ্দেশে অপপ্রচার বা গুজবসহ বিভিন্ন ধরনের পোস্ট দিয়েছেন, যা জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায়। এ ছাড়া হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক মেসেঞ্জারে তাসনিম খলিল, সায়ের জুলকারনাইন, শাহেদ আলম, আসিফ মহিউদ্দিনের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক চ্যাটিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
মামলায় তাদের বিরুদ্ধে পরস্পর যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মুক্তিযুদ্ধ, মহামারি করোনাভাইরাস সম্পর্কে গুজব, রাষ্ট্র ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে অপপ্রচার ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি, অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগ আনা হয়।
গত বছরের ৯ মার্চ কাজলসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন মাগুরা-১ আসনের সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শেখর। এরপর ১০ ও ১১ মার্চ রাজধানীর হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচর থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কাজলের বিরুদ্ধে আরও দুটি মামলা হয়।
গত বছরের ১৮ মার্চ রাতে কাজলকে অপহরণ করা হয়েছে অভিযোগ এনে চকবাজার থানায় মামলা করেন তার ছেলে মনোরম পলক। ঢাকা থেকে নিখোঁজের ৫৩ দিন পর গত বছরের ২ মে রাতে বেনাপোলের ভারতীয় সীমান্ত সাদিপুর থেকে অনুপ্রবেশের দায়ে ফটো সাংবাদিক ও দৈনিক পক্ষকালের সম্পাদক শফিকুল ইসলাম কাজলকে আটক করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
‘রাজনৈতিক মন্তব্যের কারণে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, সাংবাদিক তাসনিম খলিল ও ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকে বাংলাদেশ সরকার যে আইনি হয়রানি করেছে, তা শিগগির বন্ধ করা উচিত।’
সিপিজে’র এশিয়া প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর স্টিভেন বাটলার বলেন, ‘রাজনৈতিক মন্তব্যের কারণে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, সাংবাদিক তাসনিম খলিল ও ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকে বাংলাদেশ সরকার যে আইনি হয়রানি করেছে, তা শিগগির বন্ধ করা উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত। তাদের হয়রানি বন্ধ করা উচিত এবং কঠোর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা উচিত।’
বর্তমানে কিশোর ও কাজল জামিনে আছেন। সুইডেনপ্রবাসী তাসনিম খলিলের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
তাসনিম সিপিজে’কে জানান, তার গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বিষয়টি বাংলাদেশ সরকার তাকে জানায়নি। তিনি সংবাদমাধ্যম সূত্রে তা জেনেছেন।
বাংলাদেশ সরকার ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে নেত্র নিউজের ওয়েবসাইট ব্লকড করে রেখেছে।
গতকাল সিপিজে’র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বিষয়ে জানতে সংগঠনটির পক্ষ থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারকে ই-মেইল করা হলে এর কোনো প্রত্যুত্তর পাওয়া যায়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকারের সমালোচনা করলেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হচ্ছে। এই আইনে মামলা ও গ্রেপ্তারের যেসব ঘটনা ঘটছে, পরিষ্কারভাবে তা গণমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতার জন্য মারাত্মক হুমকি।
তারা বলেন, বাংলাদেশে হত্যার আসামির দণ্ড মওকুফ হয় অথবা দ্রুত জামিন হয়, ঋণখেলাপি ও আর্থিক খাত থেকে লুটপাটকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে, হাজার-কোটি টাকা বিদেশে পাচারকারী সহজেই দেশ ছাড়তে পারে, কিন্তু ফেসবুকে সরকারবিরোধী কিছু লেখা যেন তার চাইতে বড় অপরাধ!
তারা বলেন, সাংবাদিক সমাজের যারা প্রতিনিধি তারা শুরু থেকেই যে আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছিলেন সেটা এখন বিবেচনায় নেওয়ার সময় আছে। তা না হলে যেটা হবে এখানে মতপ্রকাশ বলে কিছু থাকবে না।
তারা বলেন, যে নিরাপত্তা আইন তৈরি করা হয়েছে, সে আইন নিয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, এ আইন কার জন্য করা হয়েছে? আইন তো তৈরি করা হয় সাধারণ জনগণের জন্য। এই আইন আসলে কার নিরাপত্তা দিচ্ছে? এ আইনে যারা বাদী হয়েছেন, তাদের অধিকাংশ এমপি, মন্ত্রী ও প্রশাসনের লোকজন। আর যারা আইনের শিকার হয়েছেন তারা সাংবাদিক, লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট। আমাদের সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের সাহস গড়ে তোলেন একজন লেখক, সাহিত্য, অ্যাক্টিভিস্ট ও সাংবাদিক। তারা যেন মুক্তভাবে কথা বলতে পারে সেজন্য তাদের সমর্থন করুন। আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো একটি নিপীড়নমূলক আইন গণতন্ত্রের দেশে থাকতে পারে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৫২
আপনার মতামত জানানঃ