প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য ঠেকাতে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে নতুন এক প্রতিরক্ষা চুক্তির ঘোষণা দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। ত্রি-পক্ষীয় এই চুক্তির আরেক অংশীদার ব্রিটেন। এর ফলে দেশ তিনটি নিজেদের উন্নত প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি পরস্পরের সঙ্গে বিনিময় করতে পারবে।
বুধবার (১৫ সেপ্টেম্বর) হোয়াইট হাউজের ইস্টরুম থেকে ভার্চুয়াল চুক্তি সই অনুষ্ঠানে যোগ দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য নিউইয়র্ক টাইমস জানাচ্ছে, নতুন এই প্রতিরক্ষা চুক্তির আওতায় প্রশান্ত মহাসাগরে পারমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিন মোতায়েনে অস্ট্রেলিয়াকে সার্বিক সহায়তা করবে ব্রিটেন এবং আমেরিকা। এই সাবমেরিনগুলো অসীম রেঞ্জের মধ্যে আরও শব্দহীনভাবে চলাচল করতে পারে এবং এদের অবস্থান শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব। একইসঙ্গে, প্রশান্ত মহাসাগরে পশ্চিমা সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি আরও বাড়াতে কাজ করবে তিন দেশ।
বিবিসি জানিয়েছে, ত্রিদেশীয় এই চুক্তিটির নাম দেওয়া হয়েছে— এইউকেইউএস। চুক্তি অনুযায়ী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম প্রযুক্তি ও সাইবার সংক্রান্ত বিষয়গুলোর তথ্যও একে অপরের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া।
নতুন এ জোটের ফলে অস্ট্রেলিয়া প্রথমবারের মতো পারমাণবিক শক্তিধর সাবমেরিন বানানোর সুযোগ পেতে যাচ্ছে। তবে অস্ট্রেলিয়াকে ২০১৬ সালে ফ্রান্সের সঙ্গে ১২টি সাবমেরিন বানাতে ৫ হাজার কোটি অস্ট্রেলীয় ডলারের একটি চুক্তিও বাতিল করতে হয়েছে। এমন পদক্ষেপের কঠোর সমালোচনা করেছে ফ্রান্স।
এদিকে নতুন এই প্রতিরক্ষা চুক্তিকে চীনের বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম দৃশ্যমান সামরিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। এমন এক সময় চুক্তিটি কার্যকর হলো— যখন দক্ষিণ চীন সাগর থেকে উত্তরে তাইওয়ান পর্যন্ত বিস্তৃত জলসীমায় নিয়মিত টহল শুরু করেছে অস্ট্রেলিয়া।
তবে বহুদিন ধরেই চীন ওই অঞ্চলকে নিজেদের অংশ দাবি করে আসছে। পাশাপাশি সেখানে ‘বহিঃশক্তি’র উপস্থিতি নিয়ে কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আসছে বেইজিং।
তিন বছর আগে হুয়াওয়েকে নিজেদের টেলিকম নেটওয়ার্ক থেকে নিষিদ্ধ করে চীনের বিরাগভাজনে পরিণত হয় অস্ট্রেলিয়া।
এখন আবার পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিন মোতায়েন চুক্তির মাধ্যমে দেশটি চীনবিরোধী জোটের দেশগুলোর মধ্যে সামরিক শক্তিতে অনেকখানি এগিয়ে গেল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ত্রিদেশীয় এই চুক্তিটির নাম দেওয়া হয়েছে— এইউকেইউএস। চুক্তি অনুযায়ী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম প্রযুক্তি ও সাইবার সংক্রান্ত বিষয়গুলোর তথ্যও একে অপরের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া।
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক উপস্থিতি ও শক্তি বৃদ্ধির বিষয়ে এই তিনটি দেশই খুব উদ্বিগ্ন। নতুন নিরাপত্তা চুক্তির ঘোষণা উপলক্ষ্যে বুধবার এক যৌথ বিবৃতি দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এইউকেইউএস চুক্তির অধীনে প্রথম উদ্যোগ হিসেবে, অস্ট্রেলিয়ার রাজকীয় নৌবাহিনীর পারমাণবিক সাবমেরিন সক্ষমতা অর্জনে দেশটিকে সহায়তা দিতে আমরা কাজ করবো।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনীতে পারমাণবিক সাবমেরিন যুক্ত হলে, সেটি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বাড়াবে এবং আমাদের তিন দেশের যৌথ মূল্যবোধ ও স্বার্থরক্ষায় সেটি ব্যবহার করা হবে।
এদিকে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন বলেছেন, ‘আগামী দেড় বছরের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিন তৈরি করার একটি যৌথ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে এইউকেইউএস। এটি বাস্তবায়ন করা হলে বিশ্বের পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন থাকা সপ্তম দেশে পরিণত হবে অস্ট্রেলিয়া।
চীনের সঙ্গে আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশের সম্পর্ক খারাপ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তিন দেশের এই চুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভার্চুয়াল বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ‘আজ আমরা একটা ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছি। এর ফলে তিন দেশের সম্পর্ক আরো জোরালো হবে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা দীর্ঘস্থায়ী হবে।”
বাইডেন বলেছেন, ‘আজ এবং আগামীর হুমকি মোকাবিলায় মিত্রদেশগুলোর সঙ্গে আমেরিকার অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করবে নতুন এই প্রতিরক্ষা চুক্তি। এর মধ্য দিয়ে পুরাতন মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন অধ্যায় রচিত হলো বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, ‘এই চুক্তির ফলে অস্ট্রেলিয়া পরমাণু-চালিত সাবমেরিন বানাতে পারবে। এর ফলে বন্ধুত্বের এক নয়া অধ্যায় শুরু হলো’।
জনসন জানিয়েছেন, ‘এই সাবমেরিনে পরমাণু রিঅ্যাকটর থাকবে, পরমাণু অস্ত্র নয়। পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের বিষয়টি মাথায় রেখেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে’।
যুক্তরাজ্যের পর অস্ট্রেলিয়াকেই আমেরিকা এই প্রযুক্তি দিচ্ছে। তাই ফ্রান্সের কাছ থেকে তাদের আর পরমাণু-চালিত সাবমেরিন কিনতে হবে না।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন বলেছেন, ‘অ্যাডিলেডে সাবমেরিন বানানো হবে। আমেরিকা ও যুক্তরাজ্য সাহায্য করবে।’
তিনি জানিয়েছেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনীকেও শক্তিশালী করা হচ্ছে। তাদের হাতে দূরপাল্লার ক্ষেপনাস্ত্র দেয়া হচ্ছে।’
এই ঘোষণার পর নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী আবার জানিয়ে দিয়েছেন, তাদের জলসীমায় পরমাণু-চালিত সাবমেরিনের প্রবেশ নিষেধ।
চীনের মোকাবিলা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানকে নিয়ে কোয়াড-ও তৈরি হয়েছে। এই গোষ্ঠীর বৈঠক আগামী মাসে ওয়াশিংটনে হবে।
এই চুক্তি নিয়ে চীনের প্রতিক্রিয়া হলো, ‘এই দেশগুলি ঠান্ডা যুদ্ধের মাসিকতা ও মতাদর্শগত গোঁড়ামি থেকে বের হতে পারেনি।’
সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের আমল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক খুবই খারাপ হয়েছে। দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে উত্তেজনা বারবার সামনে এসেছে। মানবাধিকার, পরিবেশ, হংকং নিয়ে চীনের মনোভাবের বিরোধী যুক্তরাষ্ট্র। বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর চীনের সঙ্গে আলোচনা আবার শুরু করেছেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু পশ্চিমা দেশগুলি মনে করে, চীন আগ্রাসী আন্তর্জাতিক নীতি নিয়ে চলছে।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৮০৬
আপনার মতামত জানানঃ