মধ্যপ্রচ্য তথা উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে উটের গুরুত্ব অপরিসীম। এ অঞ্চলে শত-সহস্র বছর ধরে মাংস, পরিবহনের জন্য এবং যুদ্ধে উট ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। উট সৌদি আরবের জাতীয় পশুও বটে।
বছর তিনেক আগে সৌদি আরবের মরুভূমিতে ২১টি উট, ঘোড়া ও অন্যান্য সমগোত্রীয় প্রাণীর পাথুরে ভাস্কর্য পাওয়া যায়। পাথরে খোদাই করা এসব ভাস্কর্যের হদিস মেলে ২০১৮ সালে। সে সময় প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধারণা করেন, এসব ভাস্কর্য দুই হাজার বছরের পুরনো। কিন্তু নতুন গবেষণা বলছে, এসব ভাস্কর্য সাত থেকে আট হাজার বছর আগের। এই অঞ্চলে এ ধরনের ভাস্কর্যের তেমন একটা দেখাও মেলে না।
সৌদি আরবের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, ম্যাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউট ফর দ্য সায়েন্স অব হিউম্যান হিস্ট্রি, ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চ ও কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বিত প্রচেষ্টায় এই গবেষণা পরিচালিত হয়।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌদি আরবে এই পাথুরে ভাস্কর্যগুলো ২০১৮ সালে সন্ধান পান গবেষকেরা। তখন তারা বলেছিলেন, ভাস্কর্যগুলো দুই হাজার বছরের পুরোনো হতে পারে। জর্ডানের বিখ্যাত প্রাচীন নগরী পেত্রার ভাস্কর্যগুলোর সঙ্গে এগুলোর মিল থাকায় গবেষকেরা সেই ধারণা করেছিলেন। কিন্তু নতুন একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, সৌদি আরবের উটের ভাস্কর্যগুলো সাত থেকে আট হাজার বছরের পুরোনো। মধ্যপ্রাচ্যে শিলা কেটে বানানো বিশাল ভাস্কর্যের সন্ধান পাওয়ার বিষয়টি বিরলও।
নতুন গবেষণাপত্রটি ‘আর্কিওলজিক্যাল সায়েন্স’ সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ভাস্কর্যের ক্ষয়ের ধরন, হাড়ের প্রকৃতি প্রভৃতি বিষয় বিশ্লেষণ করে নতুন সময়কাল পাওয়া গেছে। এসব ভাস্কর্য ইংল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলের উইটশায়ারে অবস্থিত স্টোনহেঞ্জের সময়কালের (পাঁচ হাজার বছর আগের) চেয়েও পুরনো। এমনকি মিসরের পিরামিড (সাড়ে চার হাজার বছরের পুরনো) নির্মাণকালের প্রায় দ্বিগুণ সময় আগের। তবে গবেষকরা বলেছেন, সে সময় কেন উটের ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছিল, তা এখনো অজানা। সম্ভবত উপজাতিদের মিলনস্থল হয়ে থাকতে পারে।
প্রস্তর শিল্পের নির্মাণকাল শনাক্ত করা বেশ কঠিন। বিশেষত, উত্তর-পশ্চিম সৌদি আরবের আল-জাওয়াফ প্রদেশের ‘ক্যামেল সাইট’ অঞ্চলটিতে ভাঙনের ফলে এই ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্যগুলোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
এই ঐতিহাসিক স্থাপনাঞ্চলের বয়স শনাক্ত করতে বিজ্ঞানীরা ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে থাকা টুল মার্ক এবং আবহাওয়াজনিত কারণে ভাস্কর্যের উপর বসে যাওয়া নানা চিহ্ন পর্যবেক্ষণ করেন। এছাড়াও, ভাস্কর্যগুলো থেকে খসে পড়া টুকরা এবং পাথরের সবচেয়ে উপরের স্তরের ঘনত্বও বিশ্লেষণ করেন তারা।
বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ থেকে প্রাপ্ত ডেটা অনুযায়ী, ভাস্কর্যসমূহ বানানো হয়েছিল ৬ষ্ঠ সহস্রাব্দে, যখন এ অঞ্চলের মানুষ গরু-ছাগল ও ভেড়া চড়াত। বুনো উট ও সমগোত্রীয় অন্যান্য পশুরা এখানে চড়ে বেড়াতো এবং তাদেরকে শিকারও করা হতো। ভাস্কর্যগুলো তৈরিতে পাথুরে সরঞ্জাম ব্যবহৃত হয়েছিল।
গবেষণার লেখকেরা বলেন, ‘এখন আমরা ক্যামেল সাইটকে প্রাগৈতিহাসিক যুগের বলে চিহ্নিত করতে পারি, যেই সময় কিনা উত্তর আরবের চারণভূমির লোকেরা প্রস্তর শিল্প এবং ‘মুস্তাতিল’ নামক বিশালাকৃতির পাথুরে কাঠামো গড়ে তুলেছিল’।
একই ধরনের ত্রিমাত্রিক পাথুরে ভাস্কর্য তুরস্কের বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া গেলেও সৌদি আরবে এটি বিরল।
গবেষণায় বলা হয়েছে, উটের ভাস্কর্যগুলো নিয়ে গবেষণার পর দেখা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন কাজে উটের ব্যবহার আরও আগে হয়েছে, যা ওই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। এ ছাড়া যখন ভাস্কর্যগুলো বানানো হয়, তখন সৌদি আরবের চেহারাও একেবারে ভিন্ন ছিল। সেখানে মরুভূমির চেয়ে হ্রদ ও ঘাসের সমতল ভূমি বেশি ছিল।
তবে কেন এই উটের ভাস্কর্য বানানো হয়েছিল, তা স্পষ্ট নয়। গবেষকেরা মনে করছেন, যাযাবর উপজাতিদের বৈঠকখানা হিসেবে স্থানটি ব্যবহৃত হতো। গবেষকেরা আরও উল্লেখ করেছেন, হাজার হাজার বছর আগে এ রকম ভাস্কর্য বানানো কঠিন কাজ ছিল। অনেক ভাস্কর্য ভূমি থেকে উঁচুতে। তাই ধারণা করা হচ্ছে, এগুলো যারা বানিয়েছিলেন, তাদের মাচা ব্যবহার করতে হয়েছে।
জানা গেছে, সৌদি আরবের উত্তরে আল জওফ প্রদেশে ২০১৬-২০১৭ সালে গবেষণা শুরু করেন সৌদি আরব ও ফ্রান্সের একদল গবেষক। ২০১৮ সালে উটের ভাস্কর্য আবিষ্কার করে তারা জানান, পাথরের খোদাইগুলোতে বিশেষ কারিগরি দক্ষতা রয়েছে। অনেক বছর ধরে এ অঞ্চলে যোগাযোগের জন্য উট ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব ভাস্কর্যে আরবদের নিজস্ব ঐতিহ্যের সঙ্গে নাবাতেয়ান ও পার্থিয়ান প্রভাব থাকতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩৪
আপনার মতামত জানানঃ