অদৃশ্য হয়েও বিশ্ববাসীকে এখনো রীতিমতো শাসন করে যাচ্ছে করোনা ভাইরাস। নারীর ক্ষেত্রে এই ভাইরাস যেন আরো বেশি কঠোর। কোভিড মহামারিতে বিশ্বব্যাপী নারীরা শোষণ ও সহিংসতার স্বীকার হয়েছে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। এখানেই শেষ নয়। কর্মঘণ্টা ও মানসিক চাপ বেড়ে যাওয়া, চাকরি খোয়ানো, আয় কমে যাওয়ার মতো ঘটনাগুলোতো আছেই। ওই সময়ে বাল্যবিয়ে, নারীর মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যঝুঁকিও কিন্তু বেড়েছিল। করোনার প্রভাবে সারা বিশ্বে আর্থিক দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন নারীরা। সব দেশেই করোনার ফলে যে আর্থিক মন্দা তৈরি হয়েছে তাতে পুরুষের তুলনায় নারীরা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ধনকুবের বিল গেটস এবং তার সাবেক স্ত্রী মেলিন্ডা গেটসের দাতব্য সংস্থা গেটস ফাউন্ডেশনের পঞ্চম বার্ষিক গোলকিপার্স প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। আজ মঙ্গলবার প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে।
মেলিন্ডা গেটস বলেন, এমনিতেই বিশ্বের নানা স্থানে নারীরা বিভিন্ন ধরনের বাধার সম্মুখীন হন। করোনা সেই বাধা-বিপত্তিগুলোকে আরও জোরালো করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারাবিশ্বে করোনার প্রভাবে ২০১৯-এর তুলনায় ২০২১ সালে আরও ৩ কোটি ১০ লক্ষ মানুষ চরম দরিদ্রের মুখোমুখি হয়েছেন। তবে আর্থিক দিক থেকে উন্নত ৯০ শতাংশ দেশের নাগরিকের মাথাপিছু আয় করোনা কমলে আগামী বছরের মধ্যে আগের অবস্থায় ফিরলেও নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোর মাত্র এক তৃতীয়াংশ আগের অবস্থায় ফিরতে পারবে।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) পূরণের ক্ষেত্রে করোনা মহামারী কীভাবে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তা তথ্যসহ ব্যাখ্যা করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। এ বছরের প্রতিবেদনে ‘যুগান্তকারী উদ্ভাবন’ এর উপর বেশি আলোচনা করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেভাবে দ্রুততার সঙ্গে বিশ্বব্যাপী করোনার টিকা তৈরি সম্ভব হয়েছে ঠিক সেভাবেই অতিমারির ধাক্কা সার্বিকভাবে কাটিয়ে উঠতে স্বাস্থ্য এবং আর্থিক খাতে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে জাতিসংঘের ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ পূরণের পথে বিশ্বকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। এ ছাড়া গত ১৮ মাসে যে বিষয়গুলোতে আমরা ভাল করেছি, সেগুলোকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তাহলে আমরা অতিমারির ধাক্কা কাটিয়ে স্বাস্থ্য, খাদ্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো মৌলিক বিষয়গুলোর অগ্রগতি বাড়াতে পারব।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, যে দ্রুত গতিতে করোনার টিকা তৈরি করা সম্ভব হয়েছে তা কোনো ‘আশ্চর্য’ ব্যাপার নয়। গত কয়েক দশক ধরে চলমান বিনিয়োগ, টিকা নীতি এবং সহযোগিতার মাধ্যমে যে পরিকাঠামো, পরিবেশ এবং প্রতিভার উন্মেষ ঘটেছে, এটা তারই ফল। তবে করোনা টিকার সুবিধা মূলত রয়েছে বিত্তশালী দেশগুলোতে। ফলে সারা বিশ্বের মানুষ সমানভাবে লাভবান হয়নি।
বিল গেটস বলেন, করোনা টিকার অসমন বণ্টন জনস্বাস্থ্যের জন্য বিপর্যয়। ফলে আগামী দিনে বিত্তশালী দেশগুলোর কাছে করোনা দরিদ্রের রোগ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। এ ছাড়া নির্বিশেষে সকলের কাছে টিকা না পৌঁছানো পর্যন্ত এই অতিমারিকে অগ্রাহ্য করা ঠিক হবে না।
গেটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক সুজম্যান বলেন, নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে প্রয়োজনীয় টিকা এবং ওষুধ তৈরির জন্য সেখানে গবেষক এবং উৎপাদনকারী সংস্থার সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। স্থানীয় সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করলেই তা করা সম্ভব হবে। সারা বিশ্বের উদ্ভাবন এবং প্রতিভাকে একযোগে কাজে লাগানো গেলে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জগুলোও মোকাবেলা করা যাবে।
এলিভেট নেটওয়ার্ক নামের একটি প্রতিষ্ঠান যারা কেবল নারীদের নিয়ে কাজ করে,এর প্রধান নির্বাহী ক্রিষ্টি ওয়ালেস বলেন, ‘একটি পরিবারে নারীদের সাধারণত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মুখ্য বিনোদন কর্মকর্তা ও প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা— এই তিনধরণের কাজই করতে হয়ে। সংকটকালে যখন আমরা কী করব বুঝে উঠতে পারি না আতঙ্কগ্রস্থ ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি তখন এতগুলো ভূমিকা পালন করা নারীদেরর জন্য অসহনীয় হয়ে ওঠে’।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্যের আঞ্চলিক অ্যাডভাইজার ড. নাজনীন আনোয়ার বলেন, ‘করোনার এসময়ে বিশ্বব্যাপী মানসিক রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বিশেষ করে নারীদের মধ্যে। তাদের মধ্যে নানা ধরণের বিষন্নতা তৈরি হচ্ছে। করোনা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে এক ধরণের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিয়ে কাজ করছে’।
অপরপক্ষে একটি মহামারি নারীদের জন্য পৃথিবীকে আরও বৈষম্যমূলক করে তোলে। যদিও এখন রাজনীতিবিদেরা মত দিচ্ছেন যে যেন শুধুই তাৎক্ষণিক সংকটের দিকে মনোযোগ রাখা হয়। কিন্তু মহামারির ইতিহাস বলে, পরবর্তী পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হয়ে ওঠে নারীর জন্য। যেমন, ইবোলা ভাইরাস পশ্চিম আফ্রিকায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশ্লেষকেরা বলেছেন, ইবোলা সংক্রমণ একটু থিতিয়ে আসার পরে পুরুষদের পারিশ্রমিক ঠিকই দ্রুততম সময়ে আগের জায়গায় ফিরে গেলেও নারীদের পারিশ্রমিক মহামারি হওয়ার আগের পর্যায়ে ফিরতে ঢের সময় লেগেছিল এবং এই অবস্থা চলেছিল প্রায় বছরখানেক ধরে। এর বাইরে বেড়ে গিয়েছিল নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা ও যৌন নিপীড়ন ঘটনাও। সাধারণত লকডাউন পরিস্থিতিতে এসব ঘটনা বেশি ঘটতে দেখা গেছে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এবং নারী বিষয়ক সংস্থা ইউএন উইমেনের নতুন উপাত্ত জানাচ্ছে, করোনা ভাইরাসের মহামারির জেরে চরম দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাবে। নারী দরিদ্র হবে অধিক। কাজের সুযোগ, আয়, স্বাস্থ্য, অবৈতনিক শ্রম এবং সহিংসতা— সব দিক দিয়ে নারীর অবস্থান আরও নাজুক ও অসম হবে। তাছাড়া ২০২১সালের মধ্যে বিশ্বে ১ কোটির অধিক মানুষ দারিদ্র হবে আর এই মানুষগুলোর প্রায় অর্ধেকেই থাকবে নারী ও মেয়ে শিশু। চরম দরিদ্র নারীর মোট সংখ্যা হবে ৪ কোটি ৫০লাখ। গৃহস্থালির কর্মসহ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষেত্রগুলোতে নারীকর্মী বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, কোভিড-১৯ কারণে সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতিতে নারী-পুরুষের মাঝে থাকা বৈষম্যকে আরও প্রকট করেছে। অর্জন যতটুকু হয়েছে তা হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা আছে। এমতাবস্থায় তাদের অর্থনীতিমুখী করে স্রোতে ফিরেয়ে আনা জরুরি মনে করছেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫২
আপনার মতামত জানানঃ