দেশের মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীদের ওপর যৌন নির্যাতনের খবরে শিউরে উঠছে সারা দেশ। যদিও মাদ্রাসাগুলোতে ক্রমবর্ধমান এই ধর্ষণ নিয়ে মাথাব্যথা নেই সরকারের। দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও সরব নয়। নেই বার্ষিক কোন প্রতিবেদন। তাই এই সব নির্যাতনের প্রকৃত চিত্র থেকে যাচ্ছে অজানা।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের পর শিক্ষার্থীরা লজ্জা, ভয়, নানান কিছুর কারণে তা প্রকাশ করে না। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে সবথেকে কম কথা বলা হয়। এর কারণ হয়তো সেক্স, অপ্রাপ্তবয়স্ক ভুক্তভোগী এবং ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে মানুষের অন্ধবিশ্বাস।
এরই ধারাবাহিকতায় এবার মাদারীপুরে লুঙ্গি দিয়ে ক্লোজ সার্কিট (সিসি) টিভি ক্যামেরা ঢেকে চার শিক্ষার্থীকে বেধড়ক পেটানোর অভিযোগ উঠেছে এক মাদ্রাসা শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
শাহ্ মাদার দরগা শরীফ মাদ্রাসার শিক্ষক বেলাল হোসাইন গতকাল শুক্রবার আসরের নামাজের পর তাদের মারধর করেন বলে অভিযোগ। বেধড়ক পিটুনি থেকে বাঁচতে ওই সময় দুই শিক্ষার্থী পালিয়ে বাড়ি চলে যায়।
মারধরের শিকার চার শিক্ষার্থী হলো ডাসার উপজেলার পশ্চিম বোথলা গ্রামের শাহাদাৎ বেপারীর ১০ বছরের ছেলে আসিফ বেপারী, আয়নাল বেপারীর ১২ বছরের ছেলে সাকিব মোল্লা, রাজার চরের রাজু ও কালকিনি উপজেলার খাসের হাট গ্রামের সাইফুল। তারা সবাই মাদ্রাসার প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
শিশু শিক্ষার্থী আসিফ বেপারী বলে, ‘অহেতুক হুজুর আমাকে মেরেছেন। কুচকিতে ঘাঁ হওয়ায় আমি অসুস্থ ছিলাম। এজন্য আসরের নামাজ পড়তে পারেনি। তাই হুজুর সিসি ক্যামেরা লুঙ্গি দিয়ে ঢেকে চারজনকে বেধড়ক পেটায়।’
সে আরও বলে, ‘আমার হাত ও পিঠে দাগ হয়ে গেছে। হুজুর আমাদের হুমকি দেন যে, আমাদের মতো দুই-একজনকে মেরে দরকার হয় তিনি জেলে যাবেন।’
আসিফের বাবা শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ‘এভাবে যদি মাদ্রাসায় ছাত্রদের মারধরের শিকার হতে হয় তাহলে আর আমাদের ছেলে-মেয়েদের ভর্তি করব না।’
এ বিষয়ে মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সাধারণ সম্পাদক আল আমিন বলেন, ‘এটা একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। অভিযুক্ত শিক্ষক বেলাল হোসাইন বর্তমানে পলাতক।’ মারধরের সময় সিসিটিভি ক্যামেরা ঢেকে রাখার তথ্যও নিশ্চিত করেছেন তিনি।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল হোসেন মিঞা বলেন, ‘বিষয়টি আমি এখনও জানি না। যদি কেউ লিখিত অভিযোগ করে, তাহলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
দেশে বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিশু শিক্ষার্থীদের মারধরের ঘটনা নতুন নয়। প্রায়শ মাদ্রাসার শিক্ষকদের বিরুদ্ধে তুচ্ছ কারণে শিক্ষার্থীদের মারধরের অভিযোগ ওঠে।
শিশু শিক্ষার্থীদের উপর মাদ্রাসা শিক্ষকদের চালানো নির্মম নির্যাতনের একাধিক ভিডিও ফেসবুকে ভাইরালও হয়েছে। একাধিক শিক্ষককে কারাগারেও পাঠিয়েছে আদালত।
এই বছরের মার্চে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় একটি মাদ্রাসায় এক শিশুকে বেদম পিটুনির ভিডিও ভাইরাল হয়। পরে ওই শিক্ষককে আটক করা হয়। এর পরপরই সাতকানিয়ার একটি মাদ্রাসায় চার শিক্ষার্থীকে নির্মমভাবে পেটানো হয়। এই ঘটনায় নাম আসা শিক্ষকেও কারাগারে পাঠানো হয়। গত ১০ আগস্ট ঝালকাঠি সদর উপজেলার একটি মাদ্রাসায় ১০ ছাত্রকে বেত্রাঘাত করেন এক শিক্ষক।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী গত বছর (২০২০) সারাদেশে এক হাজার ৭৪১টি শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে৷ এরমধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের হাতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১২৫টি শিশু৷ এইসব ঘটনায় মোট মামলা হয়েছে মাত্র আটটি৷ এই সময়ে শিক্ষকদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ১৪ জন শিক্ষার্থী৷ ছেলে শিশুরাও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে৷
বিশেষজ্ঞের মতামত
জাতীয় মাননিসক স্বাস্থ্য ইন্সটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ জানান করোনার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ৷ কিন্তু স্বাভাবিক সময়ে তার চেম্বারে প্রতি মাসে ১০-১২টি শিশুকে তার অভিভাবকেরা নিয়ে আসেন৷ যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার৷ আর এখন মাদ্রাসা খোলা থাকায় সেখান থেকেও শিশুদের নিয়ে আসা হয়৷
তিনি বলেন, ‘‘আমার অভিজ্ঞতা হলো মাদ্রাসায় শারীরিক নির্যাতন বেশি হয়৷ আর বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে মানসিক নির্যাতন বেশি হয়৷ ভাবার কোনো কারণ নেই যে মাদ্রাসার বাইরে নির্যাতন হয় না৷’’
তিনি জানান, মাদ্রাসায় যেমন যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটে বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষকদের দ্বারা বুলিং-এর শিকার হন শিক্ষার্থীরা৷ তার অভিজ্ঞতা বলছে, গড় হিসেবে সব ধরনের নির্যাতন মিলিয়ে মাদ্রাসায় ৬০ ভাগ আর বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ৪০ ভাগ ঘটনা ঘটে৷
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘এই দুই ধরনের নির্যাতনের ফলে প্রথমত, শিশুদের ওপর প্রচণ্ড মানসিক চাপ পড়ে৷ তারা বিষন্নতা উদ্বেগ ও আতঙ্কের মধ্যে থাকে৷ মানসিক বিকাশ বাধা পায়৷ তারা স্কুল ও লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে৷ আর দীর্ঘ মেয়াদে তারা নেতিবাচক মানসিকতা নিয়ে বড় হয়৷ ব্যক্তিত্বের বিকাশ হয় না৷ হীনমন্যতায় ভোগে৷ আবার সে নিজেও বড় হয়ে নিপীড়ক ও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে৷’’
আইন কী বলছে?
বাংলাদেশের আইনে ছাত্রদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেয়া দণ্ডনীয় অপরাধ৷ ২০১১ সালে হাইকোর্টের এক আদেশের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি বন্ধে নীতিমালা প্রণয়ন করে৷ আর তাতে শারীরিক ও মানসিক শাস্তির সংজ্ঞাও দেয়া হয়েছে৷
শারীরিক শাস্তি বলতে যেকোনো ধরনের দৈহিক আঘাত বলা হয়েছে৷ মারধর ছাড়াও আইনে কান ধরা, চুল টানা, বেঞ্চের নিচে মাথা রাখতে বাধ্য করাও দৈহিক শাস্তি৷ আর মানসিক শাস্তির মধ্যে শিশু বা তার পরিবারকে উদ্দেশ্য করে বাজে মন্তব্য বা যেকেনো আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি৷
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই দুই ধরনের শাস্তি দেয়াকেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলেছে৷ যাদের বিরুদ্ধে এই অপরাধ প্রমাণ হবে তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে৷ একই সঙ্গে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে৷
কিন্তু এরপরও বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেয়ার প্রবণতা বেশ লক্ষ্য করা যায়৷ বিশেষ করে মাদ্রাসায় এটা প্রকট৷
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিভিন্ন সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে, মাদ্রাসাগুলোতে প্রায়ই মারধর ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। আর এদের বেশির ভাগই সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশ থেকে আসা। সাধারণ শিক্ষার ব্যয় বহন করতে না পেরে অনেক অভিভাবকই সন্তানদের মাদ্রাসায় পাঠিয়ে থাকেন। আবার ধর্মীয় চেতনা থেকেও শিক্ষার্থীদের মাদ্রাসায় পাঠানো হয়। তাই সমস্যাটিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করার আগেই।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২০২৭
আপনার মতামত জানানঃ