ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নিজেদের বক্তব্য থেকে বারবার সরে আসতে দেখা গেছে তালিবানকে। কাশ্মীর নিয়েও এর ব্যতিক্রম হয়নি। কাবুল দখলের পর তালিবান মুখপাত্র জবিউল্লা মুজাহিদ জানিয়েছিলেন, আফগানিস্তানের মাটি ভারত বা অন্য কোনও দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। তবে নিজেদের এই অবস্থান থেকে সরে আসতে শুরু করেছে তালিবান।
গতকাল বৃহস্পতিবার তালিবানের আর এক মুখপাত্র সুহেল শাহিন বলেন, ‘‘মুসলিম হিসেবে আমাদের কাশ্মীরের মুসলিমদের পক্ষে আওয়াজ তোলার অধিকার রয়েছে।’’
পাশাপাশি শাহিন আরও জানান, কেবল ভারত নয়, বিশ্বের যে কোনও দেশের মুসলিমদের পক্ষে তালিবান সক্রিয় হতে পারে।
সময়ের সাথে যেন নব্বইয়ের দশকে তৎকালীন তালিবানের রূপ নিচ্ছে আজকের এই তালিবান। ওই সময়ের প্রধান মোল্লা মহম্মদ ওমরের অনুচরেরাও এই একই সুরেই কথা বলতেন। জইশ-ই-মহম্মদ, লস্কর-ই-তৈবার মতো কাশ্মীরে সক্রিয় পাক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর পক্ষে কথা বলতো।
এই পরিস্থিতিতে নতুন করে কাশ্মীরের অশান্তির সম্ভাবনা দেখছে নয়াদিল্লি। কাশ্মীর নিয়ে তালিবানের এমন অবস্থান বদলের নেপথ্যে তাদের সহযোগী আল কায়দার ভূমিকা দেখছেন অনেকে। মঙ্গলবার কাশ্মীরকে ‘ইসলামের শত্রু’-দের কবল থেকে মুক্ত করার ডাক দিয়েছিল আল কায়দা। এই পরিস্থিতিতে আশঙ্কা করা হচ্ছে, নিরাপত্তা যতই আঁটোসাটো করা হোক, জঙ্গি-সন্ত্রাস বাড়বে এই উপত্যকায়।
আফগানিস্তানে তালিবানের ক্ষমতা দখলের পরে কাশ্মীরের যুবকদের একাংশ নতুন করে সশস্ত্র জঙ্গি কার্যকলাপে উৎসাহী হয়েছে বলে সম্প্রতি ভারতের একটি গোয়েন্দা রিপোর্ট জানাচ্ছে। সেখানে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখায় জঙ্গিদের লঞ্চিং প্যাডগুলিতে নতুন করে সক্রিয়তা দেখা যাওয়ার কথা বলা হয়েছে।
দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানাচ্ছে, এই মুহূর্তে অন্তত তিনশো জঙ্গি বিভিন্ন লঞ্চিং প্যাডে ভারতে ঢোকার অপেক্ষায় রয়েছে।
আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের কথায়, ভারতের জম্মু-কাশ্মীরে নাশকতামূলক কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে লস্কর-ই-তৈবা। আর লস্কর-ই-তৈবার নাশকতামূলক কাজকর্মে মদত দিচ্ছে পাকিস্তান। আবার আফগানিস্তানের বেশ কিছু অঞ্চলে ঘাঁটি তৈরি করেছে এই লস্কর-ই-তৈবা। সেখানেও তালিবানরা মদত দিচ্ছে লস্কর-ই-তৈবার নাশকতামূলক কাজকর্মে।
জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈবা, লস্কর-ই-ঝাংভি আফগানিস্তানে কিছুটা হলেও সক্রিয়। এএনআই-এর খবর অনুযায়ী, এই জঙ্গি সংগঠনগুলো তালিবানদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাবুলের একাংশ এবং বেশ কয়েকটি গ্রামাঞ্চলে চেকপোস্ট তৈরি করেছে বেশ আগেই।
এর আগে আফগানিস্তান নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গনি সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানোর পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে তালিবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেন, ‘বিশ বছর আগেও আমাদের দেশ মুসলিম রাষ্ট্র ছিল। আজও আমাদের দেশ মুসলিম রাষ্ট্র।’
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে তালিবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেছিলেন, ‘দীর্ঘ ২০ বছর সংগ্রামের পর আমরা দেশকে মুক্ত করেছি ও বিদেশিদের তাড়িয়ে দিয়েছি। এটা পুরো জাতির জন্য গর্বের মুহূর্ত। আমরা বিদেশি কিংবা অভ্যন্তরীণ শত্রু চাই না।’
পাশাপাশি জানায়, কাশ্মীরের দিকে নজর নেই তালিবানের। তাদের মতে, কাশ্মীর দ্বিপাক্ষিক ও অভ্যন্তরীণ বিষয়। ফলে আশা করা হচ্ছে কাশ্মীরের দিকে নজর দেবে না তালিবান।
তবে আফগানিস্তান তালিবানের দখলে চলে যাওয়ার ফলে কাশ্মীরের ওপর ঘনাতে শুরু করে উদ্বেগের মেঘ। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, তালিবানের সঙ্গে জইশ-ই-মহম্মদ এবং লস্কর-ই-তৈবার মতো জঙ্গি সংগঠনের যোগ অত্যন্ত পরিষ্কার। আর এই দুটি জঙ্গি সংগঠনেরই টার্গেট কাশ্মীর। তাহলে এবার তালিবানের সাহায্য নিয়ে মাসুদ আজহার এবং হাফিজ সঈদের জঙ্গি সংগঠন কাশ্মীরে নতুন করে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করবে কিনা এই প্রশ্ন আলোচনায় উঠে আসছে বারবার।
সূত্র মতে, তালিবান মূলত দুভাবে রিক্রুট করে। একটা অংশ ভাড়াটে জঙ্গি। আরেকটা অংশ ধর্মীয় কট্টরপন্থী। ১৯৯৬ সালে তালিবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় বসার পর কাশ্মীরে ভাড়াটে জঙ্গিদের অনুপ্রবেশ এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়ে যায়। এবারও তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।
কাশ্মিরের উপর তালিবানের আগ্রহ নেই এমন বক্তব্য প্রথমে সামনে আসলেও বিশেষজ্ঞরা এর উল্টোটাই আশঙ্কা করছিলেন। গতকাল বৃহস্পতিবার তালিবানরা বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কাকেই সত্যে রূপান্তিত করে উদ্বিগ্ন করে তুললেন তাদের। বিশ্বজুড়ে জঙ্গিরা আবারও শক্তিশালী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা এখন আরও প্রবল হয়ে উঠছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬৫৩
আপনার মতামত জানানঃ