দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নৃশংসতা ততোদিনে চাপা পড়ে গেছে শান্তি আলোচনার টেবিলে চার পায়ার নিচে। কিন্তু ক্ষমতার গদি ততোদিনে যুদ্ধ আর হত্যার আনন্দ বুঝে গেছে। আর তাই শান্তির পায়রার গলা এবার টিপে ধরে যুগোস্লোভিয়া। যুগোস্লোভিয়ার রাষ্ট্রনায়ক মার্শাল টিটোর মৃত্যুর পর দেশটি বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর মাধ্যমে সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, মেসিডোনিয়া, বসনিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
এরপর ভিন্ন জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে বিরোধ দেখা দেয়। আঞ্চলিক নেতারা সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে এক নৃশংস গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ওই অঞ্চল। ১৯৯১ সালে শুরু হওয়া এই গৃহযুদ্ধ চলে কয়েক বছর জুড়ে। যুদ্ধে গণহত্যার বর্বর ইতিহাস রচনা করেন তিন খলনায়ক; তারা হলেন স্লোবোদান মিলোসেভিচ, রাদোভান কারাদজিচ এবং রাতকো ম্লাদিচ।
স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যা ঘটেছিল ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে; বলকান গৃহযুদ্ধের সময়। বসনিয়ার সার্ব সৈন্যরা যখন জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী কর্তৃক নিরাপদ এলাকা বলে ঘোষণা করা স্রেব্রেনিৎসা শহর ও তার আশপাশের এলাকা দখল করে নিল, তখনই ঘটেছিল ভয়াবহ সেই গণহত্যা।
১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে বসনিয়ার স্রেব্রেনিৎসা শহরে সাবেক বসনিয়ান সার্ব কমান্ডার রাতকো ম্লাদিচের নির্দেশে এই বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটে৷ উগ্র রাষ্ট্রপ্রধান কারাদজিচ এবং মিলোসেভিচের সবচেয়ে বড় মিত্র ছিলেন বসনিয়া যুদ্ধে বসনিয়া-সার্ব সামরিক অধিনায়ক রাতকো ম্লাদিচ। তিনি নিজে আগ্রাসনের রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের মাটিতে ঘটা সবচেয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ড বলে পরিচিত এটি৷
১৯৯০ এর দশকের শুরুতে বলকান যুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন একটানা তিন বছর আট মাস ধরে বসনিয়ার সারায়েভো ছিল এক অবরুদ্ধ শহর। শহরটি ছিল প্রধানত বসনিয়াক মুসলিম অধ্যূষিত। চারপাশের পাহাড়ের আড়াল থেকে যখন সার্বিয়ান বন্দুকধারীরা গোলাগুলি শুরু করলো, শহরের মুসলিম বাসিন্দারা তখন নিজেদের শহরেই জিম্মি হয়ে পড়লেন।
সারায়েভো ধেকে ৮০ কিলোমিটার দূরের শহর স্রেব্রেনিৎসা। ওই এলাকার হাজার হাজার বেসামরিক লোকের সাথে মুসলিম যোদ্ধারাও ছিল। আর ওই এলাকাটি ঘিরে ছিল বসনিয়ান সার্ব বাহিনী; যাদের নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল রাতকো ম্লাদিচ।
সার্ব বাহিনীর সাথে অস্ত্রের শক্তিতে সেখানকার ডাচ শান্তিরক্ষীদের কোনভাবেই পেরে ওঠা সম্ভব ছিল না। জুলাই মাসের প্রথম দিকে ডাচ সৈন্যদেরকে তাদের নিয়ন্ত্রিত একটা ফাঁড়ি থেকে পিছিয়ে আসতে হয়। এর ফলে মুসলিম যোদ্ধারা শান্তিরক্ষীদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের ওপর গ্রেনেড ছোঁড়ে; তাতে একজন ডাচ নিহত হলো।
এর কিছু পরই ৩০ জন ডাচ শান্তিরক্ষী সার্বদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে তাদের জিম্মি করা হয়। জুলাই মাসের ১১ তারিখে ডাচ শান্তিরক্ষীরা সার্ব অবস্থানগুলোর ওপর ব্যাপক বিমান আক্রমণ চালানোর জন্য ন্যাটোকে অনুরোধ জানায়। তবে বোমা ফেলা হয় মাত্র দু’টো। কারণ তখন সার্বরা ডাচ জিম্মিদের হত্যা করার হুমকি দেয়। এরপর আর বিমান আক্রমণ চালানো হয়নি
এর কয়েকঘন্টা পরই সার্ব বাহিনীর হাতে স্রেব্রেনিৎসার পতনের খবর বিশ্ববাসী জানতে পায়। এরপরই শুরু হয় গণহত্যা। বসনিয়ান সার্বরা মুসলিম পুরুষ ও বালকদের ধরে নিয়ে যেতে শুরু করে। মোট ৮ হাজার লোককে তারা হত্যা করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে এত বড় গণহত্যা আর হয় নি। তবে বসনিয়ার যুদ্ধে ছিল আরও একটি পক্ষ, এই ত্রিমুখী লড়াইয়ে সার্বিয়ান এবং মুসলিমরা ছাড়াও জড়িয়ে পড়েছিল ক্রোয়েশিয়ানরা।
১৯৯৫ সালে স্রেব্রেনিৎসায় আট হাজার মুসলিমকে হত্যা করা ছিল সেই যুদ্ধের সবচেয়ে নারকীয় হত্যাকান্ড। মুসলিম পুরুষ এবং বালকদের বেছে বেছে আলাদা করে হত্যা করা হয়, তারপর তাদের গণকবর দেয়া হয়।
জেনারেল রাতকো ম্লাদিচের নেতৃত্বে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যেখানে এই অভিযান চালানো হয়, সেটি ছিল জাতিসংঘের ঘোষিত নিরাপদ অঞ্চল। সেখানে সার্বরা বেসামরিক বসনিয় পুরুষ ও কিশোরদের নারীদের থেকে আলাদা করে ফেলে। এসময় নারী ও কন্যা শিশুদের জোরপূর্বক বাসে তুলে বসনিয়-নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়।
গণ স্থানান্তরের এই সময়টা ছিল ভয়াবহ। তখন বসনিয় নারীদের বেশিরভাগ ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ণের শিকার হন। পেছনে রয়ে যাওয়া পুরুষ ও ছেলে শিশুদের উপর ব্রাশ ফায়ার করে তাৎক্ষণিকভাবে মেরে ফেলা হয়। অনেককে ধরে বধ্যভূমির দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। ধারণা করা হয় সেদিন সার্বদের হাতে মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে খুন হয়েছিলেন প্রায় ৮ হাজার বসনিয় পুরুষ ও ছেলেশিশু।
১১ জুলাই, ১৯৯৫ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত স্রেব্রেনিৎসায় মোট ৮,৩৭২ জনকে বসনিয়াক মুসলিমকে হত্যা করা হয়। এদের বেশিরভাগই ছিল পুরুষ ও ছেলেশিশু। সার্বদের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে যেন এরা লড়াই করতে না পারে সেজন্য এই কাজ করেছিলেন জেনারেল রাতকো ম্লাদিচ। এই গণহত্যার মূল লক্ষ্য ছিল স্রেব্রেনিৎসা থেকে নন-সার্ব জাতিদের পুরোপুরি বিতাড়িত করা। ফলে প্রায় ২০ হাজার বসনিয়াক মুসলিম নারী এবং কন্যা শিশুকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। এছাড়া বহুসংখ্যক মানুষকে গ্রেফতার করা হয়। সার্ব সেনারা বসনিয়ান মুসলিম এবং ক্রোট নারীদের ধর্ষণ করার মতো ঘৃণ্য অপরাধেও লিপ্ত হয়। ম্লাদিচের নির্দেশে হাজার হাজার ক্রোট এবং মুসলিম নাগরিককে বন্দী করা হয়।
ইতিহাসের অন্যতম জঘণ্য স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যায় ৮ হাজার মুসলিমকে নির্বিচারে হত্যা করে সার্ব বাহিনী। হত্যার পর স্রেব্রেনিৎসার নানা জায়গায় গণকবর দেয়া হয়। নিহতদের মধ্যে এখনো ১ হাজার মানুষের মরদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২০৫২
আপনার মতামত জানানঃ