বর্তমানে সমুদ্রের পানিতে ঘুরে বেড়ানো তিমির প্রাচীন এক উভচর পূর্বপুরুষের সন্ধান সম্প্রতি পেয়েছেন জীবাশ্মবিদরা। এই আবিষ্কারের ফলে স্থল থেকে সমুদ্রে স্তন্যপায়ীদের বিবর্তনের একটি নতুন চিত্র পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তিমির এই নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করেছেন মিশরের বিজ্ঞানীরা। প্রায় ৪.৩ কোটি বছর আগে সমুদ্রে দাপিয়ে বেড়াতো এই প্রাচীন প্রজাতির তিমি। এদের বিশেষত্ব ছিল চারটি পা! এই উভচর তিমির জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়েছে মিশরের পশ্চিম মরুভূমিতে।
প্রাচীন মিশরের মৃত্যুর দেবতা অ্যানুবিসের সঙ্গে এই তিমির মাথার খুলির সাদৃশ্য থাকায় এর নামকরণও করা হয়েছে অ্যানুবিসের নামে; ‘ফিওমিসেটাস অ্যানুবিস’।
গত বুধবার প্রসিডিংস অব দ্য রয়েল সোসাইটি বি প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে, শিকার ধরার জন্য এই তিমির ছিল আনুমানিক ৬০০ কেজি ওজনের ও তিন মিটার (১০ ফুট) দৈর্ঘ্যের ফিওমিসেটাস অ্যানুবিসের শক্ত চোয়াল। এই তিমির ভূমিতে হাঁটতে ও পানিতে সাঁতার কাটতে পারত।
আংশিক কঙ্কালটি মিশরের ফায়ুম খাদে পাওয়া গেছে। মনসৌরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা সেটিকে বিশ্লেষণ করেছেন। এলাকাটি এখন মরুভূমি হলেও একসময় সেখানে সুবিশাল সমুদ্র ছিল এবং বর্তমানে এই অঞ্চল সামুদ্রিক জীবাশ্মের একটি সমৃদ্ধ উৎস।
গবেষণার প্রধান লেখক আবদুল্লাহ গোহার রয়টার্সকে বলেন, ‘ফিওমিসেটাস অ্যানুবিস তিমির একটি নতুন প্রজাতি, এবং মিশরীয় ও আফ্রিকান প্যালিওন্টোলজির জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার।’
বলে রাখা ভালো, পা আছে এমন তিমির জীবাশ্ম এই প্রথম পাওয়া যায়নি। তবে ফিওমিসেটাস অ্যানুবিস আফ্রিকাতে আবিষ্কৃত আধা-জলজ তিমিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এর আগে পেরুতে চার পেয়ে তিমির একটি জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়েছে, যেটিও চার কোটি ৩০ লাখ বছর আগের বলে জানান বিজ্ঞানীরা। পেরুর প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলীয় এলাকায় ২০১১ সালে এই তিমিটির জীবাশ্মের সন্ধান পাওয়া যায়।
পেরু, ফ্রান্স, ইতালি ও নেদারল্যান্ডসের একদল জীবাশ্ম বিশেষজ্ঞ এ তিমিটি আবিষ্কার করেন। তারা এর নাম দেন ‘পেরেগোসেটাস প্যাসিফিকাস’, যার অর্থ ‘ভ্রমণকারী তিমি যে প্রশান্ত মহাসাগরে পৌঁছেছে’।
জীবাশ্ম বিশেষজ্ঞরা জানান, চার মিটার দীর্ঘ এ তিমি সাঁতারের পাশাপাশি ডাঙায় হাঁটতে পারত। এ স্তন্যপায়ী প্রাণীর পায়ে আঙুল ও নখ ছিল। মূলত চার পা এদের ভারী দেহ বহন করত। প্রাচীন এ তিমির একটি শক্তিশালী লেজের অস্তিত্ব মিলেছে। এ আধাজলজ প্রাণীকে ভোঁদর বা বিভারের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।
গবেষকদের ধারণা, প্রায় পাঁচ কোটি বছর আগে দক্ষিণ এশিয়াতে তিমির প্রথম বিকাশ হয়। ধীরে ধীরে তাদের দেহ সাঁতারের জন্য উপযোগী হয়ে ওঠে। এরপর তাদের আবাস উত্তর আফ্রিকা ও উত্তর আমেরিকাতে বিস্তৃত হয়। শুরুর দিকে দক্ষিণ আমেরিকাতেও যে তিমি সাঁতার কাটত, তা এই চার পেয়ে তিমি আবিষ্কারের পর আরো পরিষ্কার হচ্ছে।
লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের প্রাচীন তিমি বিষয়ক গবেষক ত্রাভিস পার্ক বলেন, ‘তিমি হলো বিবর্তনের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী থেকে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে তারা আজকের নীল তিমিতে রূপান্তরিত হয়েছে। তারা যেভাবে মহাসাগর জয় করেছে, তা খুবই কৌতূহল জোগায়।’
ধারণা করা হয়, আধুনিক তিমির পূর্বপুরুষরা হরিণের মতো স্তন্যপায়ী প্রাণী থেকে বিকশিত হয়েছিল, যা প্রায় ১ কোটি বছর ধরে মাটিতে বসবাস করেছে।
২০১১ সালে একদল বিজ্ঞানী আকার ও জীবাশ্মের বয়সের ভিত্তিতে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের বিবর্তনের সর্বোচ্চ হার নির্ধারণে কম্পিউটেশন পদ্ধতিতে গবেষণা করে জানান, ৩৮.৮ মিলিয়ন বছর আগে তিমির প্রথম উদ্ভব দন্ত তিমি থেকে।
প্রায় পাঁচ মিলিয়ন প্রজন্ম ধরে তিমিরা তাদের শরীর বাড়াতে ৫ হাজার বার বিবর্তিত হয়েছে। তাই প্রাগৈতিহাসিক তিমি বর্গের সদস্যরা নীল তিমির মতো আধুনিক প্রজাতির অনুরূপ ছিল না।
২০১৬ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত সমীক্ষা অনুসারে, এ আন্তবর্গের সাম্প্রতিকতম সাধারণ পূর্বপুরুষদের দৈর্ঘ্য মাত্র ৫ মিটার পর্যন্ত ছিল।
গবেষক দলটির প্রধান অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী অ্যালিস্টেয়ার ইভান্স বলেন, ‘দু’টি প্রধান কারণে তিমি অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের তুলনায় দ্রুততম সময়ে বড় আকার ধারণ করতে পেরেছে।’
‘প্রথমত, জলে বাস করে বলে তাদেরকে নিজের শরীরের ওজন বহন করতে হয় না। সেখানকার অনেক পানি স্থলের তুলনায় একটি বড় শরীরের ওপর কম চাপ অনুভব করায়। পদার্থবিদ্যা এখানে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে’।
‘দ্বিতীয়ত, তিমির ওপরের চোয়ালের (টাকরা) হাড় মুখ থেকে খুঁজে খুঁজে সমুদ্রের অতি ক্ষুদ্র জীবাণু পর্যন্ত পরিশোধন করে ফেলে’।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫১৮
আপনার মতামত জানানঃ