দাবানল, দাবদাহ, খরা, বন্যা, মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও ঘূর্ণিঝড়ে বিশ্ব এখন বিপর্যস্ত। অঞ্চলভেদে বিভিন্ন দেশে এসব দুর্যোগ দেখা যাচ্ছে। চীন, ভারত ও জার্মানিতে চলতি মৌসুমে কয়েক দফা বন্যা, ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র স্মরণকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার মুখে পড়েছে। গ্রিস, তুরস্ক, ইতালিসহ দক্ষিণ ইউরোপ পুড়ছে দাবানলে। বেলজিয়ামসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ রেকর্ড বৃষ্টিপাত দেখেছে। ব্রাজিল, মাদাগাস্কারসহ গোটা আফ্রিকা খরায় বিপর্যস্ত। জলবায়ুর এমন চরম বৈরিতার মুখে বিশ্ব।
জলবায়ু পরিবর্তনের এই হিংস্র থাবা থেকে বাদ যায়নি ফ্রান্স, ইসরায়েল ও হাইতি। তুরস্ক, গ্রিস, ইতালির পর এবার ফ্রান্স ইসরায়েলও ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে দাবানল। শুকনো গরম ও প্রবল হাওয়ায় দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে বিস্তৃণ এলাকায়। এদিকে হাইতিতে ভয়াবহ ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
ফ্রান্সে ভয়াবহ দাবানল
সোমবার সন্ধ্যা থেকে ভয়াবহ দাবানলে দক্ষিণ ফ্রান্সের ৪০ কিলোমিটার বনভূমি জ্বলছে। স্থানীয় ছয় হাজারের মতো বাসিন্দা ও পর্যটককে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেয়া হয়েছে। আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে ৭০০টি দমকল বাহিনী। খবর ডয়েচে ভেলে
বনভূমিতে আগুন খুব দ্রুত ছড়াচ্ছে। দমকল বিভাগের মুখপাত্র জানিয়েছেন, কোনো ঝুঁকি না নিয়ে ছয় হাজার মানুষকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তবে দাবানলের কারণে এখন পর্যন্ত মারা যাননি বা গুরুতর আহত হননি।
স্থানীয় মেয়র বলছেন, ‘আগুন এত দ্রুত ছড়াতে কখনো দেখিনি। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়েছে। সাথে প্রবল হাওয়া বইছে। তাতে দ্রুত দাবানল ছড়াচ্ছে। বিমান থেকে পানি ফেলেও পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাচ্ছে না।’
আবহাওয়া অফিস বলছে, আগামী কয়েকদিন এইরকম আবহাওয়াই থাকবে। ফলে দাবানল আরো ছড়িয়ে পড়তে পারে।
প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলির মধ্যে ফ্রান্স সর্বশেষ দাবানল দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। সোমবার ভূমধ্যসাগরীয় দেশটির শহর টুলন থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার (৬০ মাইল) দূরে সৃষ্ট দাবানল ৭৫ টি জায়গায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত দাবানলে ইতোমধ্যে ৩ হাজার ৫০০ হেক্টর (৮ হাজার ৬০০ একর) বন ও ঝোপের জমি একেবারে পুড়ে যায়। সেন্ট-ট্রোপেজ এবং লে মোল এবং গ্রিমাউড গ্রাম ও তার আশেপাশে বসবাসরত লোকজনকে নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তর করা হয়েছে।
ইসরায়েলে দাবানল
ভয়াবহ দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে ইসরায়েলে। অধিকৃত জেরুজালেমের পশ্চিমে বিশাল জঙ্গলে এই দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে। দাবানল নেভাতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে তারা। আগুন এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে যে আগুন নেভাতে আন্তর্জাতিক সহায়তার আর্জি জানিয়েছে ইসরায়েল। খবর রয়টার্সের
আগুন নেভানোর জন্য ইসরায়েল ওই এলাকায় অন্তত ১১০টি অগ্নিনির্বাপক দল নিয়োগ করেছে। এর পাশাপাশি আটটি বিমান আগুন নেভানোর কাজে ব্যস্ত রয়েছে।
রোববার এই অগ্নিকাণ্ড শুরু হয় ও তিন দিনের প্রচেষ্টায় ইসরায়েল এখন পর্যন্ত আগুন নেভাতে সক্ষম হয়নি। দাবানলে এরই মধ্যে জঙ্গলের বিশাল এলাকা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে এবং বেশ কয়েকটি কমিউনিটি মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।
১৯৪৮ সালের পর এ পর্যন্ত যে কয়টি বড় দাবানলের ঘটনা ঘটেছে এটি তার মধ্যে অন্যতম। আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। অগ্নিকাণ্ড থেকে সৃষ্ট কালো ধোঁয়ায় জেরুজালেম শহর ঢেকে গেছে।
গত সোমবার আগুন নেভানোর জন্য সহযোগিতা চেয়ে গ্রিসকে অনুরোধ জানিয়েছে ইসরায়েল। এছাড়াও ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়ায়ির লাপিদ জানিয়েছেন, তিনি সম্ভাব্য সহযোগিতার জন্য সাইপ্রাস, ইতালি ও ফ্রান্সকে অনুরোধ করেছেন।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিওর হাইয়াত জানান, গ্রিস ও সাইপ্রাস দমকলকর্মী পাঠাতে রাজি হয়েছে।
বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু সংকটের সরাসরি প্রভাবে মনুষ্য বসতির কাছাকাছি এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের উদ্ভব হচ্ছে। মূলত বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
ইসরায়েলের অগ্নিকাণ্ড ও উদ্ধার বিভাগের প্রধান দেদি সিমচি জানান, অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানতে তদন্তকারীরা কাজ করছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণে এই অগ্নিকাণ্ড শুরু হয়েছে।
এরই মধ্যে ওই এলাকার বহু লোকজনকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমে ইসরায়েলসহ ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী দেশ আলজেরিয়া, সাইপ্রাস ও তুরস্কে ভয়াবহ দাবানল ছড়িয়ে পড়ে।
হাইতিতে ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা বাড়ছেই
হাইতিতে ভয়াবহ ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১ হাজার ৯৪১ জনে দাঁড়িয়েছে। অসংখ্য মানুষ নিখোঁজ থাকায় এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বুধবার দেশটির সিভিল প্রটেকশন এজেন্সির বরাত দিয়ে খবর প্রকাশ করেছে রয়টার্স।
প্রতিবেদনে বলা হয়, হাইতির স্থানীয় সময় গত শনিবার সকালে (১৪ আগস্ট) এই ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিলো ৭ দশমিক ২। শক্তিশালী ভূমিকম্পে বাড়ি, গির্জা, হোটেলসহ অনেক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, হাইতির সেন্ট লুইস দু সুদ শহরের ১২ কিলোমিটার দূরে ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে ভূমিকম্পের উৎপত্তি। এ জায়গাটি রাজধানী পোর্ট–অ–প্রিন্স থেকে ১৫০ কিলোমিটার পশ্চিমে। পোর্ট–অ–প্রিন্সেও কম্পন অনুভূত হয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোতেও ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে।
ক্যারিবীয় অঞ্চলের দ্বীপ হাইতিতে শক্তিশালী ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৯৪১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এখনও নিখোঁজ রয়েছেন অনেকে। দেশটির সিভিল প্রটেকশন এজেন্সি এ তথ্য জানিয়েছে।
হাইতির সিভিল প্রটেকশন এজেন্সির পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়, দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত আহত ৯ হাজার ৯শ ১৫ জন। এখনও নিখোঁজ বহু মানুষ। নিহতের এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। উদ্ধার কার্যক্রম এখনও চলছে।
এদিকে হাইতির প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়েল হেনরি ভূমিকম্পে হতাহতদের স্মরণে দেশটিতে মাসব্যাপী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করছেন।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা এখন তুঙ্গে। এখন পর্যন্ত রেকর্ড বইয়ের তথ্যে এ বছরের জুলাই মাসটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণতম মাস। এমনটাই জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞান এবং জলবায়ু বিষয়ক গবেষণা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা ন্যাশনাল ওশনিক অ্যাটমোস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নোয়া)।
চলতি সপ্তাহেই জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব নিয়ে হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিশ্ব উত্তপ্তকারী বিপজ্জনক গ্যাস নির্গমন অব্যাহত থাকলে চলতি শতাব্দীর শেষ দিকে সামুদ্রিক পানির উচ্চতা দুই মিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।
জাতিসংঘের মহাসচিব এটিকে ‘মানবতার জন্য লাল সংকেত’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, আমরা যদি এখনই সব শক্তি একত্রিত করি, তাহলে জলবায়ু বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব। প্রতিবেদন এটি পরিষ্কার করে দিয়েছে যে, দেরি করার মতো সময় নেই আর কোনো অজুহাতেরও জায়গা নেই।
জাতিসংঘের বিজ্ঞানীরা বলেছেন, আগে ১০০ বছরে জলবায়ুর যে পরিবর্তন হতো, ২০৫০ সালের মধ্যে প্রতি ছয় থেকে নয় বছরে তা ঘটবে। এই শতাব্দীজুড়ে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে জলস্তর বাড়বে, ভাঙন দেখা দেবে, অনেক শহর পানিতে তলিয়ে যাবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু সংকটের সরাসরি প্রভাবে মনুষ্য বসতির কাছাকাছি এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের উদ্ভব হচ্ছে। মূলত বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যেভাবে প্রকৃতির সঙ্গে যথেচ্ছাচার করেছে, তাতে প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রকৃতি একটি জীবন্ত সত্তা, তাকে শুধু সম্পদ লাভের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ এ বিষয়টিকে আমলে না নিয়ে উন্নত দেশগুলো নিজেদের তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে জলবায়ু তহবিল, কার্বন ট্রেড প্রভৃতি তৈরি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টোপ দিয়ে যাচ্ছে।
তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাটি যেমন পরিবেশগত, তেমনি একই সঙ্গে তা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকও বটে। উন্নত দেশগুলোর কারণেই এই জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, ফলে তাদের কার্বন উদ্গিরণ হ্রাসে বাধ্য করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা, কার্যকর কূটনীতি ও রাজনীতি।
তারা বলেন, জলবায়ু সম্মেলনগুলোর মূল সুরে সমস্যা সমাধানের কোনো ব্যাপার থাকে না। কারণ, এর মধ্য দিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। কিন্তু এমন একটা ভাব করা হয় যে সমস্যাটি আমলে নেওয়া হয়েছে। কথা হচ্ছে, দুনিয়ার উন্নয়নের মডেল যেন প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা না করে প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন থামানো বা এর গতিকে ধীর করে দেওয়ার জন্য অনেক কথাবার্তা হয়েছে। কিন্তু তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কথাবার্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আসছে নভেম্বরে গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত হবে জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন (কপ–২৬)। এই সম্মেলনেও আগের ধারাবাহিকতা চালু থাকবে। আলাদাভাবে প্রতিটি দেশ এমন একটা পথ বের করার ওপর জোর দেবে, যাতে করে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাতে একটি স্বেচ্ছাসেবামূলক প্রতিশ্রুতি তারা দিতে পারে।
তারা বলেন, প্রাকৃতিক নিয়মে পৃথিবীর বিষুবরেখা সংলগ্ন অঞ্চলে গ্রীষ্মের তীব্রতা থাকায় বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে। তবে এখন বিশ্ব জলবায়ু উষ্ণায়নের কারণে উত্তর গোলার্ধের দেশগুলিতে হিমবাহ গলে যাচ্ছে, কম তুষারপাত ও গরমকালে অতিরিক্ত গরম ও অতিবৃষ্টির ঘটনা ঘটছে। এখন ভাবার সময় এসেছে, পৃথিবীকে বাঁচাতে বিশ্বের সব প্রান্তের মানুষকে সজাগ হওয়ার। নইলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ তার সীমারেখা মানছে না, সে হোক উত্তর বা দক্ষিণ গোলার্ধ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০২
আপনার মতামত জানানঃ