প্রকৃতি সুন্দর আবার ভয়ংকরও। তার প্রমাণ আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোতেই পেয়ে থাকি। তবে প্রকৃতি মাঝে মাঝে এমন বিরূপ আচরণ করে যে তার প্রতিফলন দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। আর তেমনই একটি বিষয় হচ্ছে সিংকহোল। যাকে অনেকেই প্রকৃতির দানবগর্ত বলে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে আমেরিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বেশি নজরে পড়ে সিংকহোল।
সম্প্রতি সিংকহোল নিয়ে সবচেয়ে উদ্বেগে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ তুরস্ক। বিশ্বে যে কয়েকটি দেশে সিংকহোল রয়েছে তার অন্যতম তুরস্ক। দেশটিতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সিংকহোল দেখা গেছে।
সিংকহোল কী?
সিংকহোল মূলত প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হওয়া এক ধরনের গর্ত। সিংকহোলকে এক প্রকার দানবীয় গর্তও বলা হয়। সিংকহোল হলো— কোনো একটি স্থানের ভূমি হঠাৎ করে কিংবা ধাপে ধাপে বসে যাওয়া।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্যমতে, সিংকহোল হলো প্রকৃতিতে হঠাৎ করে সৃষ্টি হওয়া এক ধরনের বিশালাকার গর্ত। ২০১০ সালে গুয়েতেমালা সিটিতে সিংকহোল দেখা যাওয়ার পর এটি আলোচনায় আসে।
ক্ষেত্রবিশেষে সিংকহোলের ব্যাস ও গভীরতা ১-৬০০ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। প্রকৃতিতে এমন দানবীয় গর্ত তৈরির ঘটনা নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন সময়ে সিংকহোল নামক প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিভিন্ন দেশে দেখা দিয়েছে। সিংকহোল আজ থেকে প্রায় শত বছর আগেও ছিল; কিন্তু তখন এটি এতটা ভয়াবহ আকারে ছিল না। সম্প্রতি ঝড়-বৃষ্টি, ভূমিধসের মতো বিভিন্ন দেশে সিংকহোলের পরিমাণ বাড়ছে। সিংকহোল যে কোনো জায়গায় হতে পারে। সেটি সাগরের তলদেশে যেমন হতে পারে; তেমনি রাস্তা, খেলার মাঠ, ফসলি জমি কিংবা জনবসতিপূর্ণ এলাকায়ও হতে পারে।
সিংকহোলের আকার ও গভীরতা একেক জায়গায় একেক রকম হয়ে থাকে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সিংকহোল তৈরি হয় যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে। এর পরপরই রয়েছে তুরস্কের কনিয়া। প্রকৃতিতে সিংকহোল বেড়ে যাওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলন, তীব্র খরা, মাটির ক্ষয়, জলের স্তর নিচে নেমে যাওয়া, মিথেন গ্যাসের প্রভাব ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
যেভাবে সৃষ্টি হয় গর্ত
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস বলছে, সিংকহোল প্রকৃতিতে হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া বিশালাকার গর্ত। সাধারণত, বৃষ্টি হলে মাটির উপরিতলের পানি মাটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এরপর সেখানে একটি স্তরে পানি জমা থাকে। সেই পানি যখন সেচ কাজ বা অন্যকোনো কারণে উত্তোলন করা হয় তখন উপরিভাগে ভূমিধস হয়ে বড় ধরনের গর্ত সৃষ্টি হয়।
সিংকহোল প্রকৃতিতে খুব সাধারণ ঘটনা। একে ভূতত্ত্ববিদরা বলেন, ‘কারস্ট ট্রেইন’।
ইউএসজিএস বলছে, শুধু পানি উত্তোলনের জন্য নয়, যেসব এলাকায় মাটির অভ্যন্তরে কঠিন শিলা রয়েছে সেখানে মাটির উপরিভাগের পানি নিচে প্রবেশ করে। সেখানে থাকে লবণ, চুনাপাথর, কপার ও জিপসামের মতো খনিজের স্তর।
এসব স্তরের খনিজ তোলা হলেও মাটির অভ্যন্তরে ফাঁপা জায়গা তৈরি হতে থাকে। এরপর নির্দিষ্ট সেই এলাকায় মাটি নিচে ধসে গিয়ে তৈরি হয় সিংকহোল।
সিংকহোল একেবারে নাটকীয়ভাবে তৈরি হয়। অনেকেই ভূমিধসকেই সিংকহোল মনে করেন। কিন্তু দুটি সম্পূর্ণ আলাদা।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, কয়েক দশক এমনকি শতাব্দী লাগে একটি সিংকহোল তৈরি হতে। ইউএসজিএস বলছে, ভূগর্ভস্থ পানি অথবা খনিজ উত্তোলন করা হলে মাটির অভ্যন্তরে ফাঁপা জায়গা তৈরি হয়। নিচের স্তরের মাটি যখন ভূমির উপরের চাপ নিতে পারে না তখনই ধসে পড়ে আর তৈরি হয় বিশালাকার গর্ত।
প্রকৃতিতে হঠাৎ সিংকহোল তৈরির ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আশঙ্কাজনক হারে তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বেড়েছে খরা। কমেছে পানির স্তর। মাটি ক্ষয়, মিথেন গ্যাসের প্রভাব, অধিক হারে ভূগর্ভস্থ পানি ও খনিজ পদার্থ উত্তোলনও দায়ী। অপরিকল্পিত ভূগর্ভস্থ সুয়ারেজ লাইন বা মাটির নিচে নির্মাণ কাজকেই মনে করা হচ্ছে শহরে সিংকহোল বৃদ্ধির কারণ।
বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আশঙ্কাজনক হারে তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বেড়েছে খরা। কমেছে পানির স্তর। মাটি ক্ষয়, মিথেন গ্যাসের প্রভাব, অধিক হারে ভূগর্ভস্থ পানি ও খনিজ পদার্থ উত্তোলনও দায়ী। অপরিকল্পিত ভূগর্ভস্থ সুয়ারেজ লাইন বা মাটির নিচে নির্মাণ কাজকেই মনে করা হচ্ছে শহরে সিংকহোল বৃদ্ধির কারণ।
সিংকহোলে ঝুঁকিতে তুরস্ক
সিংকহোল নিয়ে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে তুরস্কের কনিয়া রাজ্য। গত এক যুগে নতুন করে সবচেয়ে বেশি সিংকহোল তৈরি হয়েছে এই রাজ্যে।
কনিয়া টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির সিংকহোল রিসার্চ সেন্টারের অধ্যাপক ফেতুল্লাহ আরিক বলেন, তিনি রাজ্যটিতে গণনা করে ৬০০টি সিংকহোলের অস্তিত্ব পেয়েছেন। যা ২০২০ সালে ছিল ৩৬০টি।
দেশটিতে সিংকহোল বেড়ে যাওয়ায় বিশেষজ্ঞরা সরকারের পানি ব্যবস্থাপনা নীতিমালাকে দায়ী করেছেন। কৃষকরা অনেক জোর করেই অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি তুলে নেয়ায় এই বিশাল বিশাল গর্তের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।
মালভূমির অঞ্চল কনিয়া রাজ্যকে বলা হয় পাউরুটির দেশ। সেখানে যতদূর চোখ যাবে দেখা মিলতে গমের আবাদ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অঞ্চটিতে বেড়েছে খরা। সেই সঙ্গে ফসলের পানির জন্য অঞ্চলটিকে নির্ভর করতে হয় ভূগর্ভস্থ সেচের ওপর। জমিতে সেচ দিতে তাই কোটি কোটি লিটার পানির প্রয়োজন হয়। সেই পানি উঠানোর ফলে নেমে গেছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর।
পানির স্তর নেমে যাওয়ায় মাটির অভ্যন্তরে ফাঁকা জায়গা তৈরি হচ্ছে। আবার ওই অঞ্চলের কৃষকরা সেচের সুবিধায় পানি তুলে মাটির উপরেও বিশাল জলাধার বা ডোবা তৈরি করে জমা রাখেন। অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি তোলায় মাটির শক্তি কমে গিয়েও ডোবার স্থানে হয় ভূমিধস। এতেও তৈরি হয় দানবগর্ত।
তুরস্কের চেম্বার অফ এগ্রিকালচারাল ইঞ্জিনিয়ার্সের (জেডএমও) প্রধান বাকী রিমজি সুয়েমেজ বলেন, ‘কারা সেচের জন্য অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করছে তা তদন্ত করা হবে। এই অবস্থা বিরাজ থাকলে, অসংখ্য সিংকহোলে তুরস্ক আরেক মহামারির দিকে এগোবে। তখন খাবারের ওপর করোনাভাইরাস মহামারির ধাক্কা লাগতে বাধ্য।’
ভূতত্ত্ববিদরা বলছেন, অনেকেই এই দানব গর্ত সৃষ্টির জন্য প্রকৃতিকে দায়ী করেন। তবে এটা প্রাকৃতিক নয়, বরং মানবসৃষ্ট দুর্যোগ।
তাদের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই পানির স্তরও নিচে নেমে যাচ্ছে। অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি তোলায় বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সিংকহোল বা দানবগর্ত তৈরি হচ্ছে।
বিশ্বের বড় কিছু সিংকহোল
সিংকহোল গড়ে ১০ মিটার চওড়া ও ১৫০ মিটার গভীয় হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে দানবগর্ত বা সিংকহোল।
চুকুইচামাতা সিংকহোলটি চিলিতে অবস্থিত। এটি এখন কপার খনি হিসেবে ব্যবহার হয়। ২৭৯০ ফুট গভীর সিংকহোলটি সৃষ্টি হয়েছে ১৯১০ সালে।
বাহামাসের লং আইল্যান্ডে ডিনস ব্লু হোল অন্যতম বড় একটি সিংকহোল। এর গভীরতা ৬৫০ ফুট।
চীনের চংকিং পৌরসভার অধীনে বিশ্বের বৃহত্তম সিংকহোলটির নাম জিয়াওজাই তিয়ানকেনগ। এটি ৬৬২ মিটার।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
ঝড়বৃষ্টি, ভূমিধসের মতোই বাড়ছে সিংকহোল। তাই বিশ্ব জুড়ে এই দানব দুর্যোগের উৎপত্তি ও কারণ নিয়ে চলছে নানান আলোচনা। আপাতদৃষ্টিতে এটিকে প্রাকৃতিক ঘটনা মনে করলেও এসব দানবীয় গর্ত সৃষ্টির পেছনে রয়েছে মানুষের কর্মকাণ্ড।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু সংকটের সরাসরি প্রভাবে মনুষ্য বসতির কাছাকাছি এ ধরনের সিংকহোল উদ্ভব হচ্ছে। মূলত বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যেভাবে প্রকৃতির সঙ্গে যথেচ্ছাচার করেছে, তাতে প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রকৃতি একটি জীবন্ত সত্তা, তাকে শুধু সম্পদ লাভের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ এ বিষয়টিকে আমলে না নিয়ে উন্নত দেশগুলো নিজেদের তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে জলবায়ু তহবিল, কার্বন ট্রেড প্রভৃতি তৈরি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টোপ দিয়ে যাচ্ছে।
তারা বলেন, একসময় বন্যা, জলোচ্ছ্বাস প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টি ইউরোপ বা আমেরিকার সরকারগুলি ততটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখেনি। এখন এই সব অঞ্চলগুলোতেও ঝড়, উচ্চ তাপমাত্রা, অতিবৃষ্টি, বন্যা ছড়িয়ে পড়েছে। প্রকৃতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, বৈশ্বিক জলবায়ু বা উষ্ণতার কোনো উত্তর বা দক্ষিণ গোলার্ধ নেই। জলবায়ুর রূপান্তর ও পরিবর্তনের প্রভাব বৈশ্বিক। আর সব গোলার্ধেই তার প্রভাব দৃশ্যমান।
তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাটি যেমন পরিবেশগত, তেমনি একই সঙ্গে তা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকও বটে। উন্নত দেশগুলোর কারণেই এই জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, ফলে তাদের কার্বন উদ্গিরণ হ্রাসে বাধ্য করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা, কার্যকর কূটনীতি ও রাজনীতি।
তারা বলেন, জলবায়ু সম্মেলনগুলোর মূল সুরে সমস্যা সমাধানের কোনো ব্যাপার থাকে না। কারণ, এর মধ্য দিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। কিন্তু এমন একটা ভাব করা হয় যে সমস্যাটি আমলে নেওয়া হয়েছে। কথা হচ্ছে, দুনিয়ার উন্নয়নের মডেল যেন প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা না করে প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন থামানো বা এর গতিকে ধীর করে দেওয়ার জন্য অনেক কথাবার্তা হয়েছে। কিন্তু তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কথাবার্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আসছে নভেম্বরে গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত হবে জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন (কপ–২৬)। এই সম্মেলনেও আগের ধারাবাহিকতা চালু থাকবে। আলাদাভাবে প্রতিটি দেশ এমন একটা পথ বের করার ওপর জোর দেবে, যাতে করে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাতে একটি স্বেচ্ছাসেবামূলক প্রতিশ্রুতি তারা দিতে পারে।
তারা বলেন, প্রাকৃতিক নিয়মে পৃথিবীর বিষুবরেখা সংলগ্ন অঞ্চলে গ্রীষ্মের তীব্রতা থাকায় বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে। তবে এখন বিশ্ব জলবায়ু উষ্ণায়নের কারণে উত্তর গোলার্ধের দেশগুলিতে হিমবাহ গলে যাচ্ছে, কম তুষারপাত ও গরমকালে অতিরিক্ত গরম ও অতিবৃষ্টির ঘটনা ঘটছে। এখন ভাবার সময় এসেছে, পৃথিবীকে বাঁচাতে বিশ্বের সব প্রান্তের মানুষকে সজাগ হওয়ার। নইলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ তার সীমারেখা মানছে না, সে হোক উত্তর বা দক্ষিণ গোলার্ধ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৩০
আপনার মতামত জানানঃ