হিন্দু, মুসলমান বা খ্রিস্টান নয়, মানবধর্মই সবচেয়ে বড় ধর্ম। নিজেদের একমাত্র সন্তানের জন্ম সনদ পাওয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গের নদিয়ার রানাঘাট পৌর কর্তৃপক্ষের কাছে সন্তানের ধর্ম হিসাবে ‘হিউম্যানিজম’ বা ‘মানবধর্ম’-এর উল্লেখ করে আবেদন জানিয়েছিল এক দম্পতি। তাদের একান্ত অনুরোধ রেখে শিশুর জন্ম প্রমাণ পত্রে ধর্মের স্থানে লেখা হলো ‘মানবধর্ম বা হিউম্যানিজম’।
ভারতীয় গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, নিজের একমাত্র সন্তানের জন্মসনদ পাওয়ার জন্য ধর্মের জায়গায় হিউম্যানিজম বা মানবতা লিখে পৌর কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ার রানাঘাটের এক দম্পতি। আবেদনপত্র পেয়ে দ্বিধায় পড়ে যায় পৌর কর্তৃপক্ষ। কারণ এরকম আবেদন আগে কখনও আসেনি। পৌর কর্তৃপক্ষের আপত্তিতে সেটি রানাঘাট মহকুমা শাসকের কাছে যায়। অনেক টানাপোড়েনের পর মানবধর্মকেই স্বীকৃতি দেয় মহকুমা প্রশাসন।
‘মানবধর্ম’ স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিশুর নাম সৃজিত মুখোপাধ্যায়। বাবা স্বরূপ মুখোপাধ্যায়, মা মৌমিতা মুখোপাধ্যায়। রানাঘাট-২ নম্বর ব্লকের আইশমালির পুরাতন পাড়ার বাসিন্দা তারা। স্বরূপ মুখোপাধ্যায় আগাগোড়া বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। নিজেকে সমাজকর্মী বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন তিনি। বর্তমানে সিপিএমের যুব সংগঠন রাজ্য কমিটির সদস্য স্বরূপবাবু।
আগাগোড়া একটু ব্যতিক্রমী মানসিকতা তার। নিজেদের জমিজমা, চাষাবাদে সংসার চলে যায়। হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, শিখ, জৈনর মতো প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাসী নন। স্বরূপবাবু মনে করেন, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ধর্মই সর্বোত্তম। নিজের এই মতাদর্শের সঙ্গে স্বরূপ মিল খুঁজে পেয়েছিলেন চাকদহের ক্ষুদিরামপল্লির বাসিন্দা মৌমিতার। ২০২০-এর ফেব্রুয়ারিতে তার সঙ্গেই বিয়ের রেজিস্ট্রেশন সেরে ফেলেন তিনি।
স্বরূপ বলেন, ‘আমাদের বিয়ের রেজিস্ট্রেশনেও ‘মানবধর্ম’ই উল্লেখ করা হয়েছিল এবং চাকদহের যে ভবনে আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল, সেটি সাজানো হয়েছিল ‘এনআরসি’ বিরোধী পোস্টারে। আমরা দু’জন আগাগোড়াই চেয়ে এসেছি, ধর্মের গণ্ডি টপকে মানুষের পাশে থাকার। এ ধর্মকে নিয়েই বড় হয়ে উঠুক আমাদের সন্তান। শেষপর্যন্ত সেই মর্যাদা পাওয়ায় আমরা খুব খুশি।’
রানাঘাটের এক বেসরকারি নার্সিংহোমে গত ৫ এপ্রিল মৌমিতা মুখোপাধ্যায়ের পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। নাম রাখা হয় সৃজিত মুখোপাধ্যায়। এরপর নিজেদের সন্তানের জন্ম সনদ পাওয়ার জন্য তারা রানাঘাট পৌর কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন। সেই আবেদনপত্রে ধর্মের জায়গায় তারা ‘হিউম্যানিজম’ অর্থাৎ ‘মানবধর্ম’ উল্লেখ করেন।
প্রচলিত ধর্মীয় ধ্যানধারণার বাইরে গিয়ে ধর্মের জায়গায় মানবধর্মের স্বীকৃতি পাওয়া সহজে হয়নি। শিশুটির বাবা স্বরূপ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘আমাকে প্রশাসনের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। সন্তানের ধর্মের জায়গায় যাতে মানবধর্ম লেখা হয়, তার জন্য কাতর আবেদন করি। অবশ্য শেষ পর্যন্ত আমাদের সেই আবেদনকে স্বীকৃতি দেয়া হয়।’
এ বিষয়ে রানাঘাট পৌরসভার মুখ্য প্রশাসক কৌশল দেব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘মানবধর্ম লেখা একটি জন্মসনদ রানাঘাট পৌরসভা থেকে দেয়া হয়েছে। আবেদন জমা পড়ার পর রানাঘাট মহকুমা শাসকের অনুমতি নিয়ে এ সনদ দেয়া হয়েছে। ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে কেউ যদি মানবধর্ম লিখতে চান, এর থেকে ভালো কিছু হয় না। এটি ব্যতিক্রমী বিষয়।
তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে কেউ যদি এ ধরনের আবেদন করেন, সেক্ষেত্রে আমরা কর্তৃপক্ষের অনুমতি চাইব। অনুমতি পেলে জন্মসনদ দেয়া হবে।’
এ ঘটনা ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি। এই খবরে মুগ্ধ হয়েছেন নেটনাগরিকরা।
মানবতাবাদীরা বলছেন, সকল ধর্মের মূল শিক্ষা হল মানবতা। আর মানবতাই হল মানব ধর্ম বা প্রেম ধর্ম বা ঈশ্বর ধর্ম। তাই প্রকৃত সাধক বা মানবতাবাদী মানুষ বা ঈশ্বর প্রেমীদের মধ্যে ধর্মীয় দ্বন্দ্ব থাকেনা। এই দ্বন্দ্ব শুধু দুনিয়াদারী অবুঝ মানুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
তারা বলেন, মানব ধর্ম ইসলাম, সনাতন, খ্রীষ্টান বা বৌদ্ধ ধর্মের মত কোনো জীবন ব্যবস্থা নয়। আবার এসব ধর্ম থেকে পৃথক কোনো ধর্মও নয়। বরং প্রতিটি ধর্মের মাঝেই মানব ধর্ম বিদ্যমান। তবে মানব ধর্মে প্রতিটি ধর্ম বিদ্যমান নয়। কারন একটি ধর্মের মাঝে অমানবিক কিছু থাকলে থাকতেও পারে, তবে মানব ধর্মে অমানবিক কিছুই নেই একমাত্র মানবতা ছাড়া। একটি ধর্মের কিছু কর্ম অন্য ধর্মের মানুষের কাছে খারাপ মনে হতে পারে। কিন্তু মানবতা কারো কাছেই খারাপ নয়। বরং খারাপ মানুষগুলোও মানবতাকে ভাল হিসেবেই বিশ্বাস করে হোক সে আস্তিক বা নাস্তিক। আর এখানেই মানব ধর্মের স্বার্থকতা। একটি ধর্ম পালন করতে গেলে আপনাকে অন্যধর্ম বিসর্জন দিতে হবে।তবে মানব ধর্মই একমাত্র ধর্ম, যে ধর্ম পালনে মানুষকে নিজ ধর্ম ত্যাগ করতে হয় না। হোক সে হিন্দু, মুসলিম বা খ্রীষ্টান। বরং প্রতিটি ধর্মই মানুষকে মানব ধর্ম পালনের কথা বলে।
তারা বলেন, আমরা চাই ছোট্ট একরত্তি সৃজিত বড় হয়ে সত্যি সত্যিই মানবধর্মে দীক্ষিত হোক।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০২
আপনার মতামত জানানঃ