দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর থেকে নারীর মৃত্যুহার কম ছিল। কিন্তু গত মার্চ মাসে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর থেকে নারীর মৃত্যু বাড়ছে। কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন ব্যাপক গতিতে ছড়িয়ে পড়া ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের পাশাপাশি নারীদের মধ্যে টিকা না নেয়ার প্রবণতাও এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
স্বাস্থ্য বিভাগের হিসেবে দেশে এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যে ২২ হাজার ১৫০ জন মারা গেছে তার মধ্যে ১৪ হাজার ৮২২ জন পুরুষ ও ৭ হাজার ৩২৮ জন নারী। অর্থাৎ মোট মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৬৬ দশমিক ৯২ শতাংশ পুরুষ ও ৩৩ দশমিক ৮ শতাংশ নারী।
যদিও চলতি বছরের পহেলা মার্চ পর্যন্ত দেশে পুরুষের মৃত্যুর হার ছিলো ৭৫ দশমিক ৬১ ও নারীদের ২৪ দশমিক ৩৯। মূলত এর পর থেকেই মৃতদের তালিকায় পুরুষের সংখ্যা বেশি থাকলেও নারীদের সাথে ব্যবধান কমে আসার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গত এপ্রিল থেকে পর্যায়ক্রমে মৃত্যুর ক্ষেত্রে নারী পুরুষের ব্যবধান কমছে অর্থাৎ নারীদের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।
পহেলা এপ্রিল পর্যন্ত করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া মানুষের মধ্যে পুরুষ ছিলো ৭৫ দশমিক ২০ শতাংশ ও নারী ছিলো ২৪ দশমিক ৮০ শতাংশ।
পহেলা মে পর্যন্ত পুরুষের মৃত্যুর হার ৭২ দশমিক ৮৯ শতাংশ ও নারীর ২৭ দশমিক ১১ শতাংশ এবং পহেলা জুন পর্যন্ত পুরুষ ৭২ দশমিক ১৬ শতাংশ ও নারীর ২৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
আবার পহেলা জুলাই পর্যন্ত যত জন মারা গেছে তার ৭১ দশমিক ১১ শতাংশ পুরুষ আর ২৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ নারী। তবে নারী ও পুরুষের মধ্যে ব্যবধান কমে আসার চিত্র আরো স্পষ্ট হয়েছে চলতি মাসের প্রথম সাত দিনে।
স্বাস্থ্য বিভাগের হিসেবে পহেলা আগস্ট পর্যন্ত যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের মধ্যে নারী ছিলো ৩২ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এরপর ৬ অগাস্ট এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ দশমিক ০৮ শতাংশে।
‘করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে মহিলারা কম আক্রান্ত হতো। আগে ২০ শতাংশ নারী আক্রান্ত হতো। এটা বেড়ে ৪৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এটা অবশ্যই উদ্বেগের বিষয়।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে মহিলারা কম আক্রান্ত হতো। আগে ২০ শতাংশ নারী আক্রান্ত হতো। এটা বেড়ে ৪৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এটা অবশ্যই উদ্বেগের বিষয়।’
যে কারণে করোনায় নারীদের মৃত্যুহার বাড়ছে
মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. রুবিনা ইয়াসমিন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, গতবারের তুলনায় এবারে নারীদের মৃত্যু অনেক বেশি। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এবারের সংক্রমণ তীব্র এবং মৃত্যুহারও বেশি যেটা গতবার ছিলো না। গতবারের মৃত্যুর চেয়ে এবারের মৃত্যু একেবারেই ভিন্ন রকমের। আর ফিমেলরা বেশি ইনফেক্টেড হচ্ছে কিনা— সেই ডেটাটা আমাদের কাছে নেই।
অধ্যাপক ডা. রুবিনা আরো বলেন, সাধারণত করোনা ছাড়া নন করোনা পিরিয়ডে নারী রোগী কম থাকে, পুরুষ রোগী বেশি থাকে। কোভিডের সময়েও গতবার পুরুষ ভর্তি বেশি ছিল নারী ছিল কম। কিন্তু এবার নারী রোগী অনেক বেশি ভর্তি হচ্ছে। যা গতবারের তুলনায় অনেক বেশি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কাওসার আফসানা বিবিসিকে বলেন, নারীদের মৃত্যুর সংখ্যা আগের তুলনায় কিছুটা বেড়ে যাওয়ার মূলে ব্যাপক গতিতে ছড়িয়ে পড়া ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। তবে টিকাদানের ক্ষেত্রে নারী পুরুষের অনুপাত সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া গেলে হয়তো দেখা যাবে বয়ষ্ক নারীদের মধ্যে টিকা দেয়ার প্রবণতা এখনো কম। আবার বাড়িতে কেউ অসুস্থ হলে নারীরাই তাদের যত্ন এবং দেখা-শোনার দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এসব কারণে তারা এমনিতেই ঝুঁকির মধ্যে ছিলেন।
তিনি বলেন, পারিবারিক ও সামাজিক কিছু সংস্কৃতিও নারীদের জন্য ঝুঁকির পরিবেশ তৈরি করছে। যেমন ধরুন বাইরে থেকে বাজার করে আনলে এখনো বহু পরিবারে গৃহকর্ত্রীই সেগুলো আগে দেখে থাকেন। আবার বাইরে থেকেও অনেকে বয়স্কদের দেখতে আসে। এই করোনার সময় বিশেষ করে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট আসার পর এসব বিষয়গুলো নারীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরেকজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন বিবিসি বলেন, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট অধিক সংক্রমণশীল, যাতে একজন আক্রান্ত হলে পরিবারের সবাই আক্রান্ত হচ্ছে। এ কারণে নারীদের আক্রান্ত হবার প্রবণতা বেড়ে গেছে। আর সংক্রমণ বাড়লে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়াটাই স্বাভাবিক। নারীদের মধ্যে সংক্রমণ বাড়ছে বলেই মৃত্যুর হারও বাড়ছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান— আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমণের মাত্রা অন্য যে কোনো ধরনের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। সীমান্তবর্তী এলাকার গ্রামগঞ্জে এ ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের সব অঞ্চলের প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে কেউ না কেউ জ্বর-কাশি ও ঠান্ডায় আক্রান্ত। গ্রামগঞ্জে নারীদের করোনা উপসর্গ দেখা দিলেও তারা পরীক্ষা করাচ্ছেন না। পরিস্থিতি যখন জটিল হয়ে পড়ে তখন তাড়াহুড়া করে হাসপাতালে যান। কিন্তু শেষ মুহূর্তে হাসপাতালমুখী হওয়ায় তাদের বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে নারী মৃত্যু বেড়ে গেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৪৪
আপনার মতামত জানানঃ