দেশে শিশু মৃত্যুর অন্যতম একটি কারণ ক্যান্সার। শিশুরা কেন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা নেই চিকিৎসকদের। তবে প্রতিবছর এ রোগে অনেক শিশু নতুন করে আক্রান্ত হয়। শিশুদের সাধারণত ব্লাড ক্যান্সার বেশি হচ্ছে। তবে নসিকাগ্রন্থি, কিডনি এবং চোখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া শিশুর সংখ্যাও কম নয়। প্রাপ্তবয়স্কদের মতো এখন শিশুদের মধ্যেও প্রাণঘাতী ব্যাধিটির প্রকোপ বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, দেশে শিশুস্বাস্থ্যে বড় এক সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে ক্যান্সার। দেশী-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় এ তথ্য জানা যায়।
সম্প্রতি দেশে শিশুমৃত্যুর কারণ খুঁজে বের করতে ৪০টি জেলায় এক জরিপ চালায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। জরিপে পাওয়া ফলাফল প্রকাশ হয়েছে ‘ডিটারমিনেশন অব কজেজ অব ডেথস বাই ভারবাল অটোপসি’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে। আনুপাতিক হার বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে এখন শিশুমৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে উঠেছে ক্যান্সার।
যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি সম্প্রতি বাংলাদেশের ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে আরেকটি গবেষণা চালায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) দুজন বিশেষজ্ঞ এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ‘চাইল্ডহুড ক্যান্সার: এ সিচুয়েশন অ্যানালাইসিস অ্যান্ড চ্যালেঞ্জ, বাংলাদেশ পারসপেক্টিভ’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে প্রতি বছর ৯-১২ হাজার শিশু-কিশোর ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আক্রান্ত শিশু ক্যান্সার নির্ণয় বা চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের কাছে আসার পরই তাদের তথ্য জানা সম্ভব হয়। এর বাইরেও অনেক শিশু-কিশোর বাড়িতে বিনা চিকিৎসায় বা অপচিকিৎসায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
চিকিৎসকরা বলছেন, ক্যান্সারের মূল কারণ হচ্ছে জিনগত পরিবর্তন। এছাড়া ভেজাল খাদ্য, খাদ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার, বায়ুদূষণ ও বিকিরণের মাত্রা বৃদ্ধির ফলে শিশুদের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ছে। শিশুদের মধ্যে ব্লাড ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব বেশি। এছাড়া ব্রেন, কিডনি, কোলন, লিভার ও হাড়ের ক্যান্সারেও আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বড়দের মতো শিশুদের মৃত্যুর ক্ষেত্রে ক্যান্সার অন্যতম কারণ। শূন্য থেকে ১৯ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রতিবছর নতুন করে ৩ লাখ শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। উচ্চ আয়ের দেশগুলোর তুলনায় মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশুদের মৃত্যুর হার চারগুণ বেশি। কারণ মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশে রোগ নির্ণয়ে বিলম্ব করা হয় এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিবারের পক্ষে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। পাশাপাশি অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব তো রয়েছেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বে অন্তত তিন লাখ শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। এদের মধ্যে ৮০% শিশুকেই চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা সম্ভব। তবে স্বাস্থ্য সেবার সুযোগের অভাবে নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে ৯০ ভাগ ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুই মারা যায়।
উচ্চ আয়ের দেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত ৮০ শতাংশের বেশি শিশুর ক্যান্সার নিরাময় করা হয়। মধ্য এবং স্বল্প আয়ের দেশে এই হার ২০ শতাংশের বেশি নয়। তবে সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, সার্জারি ও রেডিওথেরাপিসহ অন্যান্য চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারলে শিশু ক্যান্সার নিরাময় সম্ভব। অন্যদিকে রোগ নির্ণয়ে ভুল বা বিলম্ব, মাঝপথে চিকিৎসা ছেড়ে দেয়া, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও সেবা না পাওয়ার কারণে এ রোগে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে।
এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে ২০৩০ সালের মধ্যে ক্যান্সারে শিশু মৃত্যুর হার ৬০ ভাগ কমিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। শিশুদের ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ-২০৩০ ঘোষণা করেছে সংস্থাটি। যেখানে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে শিশুদের ক্যান্সারে আক্রান্তের হার ৬০ ভাগ কমিয়ে আনতে হবে। সেটি নিশ্চিত করতে পারলে কমপক্ষে ১০ লাখ শিশুর জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে।
প্রাদুর্ভাব বাড়লেও শিশু ক্যান্সারের চিকিৎসায় এখনো অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। বড়দের ক্যান্সার চিকিৎসার যতটুকু সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়, শিশুদের ক্ষেত্রে তার একভাগও নেই।
প্রাদুর্ভাব বাড়লেও শিশু ক্যান্সারের চিকিৎসায় এখনো অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। বড়দের ক্যান্সার চিকিৎসার যতটুকু সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়, শিশুদের ক্ষেত্রে তার একভাগও নেই।
এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টরা বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করছেন ঢাকাকেন্দ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং শয্যা ও যন্ত্রপাতিসহ প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গের অভাবকে। তারা জানিয়েছেন, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং বিএসএমএমইউর পেডিয়াট্রিক অনকোলজি বিভাগসহ হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে শিশুদের ক্যান্সার চিকিৎসা দেয়া হয়। এছাড়া সংকট রয়েছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরও। ক্যান্সার চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ ফার্মাসিস্ট রয়েছেন মাত্র দুজন। বর্তমানে এসব সংকটকে আরো গভীর করে তুলেছে করোনা মহামারী।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন এক সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, করোনা মহামারিতে ক্যান্সার চিকিৎসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক সময় রোগীরা করোনা আক্রান্ত হয়ে পড়ছে, এতেও তাদের ঝুঁকি বাড়ছে। অনেক সময় রোগীর সঙ্গে যারা আসছে তাদেরও করোনা সংক্রমিত হয়ে পড়ার ভয় থেকে যায়।
স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্যান্সার আগের মতো মরণব্যাধি নয়। ক্যান্সার হলে মানুষ বাঁচে। কিন্তু বাঁচাতে গেলে পরিপূর্ণ সমর্থন প্রয়োজন। ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে রোগীর অতিরিক্ত চাপের কারণে প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব হয় না। দীর্ঘসূত্রতার কারণে রোগ জটিল আকার ধারণ করে। স্টেজ ওয়ানে চিকিৎসকের কাছে এলেও অনেক সময় শয্যা না থাকায় রোগী ভর্তি করাতে করাতে ক্যান্সার স্টেজ তিনে পৌঁছে। তখন আর কিছু করার থাকে না।
এছাড়া দারিদ্র্যের কারণে অনেকেই শিশুদের সময়মতো চিকিৎসা করাতে পারে না। দুর্বল সরকারি ও স্থানীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার কারণে শিশুদের ক্যান্সার নির্ণয়েও অনেক দেরি হয়ে যায়।
তারা বলছেন, শিশুদের ক্যান্সার শনাক্তের হার বাড়লেও চিকিৎসা সম্প্রসারিত হচ্ছে না। এমনকি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও কম। দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ২০-২২ জন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। আরো বেশি বিশেষজ্ঞ তৈরি করতে হবে। চিকিৎসক তৈরির পাশাপাশি শিশু ক্যান্সার নিরাময়ের জন্য এ বিষয়ে অভিজ্ঞ নার্স ও টেকনিশিয়ান প্রয়োজন। কিন্তু দেশে এখনো অভিজ্ঞ নার্স কিংবা টেকনিশিয়ানের অভাব রয়ে গিয়েছে। বিদেশে শুধু শিশু ক্যান্সারের ওপর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান তৈরি করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে সে সুযোগ নেই। আবার ঢাকার বাইরে শিশু ক্যান্সার চিকিৎসা তেমন উন্নত নয়। ঢাকার বাইরে শুধু চট্টগ্রামে শিশু ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ রয়েছেন একজন।
বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ক্যান্সার চিকিৎসায় অবকাঠামোসহ সব ধরনের সংকট রয়েছে। চিকিৎসার সুযোগ তৈরি করতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৪৩
আপনার মতামত জানানঃ