৫০ বছর আগের পণ্য রপ্তানির পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির চেহারা পুরোটাই বদলে দিয়েছে তৈরি পোশাক খাত। পাটকে সরিয়ে পণ্য রপ্তানির শীর্ষস্থান দখল করে খাতটি। পাঁচ দশকের ব্যবধানে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পায় ৯৬ গুণ। প্রায় ৪০ লাখ গ্রামীণ নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান, নারীর ক্ষমতায়ন, সহযোগী শিল্পের বিকাশসহ অনেক ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে পোশাকশিল্প। চীনের পর একক দেশ হিসেবে দ্বিতীয় শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ ছিল বাংলাদেশ। পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানার সংখ্যার দিক থেকেও বিশ্বে সবার ওপরে বাংলাদেশ।
তবে এই সিংহাসনে যে ঘুন রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় লেগেছিল, তা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর সময়টাতে মহামারি করোনার ধাক্কায় এবার বিশ্ব বাজারে দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় স্থানের মুকুট নিয়ে খুশি থাকতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। চীন বরাবরের মতোই আছে প্রথম স্থানে। তবে ভিয়েতনাম বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশকে হটিয়ে দ্বিতীয় বৃহৎত্তম তৈরি পোশাক (আরএমজি) রপ্তানিকারকে দেশ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে।
দ্বিতীয় ভিয়েতনাম, তৃতীয় বাংলাদেশ
তৈরি পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থান থেকে সরে তৃতীয়তে এসে দাঁড়াল বাংলাদেশ। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, চীন-আমেরিকা বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে চীন থেকে অনেক ক্রেতা তাদের বাজার সরিয়ে নিচ্ছে। আর এরই ইতিবাচক সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম।
তবে রপ্তানি বাণিজ্যে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম তৈরি পোশাক খাতে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। এ জন্য কম উৎপাদন ব্যয়ের পাশাপাশি নীতিগত বিভিন্ন প্রণোদনা ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন পোশাক খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। পাশাপাশি আমেরিকার মতো বড় বাজারে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পাওয়াও ভিয়েতনামের এগিয়ে যাওয়ার কারণ।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিসটিকস রিভিউ ২০২১ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে ডব্লিউটিও। এতে দেখা যায়, ২০১৯ সালে বিশ্ব পোশাক বাজারে বাংলাদেশের বাজার অংশিদারিত্ব (মার্কেট শেয়ার) ছিল ৬.৮ শতাংশ। ২০২০ সালে এটা কমে দাঁড়ায় ৬.৩ শতাংশ। ওই বছর বাংলাদেশের বাজার মূল্য ছিল ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এদিকে ২০১৯ সালে বিশ্ব তৈরি পোশাক বাজারে ভিয়েতনামের মার্কেট শেয়ার ছিল ৬.২ শতাংশ। গত বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬.৪ শতাংশ। ওই বছরের শেষে এসে যার বাজার মূল্য দাঁড়ায় ২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
২০১৯ সালে তৈরি পোশাকের রফতানি বাজারে শীর্ষ পাঁচ দেশ ছিল চীন ৩০.৮ শতাংশ, বাংলাদেশ ৬.৮০ শতাংশ, ভিয়েতনাম ৬.২ শতাংশ, ভারত ৩.৫ শতাংশ এবং তুরস্ক ৩.২ শতাংশের যোগান দেয়।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে বিশ্ব পোশাক রপ্তানি বাজারে ভিয়েতনামের মার্কেট শেয়ার ছিল ২.৯ শতাংশ; বাংলাদেশের ছিল ৪.২ শতাংশ। যা কিনা ভিয়েতনামের থেকে ৮৫.৫ শতাংশ বেশি।
করোনাকালীন দুই দেশের বাজার পরিস্থিতি
চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের সার্বিক পণ্য রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা যেখানে ৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; ভিয়েতনামের সেখানে ২০২১ সালে একক খাত হিসেবে শুধু বস্ত্র ও পোশাক রপ্তানি থেকেই ৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
অন্যদিকে ২০২০ সালে দেশটির বস্ত্র ও পোশাক রপ্তানি থেকেই আয় হয়েছে ৩৫ বিলিয়ন ডলার। সেখানে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের সব পণ্য মিলে রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৩৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। ভিয়েতনামের রপ্তানি আয়ের মোট আকার ৬২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের।
সম্প্রতি ভিয়েতনামের ন্যাশনাল টেক্সটাইল অ্যান্ড গার্মেন্টস গ্রুপ (ভিনটেক্স) জানিয়েছে, করোনা মহামারি, মার্কিন-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ, বেক্সিট এবং বিভিন্ন দেশের বাণিজ্য সুরক্ষাবাদ কৌশল ব্যবহার সত্ত্বেও তাদের রপ্তানি খুব বেশি প্রভাবিত হয়নি।
বিশ্বব্যাপী চাহিদা কমে যাওয়ার পরও দেশটির অর্জিত রপ্তানি আয়ে ২২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। মূলত এ প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা রক্ষা করতেই ভিনটেক্স ২০২১ সালের জন্য রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে ৩৯ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে চলতি বছরেও করোনার নেতিবাচক প্রভাব থাকবে বলে মনে করছেন শিল্প মালিকরা৷ তাদের আশঙ্কা, ২০২১ সালেও পোশাক খাত অন্তত শতকরা ২০ ভাগ ক্ষতির মুখে থাকবে৷
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) তাদের এক গবেষণায় বলেছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পোশাক শতকরা ২৩ ভাগ কম নিয়েছে আমদানিকারকরা৷ এই সময়ে শ্রমিকদের আয় কমেছে ৮ শতাংশ, আর তাদের ওপর চাপ বেড়েছে ৬০ শতাংশ৷
তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, গত বছর করোনা শুরুর পর মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত ৩.৮১ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার স্থগিত হয়৷ কিন্তু পরবর্তীতে জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত স্থগিত হওয়া অর্ডারের শতকরা ৯০ ভাগ ফিরে আসে৷ তবে ৫০ মিলিয়ন ডলারের অর্ডার শেষ পর্যন্ত আর ফিরে আসেনি৷
গত বছরের অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর এবং এই বছরের জানুয়ারি মাসে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি কম৷ অক্টোবর থেকে জানুয়ারি মাসে শতকরা পাঁচ থেকে ১০ ভাগ রপ্তানি কমেছে৷ তবে এটাকে ক্ষতি বলছেন না পোশাক শিল্পের মালিকরা৷ তাদের মতে, নানা সময়ে রপ্তানি স্বাভাবিক নিয়মে বাড়ে-কমে৷
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে অর্ডার তেমন স্থগিত হয়নি৷ তবে অর্ডার ও পোশাকের দাম কমেছে৷ অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে গড়ে দাম কমেছে শতকরা পাঁচ ভাগ৷ পোশাক রপ্তানি করে লাভ হয় গড়ে শতকরা দুই-তিন ভাগ৷ ফলে লাভ কমে গেছে বা লোকসান হয়েছে৷
যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বৃদ্ধিতে চতুর্থ বাংলাদেশ
করোনার পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে যুক্তরাষ্ট্র। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দেশ থেকে ২ হাজার ৯২১ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক কিনেছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২২ দশমিক ১৯ শতাংশ বেশি। গতবার জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে ২ হাজার ৩৯১ কোটি ডলারের পোশাক কিনেছিল যুক্তরাষ্ট্রের ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের সুবাতাস বাংলাদেশের গায়েও লেগেছে। তাতে দেশটিতে চলতি বছরের পাঁচ মাসে ২৫৮ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করতে পেরেছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা। এতে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি বেড়েছে ১৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ, যদিও বাংলাদেশের চেয়ে চীন, ভিয়েতনাম ও ভারত বেশি সুযোগ নিতে পেরেছে।
ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে চীন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৫৮২ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। তাদের রপ্তানি বেড়েছে ২৬ শতাংশ। অবশ্য গত বছর করোনার কারণে চীনের পোশাক রপ্তানি ৩৯ শতাংশ কমে গিয়েছিল। রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫১৫ কোটি ডলার। খাদের কিনার থেকে দেশটি আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে দ্বিতীয় শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ ভিয়েতনামও খারাপ করছে না। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে তাদের পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ৫৭৪ কোটি ডলার। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ বেশি। গত বছর দেশটির পোশাক রপ্তানি কমেছিল ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। তাদের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৫৭ কোটি ডলার।
অটেক্সার তথ্যানুযায়ী, চলতি বছর করোনায় বিপর্যস্ত হওয়ার পরও ভারত বেশ ভালোভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভারতের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ২১ দশমিক ৯৫ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে দেশটি পোশাক রপ্তানি করেছে ১৭৩ কোটি ডলারের, যদিও গত বছর করোনার কারণে তাদের রপ্তানি ২৫ শতাংশ কমেছিল।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২০৫৫
আপনার মতামত জানানঃ