টানা বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যা, পাহাড়ধ্বস নিত্যদিনের ঘটনায় পরিনত হয়েছে। গাছ কাটার ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়ংকর রূপে, আগুনে যেন ঘি ঢালছে পরিকল্পায়নের অভাব, দূর্নীতি আর পানি নিষ্কাশনের অব্যবস্থাপনা।
বঙ্গোপসাগরে তৈরী হওয়া লঘুচাপে ও পূর্ণিমার জোয়ারের প্রভাবে টানা তিন দিনের বৃষ্টিতে বৃহত্তর খুলনার নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে পানিতে। বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে চাষি, মৎস ব্যবসায়ী, ধান ব্যবসায়ী সহ সাধারন মানু্ষেরা। ওখানকার মৎস্য ঘেরগুলোতে ১০৮ কোটি টাকার মাছের ক্ষতি হয়েছে। ২০০ হেক্টর আমন বীজতলা নষ্ট হয়েছে। অনেক ঘর-বাড়িসহ রাস্তা-ঘাট তলিয়ে গেছে পানির নিচে।
বিশেষ ব্যক্তিরা ক্ষতির পরিমান নিয়ে যা বললেন
খুলনা বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক রাজ কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘টানা বৃষ্টিতে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার অনেক মৎস্য ঘের তলিয়ে গেছে। এতে ১০৮ কোটি টাকার মাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম জানান, ‘জোয়ারের প্রভাবে এ অঞ্চলের নদ-নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে দেড় থেকে দুই ফুট বেড়েছে।’
খুলনা কৃষি অধিদফতরের উপ-পরিচালক হাফিজুর রহমান জানান, ‘বৃষ্টির পানিতে ২০০ হেক্টর জমির আমন বীজতলা ডুবে আছে।’
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ এস এম রাসেল বলেন, ‘বৃষ্টির পানিতে ভেসে গেছে ১৭ হাজার ঘের ও পুকুরের মাছ। এতে চাষিদের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১১ কোটি টাকা।’
পাইকগাছা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আনোয়ার ইকবাল মন্টু বলেন, ‘টানা তিন দিনের ভারী বর্ষণে পাইকগাছার জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে চিংড়ির ঘের, রাস্তাঘাট, আমন বীজতলা ও ফসলি জমি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেক কাঁচা ঘরবাড়ি। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। তিন দিনের ভারী বর্ষণের ফলে পৌরসভাসহ ১০টি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে গেছে।’
পাইকগাছা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান শিয়াবুদ্দিন ফিরোজ বুলু বলেন, ‘বৃষ্টির পানিতে ভেসে একাকার হয়েছে চিংড়ির ঘের। বেশিরভাগ আমন বীজতলা পানিতে তলিয়ে রয়েছে। অনেক রাস্তাঘাটও তলিয়ে যাওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। ভারী বর্ষণে রাড়–লী মালো পাড়ার কয়েকটি কাঁচা ঘর কপোতাক্ষ নদের গর্ভে চলে যায়। এখানে চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে অনেকগুলো পরিবার। এরা অনেকটাই নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। টানা তিন দিনের ভারী বর্ষণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।’
অপরিকল্পিত নগরায়ন ও পানি নিষ্কাশনের অভাবে ক্ষতির পরিমান বেশি
পানি নিষ্কাশনের সুষ্ঠু কোনো ব্যবস্থা না থাকায় কয়েকবছর ধরেই বর্ষা মৌসুমে টানা বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যায় খুলনার নিম্নাঞ্চল। ফসলি জমিগুলোতে পানি জমে থাকার কারণে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি সহ মাছের ক্ষয়ক্ষতি হয় বিপুল পরিমান।
অপরিকল্পিতভাবে খুলনা মহানগরী গড়ে ওঠায় এর কুফল বেশ আগে থেকে ভোগ করতে শুরু করেছে নগরবাসী। খুলনা মহানগরীকে জালের মত করে ঘিরে রেখেছে ২২টি খাল। দখলে যার বেশিভাগেরই আয়তন সংকুচিত হয়েছে। খালগুলোর যখন এই অবস্থা তখন শহরে পানির চাপ বাড়ে। ফলে তৈরি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। নগরীর পাশে একমাত্র ময়ুর নদটি খননের পরেও নোংরা পরিবেশ ও নগরীর পানি নিষ্কাসনে ভূমিকা রাখতে পারছে না। ২০০৯ সালে খালের দখলদারদের একটি তালিকা তৈরি করা হয় কেসিসির পক্ষ থেকে। ওই তালিকায় শহর ও শহরতলির ৫০টি খাল দখলের সঙ্গে ৮১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের যুক্ত থাকার তথ্য উঠে আসে। ওই তালিকায় দেখা যায় ৫০টি খালের মধ্যে ১১টির কোনো অস্তিত্ব নেই। বাকি ৩৯টি খালের অন্তত ৭০ শতাংশ অবৈধ দখলে রয়েছে।
পরিকল্পিতভাবে ড্রেনেজ ব্যবস্থার অভাবে বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যায় পৌর এলাকার রাস্তাগুলোও। আবার কিছু এলাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা থাকলেও সেগুলো সংস্কার না করায় বৃষ্টির পানি রাস্তায় জমে দুর্গন্ধের সৃষ্টি এবং মশার জন্ম হয়। উপায় না পেয়ে এলাকাবাসীকে হাঁটুপানি পেরিয়েই যাতায়াত করতে হয়। একটু বেশি বৃষ্টি হলেই সড়ক পেরিয়ে দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা পানি বাসাবাড়িতে উঠে যায়। বছরের পর বছর বর্ষাকাল এলেই এই সমস্যার মুখোমুখি হতে হলেও নিরসনের দ্রুত উদ্যোগ নেবার প্রতি আগ্রহ নেই পৌর কর্তৃপক্ষের।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১২২৩
আপনার মতামত জানানঃ