ইউরোপে অভিবাসনের দিকে ঝুঁকছে বাংলাদেশি যুবকরা। বৈধভাবে যেতে না পারলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও অবৈধ পথে যাচ্ছেন তারা, এরমধ্যে অনেকেই হারাচ্ছেন প্রাণ। এখন নভেল করোনাভাইরাসজনিত মহামারীতে গত বছর থেকেই গভীর সংকটে পড়েছে গোটা বিশ্ব। সংক্রমণ ঠেকাতে বিভিন্ন মেয়াদে সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করেছে প্রতিটি দেশই। তবে শত কড়াকড়িতেও থেমে নেই অবৈধ পথে ইউরোপে অভিবাসনের প্রচেষ্টা। গত দেড় বছরে সাড়ে ৫ হাজার বাংলাদেশি অবৈধ পথে ইউরোপে পাড়ি দিয়েছেন।
এদিকে গত ১৯ জুলাই তিউনিসিয়ার উপকূলে ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবে ১৭ বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৫ জনের বাড়ি মাদারীপুরে। এই পাঁচজন হলেন রাজৈর উপজেলার আজিজ শেখের ছেলে জিন্নাত শেখ (২৫), বীরেন্দ্রনাথ মল্লিকের ছেলে সাধন মল্লিক (১৯), মোশাররফ কাজীর ছেলে হৃদয় কাজী (২১), আজিজুল শিকদারের ছেলে সাগর শিকদার (২২) ও মাদারীপুর সদর উপজেলার বাকির হোসেনের ছেলে মো. সাকিল (১৮)।
নিহত তরুণদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় তিন মাস আগে দালালদের মাধ্যমে লিবিয়া পৌঁছান তারা। লিবিয়ায় আড়াই মাস একটি বন্দিশালায় আটকে থাকার পর তাদের ইতালির উদ্দেশে যাত্রা শুরু হয়। মাঝপথে তাদের যাত্রা সারাজীবনের জন্য ইতি টানে।
গত দেড় বছরে সাড়ে ৫ হাজার বাংলাদেশি অবৈধ পথে ইউরোপে পাড়ি দিয়েছেন
সম্প্রতি প্রকাশিত ইউএনএইচসিআরের পরিচালন তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ৫ হাজার ৩৬০ জন বাংলাদেশীকে ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার করেছে সংস্থাটি। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি তিউনিসিয়ার নাগরিক উদ্ধার করা হয়েছে। যার সংখ্যা ১৪ হাজার ৬৪৯। এর পরই রয়েছে আলজেরিয়ার ৯ হাজার ৪৬৬ জন ও মরক্কোর ৫ হাজার ৩৯৯ জন। সংখ্যার বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান ৪ নম্বরে। এছাড়া এ অঞ্চল থেকে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টায় শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে সিরিয়া, আফগানিস্তান, আইভরিকোস্ট ও মালি।
জাতিসংঘ বলছে, করোনাকালে মহামারী ঠেকাতে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় শ্রমিক নিয়োগ ও অভিবাসন ব্যবস্থাপনা করছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। বৈধভাবে প্রবেশের ক্ষেত্রে এখন বেশ কড়াকড়ি আরোপ করেছে ইউরোপের দেশগুলো। ইউএনএইচসিআরের তথ্য বলছে, লকডাউন আর প্রবেশে কড়াকড়ি থাকলেও ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধ প্রবেশের চেষ্টায় থাকা এসব মানুষের প্রধান গন্তব্য ইউরোপের দেশগুলো। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অংশ যায় লিবিয়া থেকে। অন্যান্য দেশের তুলনায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়ার কাতারে প্রথম সারিতে আছেন বাংলাদেশিরাই। আর এ কাজ করতে গিয়ে প্রাণ হারানোর সংখ্যা বাড়তে থাকায় বিষয়টি নিয়ে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘ইউরোপে অবৈধভাবে প্রবেশের ক্ষেত্রে অন্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের নাম আসায় তা আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। মধ্য আয়ের দেশসহ বিভিন্নভাবে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং করা হলেও যুদ্ধ চলমান দেশগুলোর মানুষের অবৈধভাবে প্রবেশের সঙ্গে বাংলাদেশীরা কেন প্রবেশ করছে, আন্তর্জাতিক ফোরামে তার উত্তর দিতে আমাদের বেগ পেতে হয়। তিনি বলেন, গত এক যুগে প্রায় ৫৫ হাজার বাংলাদেশি অবৈধভাবে ইতালি প্রবেশ করেছেন।‘
কেবল মাদারিপুরেই দেড় বছরে ৩৮ মামলা
মাদারীপুরের পাঁচটি থানায় গত দেড় বছরে মানব পাচার আইনে ৩৮টি মামলা হলেও দালাল চক্রের মূল হোতারা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। অনেকেই আবার জামিনে বের হয়ে এই চক্রে জড়িয়ে পড়ছে।
জেলা পুলিশের সূত্র বলছে, ৩৮টি মামলায় ১৯৬ জনকে আসামি করা হলেও পুলিশ মাত্র ৪২ জনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। এই ৩৮টি মামলার মধ্যে ২০টি মামলার বিষয় তদন্ত শেষ করে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। ২০টির মধ্যে ১০টি মামলা আদালতেই নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকি ১৮টির মধ্যে এখনো তদন্তাধীন আছে ৮টি মামলা। ১০টি মামলার অধিকতর তদন্ত করছে সিআইডি পুলিশ।
জানতে চাইলে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) চাইলাউ মারমা গনমাধ্যমকে বলেন, দালালদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তাদের কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া হয় না। অভিযান চালিয়ে অভিযুক্তদের ধরা হয়। এরপরও প্রায়ই দেখা যায় ভুক্তভোগীরা মামলা দিতে আসতে চান না।
ধাপে ধাপে নেয়া হয় প্রচুর টাকা
নিহত তরুণদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইতালি নেওয়ার কথা বলে অভিবাসনপ্রত্যাশী তরুণদের একেকজনের কাছ থেকে সাড়ে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা করে নেয় দালালেরা। বাংলাদেশ থেকে বাহরাইন হয়ে দুবাই নেওয়া হয় তরুণদের। দুবাইতে এক সপ্তাহ থাকার পর সেখানে থেকে নেওয়া হয় লিবিয়া। লিবিয়া পৌঁছানোর পর তরুণদের পরিবারের কাছ থেকে ইসলামী ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে দুই ধাপে প্রায় ৩ লাখ টাকা নেওয়া হয়। লিবিয়া পর্যন্ত পৌঁছানোর পর তাদের একটি বন্দিশিবিরে আটকে রাখা হয়। এরপর আবারও ইসলামী ব্যাংকের আরও একটি অ্যাকাউন্টে সাড়ে ৩ লাখ টাকা নেওয়া হয় এবং চুক্তি অনুযায়ী লিবিয়া থেকে সাগরপথে তাঁদের পাঠানো হয় ইতালিতে।
ইউএনএইচসিআরের তথ্য মতে, এ পথগুলো দিয়ে গমনেচ্ছুদের ঢাকা পার করার সময় একটি চক্রের অধীনে রাখা হয়। এরপর দুবাই বা ইস্তানবুল অথবা সুদানে তাদের হস্তান্তর করা হয় দ্বিতীয় চক্রের হাতে। সেখান থেকে উড়োজাহাজে করে লিবিয়া যাওয়ার পর তৃতীয় চক্রের হাতে যান বাংলাদেশিরা। সেখান থেকে নৌকায় উঠিয়ে দেয়ার পর চতুর্থ চক্র ও সর্বশেষ ইউরোপ নেমে পঞ্চম চক্রের হাতে পড়েন বাংলাদেশিরা। এ পথগুলো দিয়ে লিবিয়া পৌঁছতে জনপ্রতি ৫ থেকে ৯ লাখ টাকা করে খরচ করতে হয়। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সব স্থানে অর্থ পরিশোধ করা না হলে অভিবাসন প্রত্যাশীদের মুক্তিপণ ও অপহরণের মতো ঘটনাও ঘটে। আবার কখনো কখনো মানব পাচারকারী চক্রের হাতে নির্দয়-নিষ্ঠুর পরিণতি বরণ করে নিতে হয় অভিবাসন প্রত্যাশীদের।
এদিকে আন্তর্জাতিক অভিবাসনবিষয়ক সংস্থা আইওএম বলছে, এ বছরের ২০ মে পর্যন্ত ৭৪৩ জন ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। সংস্থাটির তথ্য থেকে আরো জানা যায়, গত বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়ার সংখ্যা ছিল ২০ হাজার ১১ জন, এ বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৭৩৪ জনে। গত বছর পাঁচ মাসে ২৯০ জন মারা গেলেও এ বছর মারা গেছেন ৭৪৩ জন।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৩৪১
আপনার মতামত জানানঃ