প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ দেশ থেকে নানা পথে লিবিয়া গিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেন। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন ইউএনএইচসিআর জানায়, ২০১৪ থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ২১ লাখ মানুষ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করেন।
এভাবে সাগরপথ পাড়ি দিতে গিয়ে এ সময়ে প্রায় ২০ হাজার মানুষ প্রাণ হারান, যাদের মধ্যে অনেক বাংলাদেশি রয়েছেন। সংস্থাটি জানায়, চলতি বছর যে সংখ্যক মানুষ অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করেছেন, তাদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন বাংলাদেশি তরুণেরা।
কী কারণে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি দিচ্ছে ভূমধ্যসাগর?
যারা ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেন, তাদের কাউকে কাউকে নানা রকম মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁরা জানেন না এটা কত বড় ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা। কিন্তু তাঁদের বেশির ভাগ জানেন এই যাত্রা কতটা ভয়ংকর, জানেন এতে মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে। এভাবে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সাত–আট লাখ টাকাও বেশির ভাগ পরিবার সহজে জোগাড় করতে পারে না।
পরিবারের শেষ সঞ্চয় ভেঙে, ঋণ করে, এমনকি জমিজমা বিক্রি করে টাকা জোগাড় করে প্রায় সব পরিবার। তাহলে জেনেশুনে সাত–আট লাখ টাকা খরচ করে ‘প্রাণ হাতে করে’ কেন মানুষ পা বাড়ান এই পথে?
কয়েক বছর আগে ভূমধ্যসাগরে এক নৌকাডুবিতে মৃত্যুর ঘটনার পর সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য একটি জবাব পাওয়া গিয়েছিল— দেশে এত উন্নতির পরও এমন ঝুঁকি নাকি নিচ্ছে লোভী মানুষেরা। এই দেশে শিক্ষার সঙ্গে কর্মের যোগ নেই বললেই চলে। ‘এই দেশে যিনি যত বেশি শিক্ষিত, তার বেকার থাকার আশঙ্কা তত বেশি’ এমন বাস্তবতা উঠে এসেছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায়।
‘বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণ সমাজের মধ্যে কর্মসংস্থান ও বেকারত্ব’ শীর্ষক এই গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। এতে জানা যায় প্রায় ৩৭ শতাংশ স্নাতক ডিগ্রিধারী বেকার, যা শিক্ষিতদের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে ৩৪ শতাংশের বেশি বেকার। অথচ এসএসসি ও এইচএসসি পাস করা তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বেকারত্বের হার যথাক্রমে ২৭ ও ২৮ শতাংশ।
একই সংস্থার আরেক সাম্প্রতিক জরিপে জানা যায়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীর ৬৬ শতাংশই বেকার থাকছেন। মাত্র ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পান। ৩ শতাংশ নিজ উদ্যোগে কিছু করছেন।
আরেক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপে দেখা গেছে, দেশে শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই বেকারের হার বেশি। ৪৭ শতাংশ শিক্ষিতই বেকার থাকছেন।
এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে এমন সব বিষয় পড়ানো হয়, যেগুলোর ব্যবহারিক কোনো মূল্য এই চাকরির বাজারে নেই। অন্যদিকে আমাদের শিক্ষার মান কমতে কমতে পৌঁছেছে একেবারে তলানিতে। ফলে চাকরির বাজারের জন্য যোগ্য কর্মী তৈরি হচ্ছেন না।
আমাদের দেশের ব্যবসা বা শিল্পমালিকেরা বলেন, অনেক ক্ষেত্রে তারা ভালো সুযোগ-সুবিধার চাকরি দেওয়ার মতো যোগ্য প্রার্থী পান না। এর অনিবার্য ফল হিসেবে এই দেশে কর্মরত পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর কর্মীরা এই দেশ থেকে বৈধ–অবৈধ পথে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার উপার্জন করে তাদের দেশে নিয়ে যান। বাংলাদেশের এক কোটির বেশি প্রবাসী এই দেশে যে রেমিট্যান্স পাঠান, এই অঙ্ক তার অর্ধেকের বেশি।
ওদিকে সরকার দেশের যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দাবি করে, সেটারও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। লুটপাটের উদ্দেশ্যে নেওয়া কিছু বড় অবকাঠামো প্রকল্প দেশের জিডিপিতে যুক্ত হয়েছে বটে, কিন্তু সেটা কোনোভাবেই সত্যিকারের উন্নয়ন নয়। দেশে সত্যিকারের উন্নয়ন না হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হচ্ছে, দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হওয়া এবং বিপুলসংখ্যক তরুণের কর্মহীন হয়ে থাকা।
সরকারের দায় কতটা?
বেকারত্ব এই দেশে এতটাই প্রকট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে সরকারও এখন এটা অস্বীকার করতে পারছে না। ২০১৮ সালে এক অনুষ্ঠানে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘দেশে একটা বড় ধরনের সমস্যা হয়ে যাচ্ছে কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি।’ তরুণদের চরম বেকারত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দেওয়া সরকারটির ওপর মহল এখন তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার নসিহতে ব্যস্ত।
অপরিকল্পিত ও মানহীন শিক্ষার কারণে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে না পেরে যে তরুণ বেকার থাকেন, তার পেছনের শত ভাগ দায় সরকারের। অন্যদিকে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধু কর্মসংস্থানের অভাবের কারণে যে তরুণ বেকার থাকেন, তার জন্যও দায়ী সরকার। আবার এসব তরুণকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বকর্মসংস্থানে নিয়োজিত করতে না পারার ব্যর্থতা সরকারের।
এমনকি ‘প্রাণ হাতে নিয়ে’ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার জন্য যে সাত–আট লাখ টাকা লাগে, সেই টাকা এই দেশে বিনিয়োগ করে একটি ব্যবসা যে ঠিকঠাক মতো গড়ে তোলা যায় না, তার জন্যও সরকারই দায়ী। ব্যবসার পরিবেশ তৈরির ব্যর্থতা আর সেই সঙ্গে ব্যবসা করার পদে পদে সরকারের নানা সংস্থার ঘুষ ও সরকারি দলের লোকজনের চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্য বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টিতে এক বড় বাধা।
দেশের উৎপাদনশীল জনগোষ্ঠীর সুবর্ণ সময়, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের কালে এই ভয়ংকর সংকটের একমাত্র দায় সরকারের। এই ব্যর্থতার দায় পুরো মাথায় নেওয়ার ন্যূনতম মানসিকতা থাকলে সবার আগে সরকারের উচিত ছিল এই নাজুক তরুণদের রক্ষা করতে পদক্ষেপ নেওয়া।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৫০
আপনার মতামত জানানঃ