ইসরায়েলে তৈরি হ্যাকিং সফটওয়্যার পেগাসাস যে ৪৫টি দেশে ছড়ানোর তথ্য এসেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের নামও রয়েছে। তবে সরকার এ বিষয়ে সতর্ক রয়েছে জানিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, বাংলাদেশে কোনো ধরনের অসঙ্গতি পাওয়া যায়নি। সরকার এ বিষয়ে সতর্ক রয়েছে।
বাংলাদেশ এ ধরনের কোনো সফটওয়্যার কিনেছে কিনা জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, এ রকম সফটওয়্যার কেনার প্রশ্নই আসে না। তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিষয়টা ভালো বলতে পারবে।
বলা হচ্ছে, কোনো বেসরকারি কোম্পানির তৈরি করা সবচেয়ে শক্তিশালী স্পাইওয়্যার হল এই পেগাসাস। ইসরায়েলি কোম্পানি এনএসও গ্রুপ এই নজরদারি সফটওয়্যার তৈরি করেছে এবং বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে তা বিক্রি করেছে।
এই হ্যাকিং সফটঅয়্যার ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশের ‘কর্তৃত্ববাদী’ সরকার মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, আইনজীবী, রাজনীতিকদের ফোনে নজরদারি চালাচ্ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে।
ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানসহ ১৬টি সংবাদপত্র হ্যাকিংয়ের এই ঘটনা ফাঁস করার পর এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে আলোচনা।
হ্যাকিং সফটওয়্যার পেগাসাস ব্যবহার করা দেশগুলো হচ্ছে, আজারবাইজান, বাহরাইন, হাঙ্গেরি, ভারত, কাজাখস্তান, মেক্সিকো, মরোক্কো, রুয়ান্ডা, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
এমন খবর প্রকাশিত হওয়ার পর এখন আতঙ্কে আধুনিক ফোন ব্যবহারকারীরা।
কীভাবে কাজ করে এই স্পাইওয়্যার?
ধরেন, আপনি স্মার্টফোন ইউজার। প্রথমে আপনার ফোনে একটি ওয়েবসাইটের লিঙ্ক পাঠানো হয়। তাতে ক্লিক করলেই মোবাইলে পেগাসাস ইনস্টল হয়ে যায়। এ ছাড়া হোয়াটসঅ্যাপে ভয়েস কল বা ভিডিয়ো কল করেও পেগাসাস ইন করানো যায়।
তথ্য ফাঁসের জন্য প্রথমে একটি ভুয়া হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্ট তৈরি করে অন্য একটি হোয়াটস অ্যাপ নম্বরে ভিডিও কল দেয়। যখন কোনো সন্দেহহীন ব্যবহারকারীর ফোন বেজে ওঠে, তখন ওই নম্বরে একটি ক্ষতিকর কোড চলে গিয়ে স্পাইওয়্যারটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইনস্টল হয়ে যায়। কেউ ফোন রিসিভ না করলেও সফটওয়্যারটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইনস্টল হয়ে যেতে পারে।
এরপর আক্রমণকারী ফোনের পুরো সিস্টেম নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এটা এতটাই ভয়ংকর যে একবার স্পাইওয়্যারটি ইনস্টল হয়ে গেলে সহজেই যে–কারও হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজিং ও কথা বলা, ভয়েস কল, পাসওয়ার্ড, কন্টাক্ট তালিকা, বিভিন্ন ইভেন্টের ক্যালেন্ডার, ফোনের মাইক্রোফোন, এমনকি ক্যামেরার নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে চলে যায়।
এত কিছুর পরও এনএসও গ্রুপ সফটওয়্যারটির মাধ্যমে কাউকে ক্ষতি করার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। উল্টো দাবি করছে, তারা বৈধ ও পরীক্ষিতভাবে সরকারি সংস্থাগুলোয় সহায়তা করার জন্য তাদের কাছে সফটওয়্যার বিক্রি করছে।
এই স্পাইওয়্যারের নজরদারির কথা ফাঁস করেছে পেগাসাস প্রোজেক্ট নামে ১৬টি সংবাদমাধ্যমের একটি টিম। ২০১৯ সাল থেকে পেগাসাস প্রোজেক্ট নামে একটি তদন্ত করে আসছিল। রোববার তদন্তের কিছু তথ্য ফাঁস করে তারা।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাইবার সিকিউরিটি ল্যাব পরিচালনাকারী ক্লডিও গুয়ারনিয়েরি বরাত দিয়ে গার্ডিয়ান জানায়, যদি কোনো স্মার্টফোনে পেগাসাস সফটওয়্যারটি প্রবেশ করানো যায়, তবে এনএসওর গ্রাহক পুরো ফোনটির দখল পেয়ে যায়।
এতে ফোনের মালিকের মেসেজ, কল, ছবি, ইমেইল সবই দেখতে পাবে। পড়তে পারে হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, সিগন্যালের বার্তাগুলো। এমনকি গোপনে ক্যামেরা কিংবা মাইক্রোফোন চালুও করতে পারবে এ পেগাসাস সফটওয়্যার।
গার্ডিয়ান জানিয়েছে, সম্প্রতি ফাঁস হওয়া ডেটাবেইসে ৫০ হাজারের বেশি ফোন নম্বর পাওয়া গেছে। ২০১৬ সাল থেকে ইসরায়েল কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোকে এ সেবা দিয়ে আসছে।
প্রথম খবরে আসে পেগাসাস ২০১৯ সালের অক্টোবরে। ফেসবুক মালিকানাধীন সংস্থা হোয়াটসঅ্যাপ জানায়, চারটি মহাদেশের প্রায় ১৪০০ জনের মোবাইল পেগাসাসের মাধ্যমে হ্যাক করা হয়।
এমন খবর প্রকাশ হওয়ার পর ইজরায়েলি সংস্থা এনএসও-র দাবি করছে যে, নিরাপত্তার জন্য নজরদারি চালানোর প্রযুক্তি তৈরি করাই তাদের কাজ। তারা শুধুমাত্র বিভিন্ন দেশের সরকার, সরকারি নিরাপত্তা সংস্থা ও গোয়েন্দা সংস্থাকে পেগাসাস স্পাইওয়্যার বিক্রি করে।
ওয়াশিংটন পোস্ট অবশ্য লিখেছে, কোনো দেশে কোনো ফোন পেগাসাসের কবলে পড়েছে মানেই যে ওই দেশের সরকার ওই স্পাইওয়্যারের ক্রেতা, তেমন নাও হতে পারে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সবই চেক করেছি এবং সতর্ক রয়েছি। কোনো রকম অসঙ্গতি দেখতে পাইনি। এখানে আপাতত ভয়ের কোনো কারণ নেই। অনেক সময় এসব বিষয়ে গুজবও ছড়ানো হয়। আমাদের সব নেটওয়ার্ক খোঁজ নিয়েছি, তবে কোনো সমস্যা এখনো দেখা যায়নি।”
‘ইসরায়েল থেকে মোবাইল ফোন নজরদারী করার প্রযুক্তি কিনেছে বাংলাদেশ’
গত ফেব্রুয়ারিতে কাতার-ভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আল জাজিরা ইংলিশ-এর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে তথ্য-প্রমাণসহ দাবি করেছিল, ইসরায়েল থেকে মোবাইল ফোন নজরদারী করার প্রযুক্তি কিনেছে বাংলাদেশ।
এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ইন্টারনেট এবং মোবাইল ফোন নজরদারী করার প্রযুক্তি ইসরায়েল থেকে আমদানি করেছে।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পিকসিক্স নামের একটি ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান থেকে মোবাইল ফোন নজরদারী করার প্রযুক্তির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এর আগে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯-এ পূর্ব ইউরোপীয় দেশ হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টের কাছে দু’জন ইসরায়েলি গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞ এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর চারজন বাংলাদেশী গোয়েন্দাকে প্রশিক্ষণ দেয়।
আল জাজিরার অনুসন্ধানী ইউনিট এবং ইসরায়েলি পত্রিকা হারেৎজ এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশ সরকার ইসরায়েলের একটি কোম্পানি থেকে ফোন-হ্যাকিং প্রযুক্তি কিনতে প্রায় ০.৩৩ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে যদিও দু’দেশের মধ্যে তেমন কোন কূটনীতিক সম্পর্ক নেই।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল, এই মোবাইল মনিটরিং প্রযুক্তি প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যবহারের জন্য হাঙ্গেরির একটি কোম্পানী থেকে ক্রয় করা হয়েছিল। যদিও এই দাবি নাকচ করেছিল বহির্বিশ্ব।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২২৪৫
আপনার মতামত জানানঃ