করোনা মহামারিতে বিশ্বের অর্থনীতিতে মোটা দাগে চোট পড়েছে। ব্যতিক্রম হয়নি দেশের অর্থনীতিতেও। তবে ঝড় তুফানে বাংলাদেশকে রক্ষায় সুন্দরবন যেভাবে রুখে দাঁড়ায় তেমনি করে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা প্রবাসীদের আয়ে রেমিট্যান্স সেভাবেই অবদান রেখেছে। করোনা মহামারির মাঝেও দেশে রেমিট্যান্সের রেকর্ড হয়। একইভাবে করোনার কারণে বিপুল পরিমাণ প্রবাসীকেও দেশে পাড়ি জমাতে হয়।
সানেমের এক জরিপে দেখা গেছে, করোনার সময় ২০ শতাংশ প্রবাসী শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন এবং ৫ শতাংশ দেশে ফেরত এসেছেন। এ পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের বিদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করার বিকল্প নেই। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সেই সক্ষমতা দেখা যাচ্ছে না। এছাড়া করোনাতে বিশ্বের দেশগুলো লকডাউনসহ বিভিন্ন সতর্কতা অবলম্বন করায় বিদেশে যাওয়াটা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।
এ ছাড়া শ্রমিকদের বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় একটি বাধা হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত ফি। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো যত টাকা দাবি করে, তাতে অনেকের পক্ষেই বিদেশে যাওয়া সম্ভব হয় না। সানেমের জরিপে জানা গেছে, শ্রমিকদের বিদেশ যাওয়ার খরচ বেড়েছে ২৩ শতাংশ।
মহামারির আগে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের গতি শ্লথ ছিল। করোনার প্রাদুর্ভাবে এ সমস্যা আরও তীব্র হয়েছে। ফলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া নির্ভর করছে শ্রমবাজার কত দ্রুত পুনরুদ্ধার করা যায় তার ওপর।
এমতাবস্থায় বিদেশফেরত এই বিপুল পরিমাণের জনসংখ্যার কর্মসংস্থান নিশ্চিতে সরকার এবার তাদের জন্য দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী করছে।
বিদেশফেরতদের অর্ধেকই কাজ পাননি
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম পরিচালিত ‘বিদেশফেরতদের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি অন্বেষণ এবং বিশ্লেষণ’ শীর্ষক এক জরিপে জানা গেছে, বছর পেরিয়ে গেলেও কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ফেরত আসা প্রবাসী কর্মীদের ৪৭ শতাংশই এখনও আয়ের জন্য কোনও কাজে যুক্ত হতে পারেননি। ফলে দৈনন্দিন খরচ চালাতে তাদের অনেককেই পরিবারের আয় বা আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার-দেনা করে চলতে হচ্ছে। অপরদিকে ৫৩ শতাংশ কৃষিকাজ, ছোটখোটো ব্যবসা বা শ্রমিক হিসেবে নিজেকে যুক্ত করে বর্তমানে পরিবার চালাচ্ছেন। তবে বিদেশফেরতদের ৯৮ শতাংশই এখনও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন।
জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, গতবছর বিদেশ ফেরতদের ৮৭ শতাংশ বলেছিলেন— তাদের কোনও আয়ের উৎস নেই। এবার দেখা গেছে, উত্তরদাতাদের প্রায় ৫৩ শতাংশ (৫২.৭৭) কোনও না কোনও কাজে নিজেকে যুক্ত করতে পেরেছেন। তবে উত্তরদাতাদের মধ্যে ৪৭ শতাংশ (৪৭ দশমিক ২২ শতাংশ) বিদেশফেরত ব্যক্তিই গত একবছরেও কোনও প্রকার কাজ যোগাড় করতে পারেননি। তারা তাদের দৈনন্দিন খরচ চালাতে নিজ পরিবারের আয় বা আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার নিয়ে চলছেন।
প্রতিবেদনে প্রবাসীদের বর্তমান মানসিক অবস্থাও উঠে আসে। গতবছর অংশগ্রহণকারীদের ৭৪ শতাংশ জানিয়েছিলেন, তারা ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও ভীতির মধ্যে রয়েছেন। কিন্তু এবার ৯৮ শতাংশ উত্তরদাতাই বলেছেন, অপর্যাপ্ত আয়, বেকারত্ব, পুনরায় বিদেশ যেতে না পারা, পারিবারিক চাপ ইত্যাদি কারণে চরম উদ্বিগ্নতা এবং মানসিক চাপের মধ্যে আছেন।
ব্র্যাক জানায়, করোনা মহামারি শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পযর্ন্ত প্রায় পাঁচ লাখ প্রবাসী দেশে ফেরত আসতে বাধ্য হয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকে ফিরেছেন আতঙ্কে, অনেক ফিরেছেন চাকরি হারিয়ে, কেউ ফিরেছেন স্থায়ীভাবে, আবার কেউবা কেবল ছুটি নিয়ে দেশে এসেছিলেন। উত্তরদাতাদের মধ্যে ৩৫% শতাংশ ছুটিতে দেশে এসেছিলেন। ১৯ শতাশ বলেছেন, তারা চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। ১৬ শতাংশ বলেছেন, তারা ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। ১২ শতাংশ বলেছেন, তারা একেবারেই চলে এসেছেন এবং ২ শতাংশ অসুস্থতার কারণে ফিরেছেন।
বিদেশফেরতদের কর্মসংস্থান
জানা যায়, করোনার সময় চাকরি হারিয়ে বিদেশ থেকে ফেরত আসা দুই লাখ প্রবাসী বাংলাদেশিকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে সরকার। প্রবাসী বাংলাদেশিদের নগদ টাকাও (ক্যাশ ইনসেনটিভ) দেওয়া হবে। উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য ঋণের প্রয়োজন হলে সরকার সে ব্যবস্থা করে দেবে। কেউ যদি আবার বিদেশ যেতে চান, তাকে প্রয়োজনীয় সনদসহ সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হবে।
প্রত্যাগত অভিবাসী কর্মীদের অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে ৪২৭ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর সিংহভাগই অর্থাৎ ৪২৫ কোটি টাকাই ঋণ দেবে বিশ্বব্যাংক। গত ২৩ মার্চ বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি সই হয়েছে। ২৮ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদনের কথা রয়েছে। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড প্রকল্পটি ২০২৩ সালের ডিসেম্বর নাগাদ বাস্তবায়ন করবে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এবং হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন থেকে পাওয়া তথ্যমতে, গত বছর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর ওই এক বছরে মোট ৪ লাখ ৮ হাজার ৪০৮ জন প্রবাসী বাংলাদেশি দেশে ফিরে এসেছেন। তাদের মধ্য থেকে দুই লাখ কর্মীকে বাছাই করা হবে তাদের আগ্রহ, পারিবারিক অবস্থা, আর্থিক অবস্থা ও প্রয়োজনীয়তার নিরিখে। কর্মী বাছাইয়ে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হবে। এর বাইরে আরও ২৩ হাজার ৫০০ কর্মীকে বাছাই করে তাদের সরকারের বিভিন্ন সংস্থা থেকে সনদ দেওয়া হবে।
প্রথম দফায় দুই লাখ কর্মীকে ৩২ জেলা থেকে বাছাই করা হবে। বাছাই করা দুই লাখ বিদেশফেরত কর্মী কী করতে চান, সেটা জেনে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে দেওয়া হবে।
প্রথম দফায় দুই লাখ কর্মীকে ৩২ জেলা থেকে বাছাই করা হবে। বাছাই করা দুই লাখ বিদেশফেরত কর্মী কী করতে চান, সেটা জেনে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে দেওয়া হবে।
উদাহরণ দিয়ে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, কেউ বিদেশে গাড়ি চালাতেন, কিন্তু এখন কোনো সনদ নেই, তাঁকে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিটিআরসি) থেকে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে সনদ দেওয়া হবে। সেই সনদ দিয়ে চাইলে ওই কর্মী ফের বিদেশে যেতে পারবেন। কিংবা দেশের মধ্যেই গাড়ি চালাতে পারবেন। ওই কর্মীর যদি আর্থিক সহযোগিতার প্রয়োজন হয়, তাকে মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) মাধ্যমে ঋণের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। কোনো বিদেশ ফেরত কর্মী যদি উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহের কথা জানান, তাকে এসএমই ফাউন্ডেশনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে সেখান থেকে ঋণের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।
কেউ যদি বড় কোম্পানিতে কাজ করার আগ্রহ দেখান, তার সেই যোগ্যতা থাকে, তাকে শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্রে (বিটাক) প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। আবার বিদেশ যেতে চাইলে সেই ব্যবস্থা করা হবে। এই প্রশিক্ষণের সময় দুই লাখ বিদেশফেরত কর্মীর প্রত্যেককে ১৩ হাজার ৫০০ টাকা করে দেওয়া হবে সম্মানী বাবদ।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অনুবিভাগ) খালেক মল্লিক এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশ থেকে ফেরত আসা কর্মীদের অনেকেই কর্মহীন অবস্থায় আছেন। তারা পরিবার–পরিজন নিয়ে অনেকটা মানবেতর জীবন যাপন করছে। তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্তও। আর্থিক দুরবস্থার কারণে তারা কিছু করতেও পারছে না। তাদের কথা বিবেচনা করেই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৪
আপনার মতামত জানানঃ