সভ্য দেশের গণকর্মচারীরা অর্থাৎ জনগণের করের পয়সায় যাদের বেতন হয়, তারাই জনগণকে বা সেবাগ্রহীতাকে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বলেন। তবে আমাদের দেশে বিষয়টি উল্টো। এখানে সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তি তো বটেই, দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারীরাও প্রত্যাশা করেন বা মনে করেন, সেবাগ্রহীতারাই তাদের ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বলবেন। তাদের ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ সম্বোধন না করলে ক্ষেপে যান, কোথাও করেন মারধর। যার সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলায়।
সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে, সিংগাইর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুনা লায়লাকে স্যার বা ম্যাডাম না বলে আপা বলায় ইউএনও এর নির্দেশে এক ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে আহত করেছে এমন অভিযোগ উঠেছে থানা পুলিশের বিরুদ্ধে। বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) বিকেল সারে পাঁচটার দিকে উপজেলার ধল্লা ইউনিয়নের জায়গীর বাজার বাস স্ট্যান্ডে এমনটি ঘটে। আহত ব্যবসায়ী জয়মন্টপ এলাকার গৌর চন্দ্র দাসের ছেলে তপন দাস।
জানা গেছে, সরকার ঘোষিত লকডাউন কার্যকরে বের হন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুনা লায়লা। তারই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার বিকেলে জায়গীর বাজারে সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে অভিযান চালান তিনি। এ সময় প্রিতম জুয়েলার্স খোলা থাকায় ওই দোকানে ঢুকে একাধিক ক্রেতা ও দোকান মালিক তপন চন্দ্র দাশকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের এ্যাক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট ইউএনও রুনা লায়লা জরিমানা করেন। একপর্যায়ে তপনকে শাসানো হলে ইউএনওকে আপা বলে ক্ষমা চান। এতে ইউএনও ক্ষিপ্ত হলে তার সাথে থাকা পুলিশ বাহিনীর এক সদস্য ওই ব্যবসায়ীকে লাঠিপেটা করেন।
সংবাদ মাধ্যমকে তপন দাস বলেন, পেশায় তিনি একজন স্বর্ণকার। জায়গীর বাজারে তার দোকান রয়েছে। খরিদ্দারের চাপের মুখে পড়ে ওই সময় দোকান খোলার অপরাধে ইউএনও তাকেসহ খরিদ্দারদের জরিমানা করেন। এ সময় তিনি স্যার না বলে ক্ষমা চেয়ে আপা বললে ইউএনও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে কেন আপা বললি বলেই পুলিশ লাঠি দিয়ে তার শরীরে আঘাত করতে থাকে।
জরিমানা এবং মারধরের কথা স্বীকার করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুনা লায়লা সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, অনেকেই আমাকে আপা এবং খালাম্মা তো বলেই। এর জন্য মারধর করা হয়নি। লকডাউন না মেনে দোকান খোলার অপরাধে তাকে মারধর করা হয়েছে এবং জরিমানা আদায় করা হয়েছে।
অভিযুক্ত পুলিশ কনস্টেবল রফিক বলেন, ইউএনও লাঠি দিয়ে বারি দিতে বলছে বলেই আমি তার নির্দেশ পালন করছি এতে আমার কোনো দোষ নেই।
থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শফিকুল ইসলাম মোল্ল্যা বলেন, স্যার না বলে আপা বললেই তাকে মারতে হবে কেন? মারার ঘটনা সত্য।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর আগেও নানা সময়ে ‘স্যার’ না বলায় সরকারি কর্মচারীদের ক্ষুব্ধ বা রুষ্ট হওয়ার খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে। আমাদের দেশের সরকারি কর্মচারী, বিশেষ করে যারা নিজেদের কর্মকর্তা ও ভিআইপি ভাবতে পছন্দ করেন, তারা যে রকম দাপট ও ক্ষমতা ভোগ করেন, তা বিশ্বের বহু দেশেই অকল্পনীয়।
তারা বলেন, অস্বীকার করা যাবে না, কিছু মানুষকে সবাই স্বপ্রণোদিত হয়েই ‘স্যার’ সম্বোধন করেন। বিশেষত শিক্ষকদের। এটিই স্বাভাবিক; কিন্তু একজন ইউএনও, ম্যাজিস্ট্রেট, বা পুলিশ কর্মকর্তা যদি মনে করেন— জনগণ তাদের ‘স্যার’ বলবে বা বলতে বাধ্য, সেটি ওই কলোনিয়াল মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ। তবে সাধারণ মানুষ যদি একজন ইউএনওকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেন, তাতেও দোষের কিছু নেই। এটি মানুষে মানুষে ভিন্নতা হতে পারে। কেউ হয়তো ‘স্যার’ বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কেউ হয়তো সম্মানার্থেও ‘স্যার’ বলেন; কিন্তু কোনো পাবলিক সার্ভেন্ট (গণকর্মচারী) যদি নিজেকে ‘কর্মকর্তা’ বা জনগণের প্রভু ভাবা শুরু করেন এবং তিনি যদি মনে করেন, তাকে ‘স্যার’ বলেই সম্বোধন করতে হবে— তাহলে এটি তার মানসিকতার সমস্যা।
তারা বলেন, পশ্চিমা বিশ্বে সরকারি বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেবা নিতে গেলে সেখানকার কর্মীরাই সাধারণকে ‘স্যার’ সম্বোধন করে জানতে চান, কী উপকার করতে পারেন তারা। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে এটি কখনো দেখা যায় না। জনহণকে স্যার ডাকতে পুলিশকে নির্দেশনা দিয়েও তা করা যায়নি।
তারা বলেন, এটা ঔপনিবেশিক মানসিকতা। একটি স্বাধীন দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের এমন মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এমন মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১০০
আপনার মতামত জানানঃ