পিরিয়ডের সময় নারীরা যাতে মন্দিরে বা দরগায় যেতে পারে সে দাবি জানিয়ে নারী সংগঠনগুলো বিভিন্ন সময়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে। সোসাল মিডিয়াতেও পিরিয়ডের সময় মেয়েদের ‘অশুচি’ বলার বিরুদ্ধে আন্দোলন চালানো হয়েছে। অথচ মানুষ যখন মহাকাশ জয়ে ব্যস্ত, তখনও ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের অনুন্নত জেলা গাডচিরোলির মাদিয়া সম্প্রদায়ে প্রতি মাসেই হাজার হাজার নারী এবং কিশোরীকে পিরিয়ডের সময় হলেই পাঠিয়ে দেয়া হয় বসবাসের অযোগ্য কুঁড়েঘরে। সেখানে দুর্বিষহ সপ্তাহ কাটাতে হয় তাদের। তবে কিশোরীরা কিন্তু নিজ ইচ্ছেতে থাকেনা। তাদেরকে থাকতে বাধ্য করা হয়। ভারতের এই গ্রামে এখনও পিরিয়ডের সময় নারীদের অশুচি বলে বিবেচনা করে এসব ঘরে রাখা হয়। পাশাপাশি তাদের কঠোর বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয়।
‘কুর্ম ঘর বা গাওকর’
পিরিয়ডের সময়কালে যেসব ঘরগুলোতে নারীদের রাখা হয় সেগুলোকে স্থানীয়ভাবে ‘কুর্ম ঘর বা গাওকর’ বলা হয়। জঙ্গলের কিনার ঘেঁষে গ্রামের একেবারে বাইরে এই কুঁড়েঘরগুলো নির্মাণ করা হয়। বলা যায়, পিরিয়ডের পাঁচ থেকে সাতদিন তাদেরকে ‘একঘরে’ হয়ে থাকতে হয়।
ভারতীয় সমাজে দীর্ঘদিন ধরেই পিরিয়ডের সময় মেয়েদের সামাজিকভাবে একটা নিষেধের আবহে কাটাতে হয়। মাসিকের সময় নারীদের অশুচি বলে বিবেচনা করা হয় এবং তাদের কঠোর বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয়। তাদের এসময় সামাজিক ও ধর্মীয় সব অনুষ্ঠানে যোগদান নিষিদ্ধ করা হয়।
তার প্রতিবেশি ৪৫ বছরের দুরপাতা উসেন্দি বলেন, দশ বছর আগে ২১ বছরের এক নারী ওই কুঁড়েতে থাকার সময় সাপের কামড়ে মারা যায়। মাঝরাতের পর আমাদের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তখন কাঁদতে কাঁদতে আর চেঁচাতে চেঁচাতে সে কুঁড়ে থেকে ছুটে বাইরে যায়। তার নারী স্বজনরা তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিল, তাকে কিছু লতাপাতা আর স্থানীয় ওষুধ এনে দিয়েছিল।
তবে মহারাষ্ট্রের অন্যতম দরিদ্র ও অনুন্নত একটি জেলা গাডচিরোলির মাদিয়া সম্প্রদায়ের নারীদের মাসিকের সময় সমাজে চরম বিধিনিষেধের মুখে থাকতে হয়, যা সামাজিক বিধিনিষেধের অন্য সব ঘেরাটোপকেও ছাড়িয়ে যায়। তাদের এসময় মন্দির বা কোন ধর্মীয় সৌধে, এমনকি রান্নাঘর কিংবা কুয়াতেও যাওয়া নিষেধ।
নারী আত্মীয়দের দেয়া খাবার ও পানি খেয়ে তাদের দিন কাটাতে হয়। যদি কোন পুরুষ তাদের ছুঁয়ে ফেলে, তাহলে ওই পুরুষকে সঙ্গে সঙ্গে গোসল করতে হয়। কারণ ওই নারীকে ‘অপবিত্র’ মনে করা হয়।
ভুক্তভোগীদের অসহনীয় দুর্ভোগ
গ্রামের বাসিন্দা ৩৫ বছরের সুরেখা হালামি জানান, গ্রীষ্মকালে ওই কুঁড়েতে অসহনীয় গরম থাকে, আর থাকে মশার উৎপাত। শীতকালে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর বর্ষায় ঘরের চাল দিয়ে অনবরত পানি পড়ে ঘরের মাঝখানে পুকুর হয়ে যায়। কখনও কখনও কুকুর আর শূকরও ভেতরে ঢুকে আসে।
অন্য এক নারী ২১ বছরের শীতল নারোতে বলন, কুঁড়েঘরে একা থাকলে সারা রাত ঘুম আসে না ভয়ে। ভেতরে আর বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমি বাড়ি যেতে চাই সর্বক্ষণ, কিন্তু কোন উপায় তো নেই।
তার প্রতিবেশি ৪৫ বছরের দুরপাতা উসেন্দি বলেন, দশ বছর আগে ২১ বছরের এক নারী ওই কুঁড়েতে থাকার সময় সাপের কামড়ে মারা যায়। মাঝরাতের পর আমাদের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তখন কাঁদতে কাঁদতে আর চেঁচাতে চেঁচাতে সে কুঁড়ে থেকে ছুটে বাইরে যায়। তার নারী স্বজনরা তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিল, তাকে কিছু লতাপাতা আর স্থানীয় ওষুধ এনে দিয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, পুরুষরা, এমনকি তার নিজের পরিবারের পুরুষরাও দূরে দাঁড়িয়ে দেখেছে। কিন্তু তার যেহেতু মাসিক চলছিল তারা ওকে ছুঁতে পারেনি, কারণ ঋতুর সময়ে মেয়েরা যে অশুচি। সাপের বিষ তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লে সে যন্ত্রণায় মাটিতে পড়ে কাতরাতে থাকে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মারা যায়।
সহায়তা নাকি প্রথা টিকিয়ে রাখা?
সম্প্রতি মুম্বাইয়ের খেরওয়াদি সোসাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন এই নারীদের সাহায্য করতে ভেঙে পড়া কুঁড়েঘরের জায়গায় আধুনিক পাকা ঘর তোলার একটি প্রকল্প শুরু করে।
গত কয়েক বছরে এরকম ২২৩টি মাসিকের কুঁড়েঘর তারা ঘুরে দেখেছেন, যার মধ্যে ৯৮% অনিরাপদ এবং সেখানে কোন শৌচাগার নেই। গ্রামবাসীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে তার তৈরি একটি রিপোর্ট থেকে তিনি জানান ‘কুর্ম ঘরে থাকার সময় অন্তত ২১জন নারী মারা গেছে, যাদের মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব ছিল।’
কিন্তু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির এই কাজ নিয়ে জোর সমালোচনা শুরু হয়েছে যে তারা এই অমানবিক প্রথা বিলোপের বদলে তাকে টিকিয়ে রাখারই উদ্যোগ নিয়েছে। তবে মুম্বাইয়ের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তৈরি প্রথম আধুনিক পাকা ঘরকে স্বাগত জানিয়েছেন টুকুম গ্রামের নারীরা।
এই বিরোধিতার কারণ সমালোচকদের মতে, মাসিকের সময় মেয়েদের আলাদা করে রাখার জন্য তৈরি এই কুঁড়েঘরগুলো একেবারে ভেঙে ফেলাটাই সময়োপযোগী পদক্ষেপ হতো।
যদিও সংগঠনটি বলছে এই নারীদের জন্য পাকা ঘর, টয়লেট, ঘুমানোর বিছানা, পানি ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে দিয়ে তারা নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইছে। তারাও এই প্রথা বিলোপের পক্ষে।
গ্রামের নারীরে এই পাকা ঘর প্রসঙ্গে বলেছেন, সবচেয় বড় কথা ঘরের ভেতর টয়লেট আছে আর দরোজা লক করার ব্যবস্থা আছে।
ওই এলাকায় কাজ করে ‘স্পর্শ’ নামে স্থানীয় আরেকটি বেসরকারি সংস্থা, যার প্রেসিডেন্ট দিলীপ বারসাগাড়ে বলছেন, গত কয়েক বছরে এরকম ২২৩টি মাসিকের কুঁড়েঘর তারা ঘুরে দেখেছেন যার মধ্যে ৯৮% অনিরাপদ এবং সেখানে কোন শৌচাগার নেই।
তারা ভয় পান এই প্রথা ভাঙলে ঈশ্বর তাদের ওপর রুষ্ট হবেন এবং তাদের পরিবারের ওপর মৃত্যু ও অসুস্থতার অভিশাপ নেমে আসবে। ‘আমার মা, আমার দাদী প্রত্যেকে প্রতি মাসে কুর্ম ঘরে গেছেন, আমিও যাচ্ছি প্রত্যেক মাসে। একদিন আমার মেয়েকে আমি সেখানে পাঠাব’।
গ্রামবাসীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে তার তৈরি একটি রিপোর্ট থেকে তিনি জানান ‘কুর্ম ঘরে থাকার সময় অন্তত ২১জন নারী মারা গেছে, যাদের মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব ছিল।’
‘আমার মেয়েকে আমি সেখানে পাঠাব’
কয়েক বছর আগে প্রকাশিত এক রিপোর্টের পর ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকারকে এই প্রথা উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়ে তারা বলছিল, এই প্রথা নারীদের মানবাধিকার চরমভাবে লংঘন করছে, তাদের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য এবং সম্মান ব্যাপকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে।
কিন্তু তার পর অনেকগুলো বছর গড়িয়ে গেলেও ওই প্রথা এখনও মাদিয়াদের সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত রয়ে গেছে। টুকুম এবং আশেপাশের গ্রামগুলোর কোনও নারীই ‘মাসিকের কুঁড়েতে’ যেতে চায় না। সেখানে কোন কিছুর সুবন্দোবস্ত নেই, যেটা তদের ক্ষিপ্ত করে। কিন্তু কয়েক শতাব্দী প্রাচীন এই প্রথা বদলানোর কোন ক্ষমতা তাদের নেই।
সুরেখা হালামি জানান, তারা ভয় পান এই প্রথা ভাঙলে ঈশ্বর তাদের ওপর রুষ্ট হবেন এবং তাদের পরিবারের ওপর মৃত্যু ও অসুস্থতার অভিশাপ নেমে আসবে। ‘আমার মা, আমার দাদী প্রত্যেকে প্রতি মাসে কুর্ম ঘরে গেছেন, আমিও যাচ্ছি প্রত্যেক মাসে। একদিন আমার মেয়েকে আমি সেখানে পাঠাব’।
গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি চেন্ডু উসেন্দি বলেন, এই প্রথা বদলানো যায় না কারণ এটা ঈশ্বরের বিধান। এই প্রথা না মানলে শাস্তি পেতে হয়। যে প্রথা ভাঙে তাকে সারা গ্রামের মানুষকে মাংস ও মদ খাওয়াতে হয়, সেই সাথে আর্থিক জরিমানাও দিতে হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/৪০১৫
আপনার মতামত জানানঃ