মাদ্রাসা নিয়ে বিতর্কে যেন রাবণের চিতা। থামবার নাম নেই। বহুকাল ধরেই মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকদের নির্যাতন, নিপীড়ন, এমনকি যৌন নিগ্রহের ঘটনা ঘটে আসছে। এইসব ঘটনা এতো বেশি মাত্রায় ঘটেছে যে কোমলমতি শিশুদের উপর মাদ্রাসা শিক্ষকদের বর্বর নির্যাতনের মানুষের চোখে সয়ে গেছে। স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে যৌন নিগ্রহ এমনকি ধর্ষনের ঘটনাও। এর পেছনে সামাজিক কারণে বাড়াবাড়ি যতোটা, তার থেকে বেশি প্রভাব ধর্মীয় মূর্খতার। আর ধর্মের নামে বাঙালিকে নির্যাতনের করার ইতিহাস বহু পুরনো।
এই করোনা মহামারিতে বন্ধ আছে মাদ্রাসা। সরকারও এই শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়মনীতির নামে বিভিন্নভাবে বিধিনিষেধ আরোপের চেষ্টায় আছে। অন্যদিকে মাদ্রাসা খুলে দিতে চাইছে হেফাজতে ইসলাম। তবে সবকিছু ছাপিয়ে যে ঘটনা মাদ্রাসার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের ভাবতে বাধ্য করছে তা হলো, বগুড়ায় মাদ্রাসা বন্ধ করতে তিন শিক্ষার্থী ওই মাদ্রাসারই অন্য এক শিক্ষার্থীকে খুন করেছে। আর কারণ হিসেবে বলছে, তারা মাদ্রাসায় পড়তে চায় না।
মাদ্রাসা বন্ধ করতে শিক্ষার্থীকে হত্যা
মাদ্রাসায় পড়তে ভালো লাগে না। তাই মাদ্রাসা বন্ধ করতে ৭ বছরের এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে হত্যা করল অন্য তিন শিক্ষার্থী। অবাক করার মতো এই ঘটনা ঘটেছে বগুড়ার শিবগঞ্জের বেলতলী হাফেজিয়া মাদ্রাসায়। নিহত শিক্ষার্থীর নাম স্বাধীন। গ্রেফতারকৃত তিন শিক্ষার্থীর স্বীকারোক্তি থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র মতে, হত্যাকাণ্ডের প্রায় ৬ মাস পর বগুড়া ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) হাতে আটক সুমন ইসলাম (১৬), রুহুল আমিন (১৬) ও ওমর ফারুক (১৫) মঙ্গলবার বিকেলে বগুড়ার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডি বগুড়া অফিসের ইন্সপেক্টর খন্দকার ফুয়াদ রুহানি জানান, প্রায় সাড়ে তিন মাসের তদন্ত শেষে গত ৫ জুলাই সন্ধ্যার পর অভিযান চালিয়ে শিবগঞ্জ উপজেলার তালপুকুরিয়া গ্রামের আফজাল হোসেনের ছেলে সুমন ইসলাম, মাটিয়ান গ্রামের মেহেদুল ইসলামের ছেলে রুহুল আমিন ও বাহাদুরপুর গ্রামের জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে ওমর ফারুককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিজেদের হেফাজতে নেন। তারা একই মাদ্রাসার বিভিন্ন শ্রেণীর ছাত্র।
মাদ্রাসায় পড়তে তাদের ভালো লাগত না। তাই তারা এমন কিছু করতে চেয়েছিল যাতে কর্তৃপক্ষ মাদ্রাসা বন্ধ করতে বাধ্য হয়। তারা মনে করেছিল, মাদ্রাসার কোনো এক ছাত্রকে খুন করলে মাদ্রাসাটি চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে, আর তাদের সেখানে পড়তেও যেতে হবে না।
মি. ফুয়াদ জানান, অভিযুক্তরা শিশু হওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী একজন প্রবেশন অফিসারের উপস্থিতিতে শিবগঞ্জ উপজেলার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিস্কৃতি হাগিদক তাদের জবানবন্দী ১৬৪ ধারায় রেকর্ড করেন। পরে আদালত অভিযুক্তদেরকে যশোরে কিশোর সংশোধনাগারের সেফ হোমে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
তিনি আরও জানান, জবানবন্দীতে অভিযুক্তরা বলেছে যে মাদ্রাসায় পড়তে তাদের ভালো লাগত না। তাই তারা এমন কিছু করতে চেয়েছিল যাতে কর্তৃপক্ষ মাদ্রাসা বন্ধ করতে বাধ্য হয়। তারা মনে করেছিল, মাদ্রাসার কোনো এক ছাত্রকে খুন করলে মাদ্রাসাটি চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে, আর তাদের সেখানে পড়তেও যেতে হবে না। ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তারা সুযোগ খুঁজতে থাকে। এরপর চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি সন্ধ্যার পর স্বাধীন নামে একই মাদ্রাসার শিক্ষার্থীকে তারা হাতে পায়। পরে তাকে বেলতলী হাফেজিয়া মাদ্রাসা-সংলগ্ন নদীর পাড়ে নিয়ে গিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে।
স্বাধীন ওই মাদ্রাসার মক্তব বিভাগের ছাত্র ছিল। ওই ঘটনায় নিহত স্বাধীনের বাবা শাহ আলম শেখ ১৭ জানুয়ারি শিবগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করেন। সংশ্লিষ্ট আদালত মামলাটি সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দেন। এর পর গত ১৩ মার্চ মামলাটির তদন্তভার পান সিআইডি বগুড়া অফিসের ইন্সপেক্টর খন্দকার ফুয়াদ রুহানি।
মাদ্রাসা খুলতে চাইছে হেফাজতে ইসলাম
এদিকে, করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অলস সময় কাটাতে গিয়ে ছাত্ররা ‘লাইনচ্যুত’ হয়ে যেতে পারে ভেবে দুশ্চিন্তায় আছেন কওমি মাদ্রাসার পরিচালকরা।
হাটহাজারী মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক আশরাফ আলী নিজামপুরী বলেন, কওমি মাদ্রাসায় অনেক গরীব, এতিম ছাত্র আছে, তাদের সবকিছু দেখাশুনা করা হয় মাদ্রাসায়। মাদ্রাসা বেশি সময় বন্ধ থাকলে শিক্ষার্থীরা সংকটে থাকবে, সেজন্য মাদ্রাসা খুলে দেয়া জরুরি বলে তারা মনে করেন তিনি।
এখন যদি কওমি মাদ্রাসা মাসের পর মাস বন্ধ রাখা হয়, তাহলে ছাত্ররা বিচ্যূত হবে বা লাইনচ্যূত হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, কওমি মাদ্রাসায় অনেক গরীব, এতিম ছাত্র আছে, মাদ্রাসার শিক্ষকরাই যাদের অভিভাবক। তারা আবাসিকে থাকে। তাদের লালন পালন, খাওয়া-দাওয়াসহ সবকিছু দেখাশুনা করা হয় মাদ্রাসায়। এখন যদি কওমি মাদ্রাসা মাসের পর মাস বন্ধ রাখা হয়, তাহলে ছাত্ররা বিচ্যূত হবে বা লাইনচ্যূত হয়ে যাবে।
এবার, হেফাজতে ইসলামের মাদ্রাসা খুলে দেয়ার এই দাবি কতটা শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে, কতটা নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থার কথআ ভেবে, সেটা সংশ্লিষ্ট মহল খতিয়ে দেখবে, এটাই প্রত্যাশা। তবে শিক্ষার্থীদের মাদ্রাসায় পড়তে মুসলিম অভিভাবকদের মধ্যে যে একরোখা ভাব দেখা যায়, তা আদতে শিক্ষার জন্য কতটা সহায়ক তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১০১৫
আপনার মতামত জানানঃ