আলতাফ পারভেজ
সম্প্রতি বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বুদ্ধিজীবী প্রশ্নে আলাপ উঠেছে। এটা ভালো লক্ষণ। প্রত্যেক সামাজিক জনমন্ডলী এবং তাদের ভূমিকা নিয়ে কথা হওয়া দরকার। তবে নিন্দা বা প্রশংসা আকারে নয়– কথা হওয়া ভালো সমাজবিদ্যার জায়গা থেকে, সামাজিক অভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিবেচনার ওপর দাঁড়িয়ে। তাহলেই কেবল বুদ্ধিজীবির সামাজিক ভূমিকা সম্পর্কে একটা বোঝাপড়ার কাছাকাছি আসতে পারবো আমরা। বুদ্ধিজীবিতার বিষয়টি যে আদতে পুরোপুরি এক রাজনৈতিক প্রসঙ্গ সেটাও স্পষ্ট হবে তখন।
এ প্রসঙ্গে দুনিয়াজুড়ে অনেক ভালো আলোচনা আছে। তার মাঝে গ্রামসির কথাগুলো আপন শক্তিমত্তায় এখনও প্রবলভাবে বেঁচে আছে। তাঁর প্রিজন নোটবুকস-এ বিষয়ে অনেক ভাবনা, বিশ্লেষণ ও মন্তব্য আছে। সেসব নিয়ে গতবছর বই আকারে যা লিখেছিলাম তার কিছু চুম্বক অংশ অতি সংক্ষেপে এখানে তুলে ধরা হলো।
গ্রামসির বক্তব্যগুলো আমার অনুবাদ। মূল বইয়ে তারা বিস্তারিত রেফারেন্স আছে আগ্রহীদের জন্য।
বুদ্ধিজীবী মূলত দুই ধরনের
রাষ্ট্রপ্রশ্নে আলোচনার এক পর্যায়ে গ্রামসি হঠাৎ প্রশ্ন তুলেছিলেন মজলুমদের পরিসর থেকে শাসকশ্রেণীর আদর্শের পুরানো বন্ধন ছিন্ন করা যায় কীভাবে? উত্তরও দেন তিনি, এভাবে:
`পর্যালোচনামূলক মনোভাবের বিকাশ ঘটিয়ে কেবল পুরানো ভাবাদর্শের বন্ধন ছিন্ন করা যায়।…এরকম পর্যালোচনামূলক মনোভাব তৈরি হয় বিপরীত আদর্শের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্যদিয়ে।… এই সংগ্রাম ঐতিহাসিকভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্ব দাবি করে। …জনতা অনেক সময় শাসক শ্রেণীর সাংস্কৃতিক ছকের বাইরে ‘নিজে নিজে’ তার অবস্থান ও শক্তিকে ‘শনাক্ত করতে সক্ষম’ হয় না…এই পটভূমিতেই যেকোন সংগঠন বুদ্ধিজীবী-ক্যাডার দাবি করে… যেভাবে থাকে সেখানে সংগঠক এবং নেতৃবৃন্দ…।‘
খেয়াল করলে আমরা দেখবো গ্রামসির এই বক্তব্যে দুটি বিষয় এসেছে। এক. শ্রেণী সচেতনতা আদর্শিক সংগ্রামেরই দ্বান্দ্বিক ফসল। যে ভাবাদর্শিক সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন বিভিন্ন সামাজিকদলভুক্ত বুদ্ধিজীবীরা– পেশায় তাঁরা হতে পারেন চিকিৎসক, আইনজীবী, মওলানা বা কৃষক। যাঁদের তিনি বলেছেন ‘অর্গানিক ইনটেলেকচুয়াল’। এরা কোন ‘শ্রেণীর ভেতরকার নিজস্ব বুদ্ধিজীবী’।
বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীর নিজস্ব বুদ্ধিজীবীদের বাইরে সমাজের অপর বুদ্ধিজীবীদের গ্রামসি বলেছেন traditional বা গতানুগতিক বুদ্ধিজীবী। যারা প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃত্বের আওতার বাইরে থেকে নিজের বিশ্বাসমতো সত্য ভাষণে লিপ্ত থাকে। কোন শ্রেণীর বিকাশ অবলম্বন করে আবিভূত নন তারা। অনেকটা যেন ‘প্রাচীন পরম্পরার প্রতিনিধি’– লেখক, শিল্পীরা। যারা সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের তাগিদে নির্বিকার থাকতে পছন্দ করেন।
এভাবে গ্রামসির কাছে মোটাদাগে আমরা বুদ্ধিজীবিতার দুটো শ্রেণী পেলাম।
‘সব মানুষই বুদ্ধিজীবী’
বুদ্ধিজীবীদের দুটি ভাগে আলাদা করার পর গ্রামসি এও বলেন, সব মনুষই বুদ্ধিজীবী– সবাই তাদের পেশাগত ক্রিয়ার বাইরে কোন না কোন বুদ্ধিগত ক্রিয়ায় লিপ্ত। প্রত্যেকের রয়েছে একটা বিশ্বদর্শন এবং বিশ্ববোধ। তবে সবাই সমাজে বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা পালন করে না। সেজন্য গ্রামসির কাছে ‘বুদ্ধিজীবী’ মানে মূলত ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক বর্গের ভেতরকার বুদ্ধিজীবী। কোন না কোন সামাজিক গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা সামাজিক স্বার্থের পক্ষে কথা ও কাজে থাকা মানুষ।
বুদ্ধিজীবী গ্রামসির কাছে আলাদা কোন সামাজিক বর্গ নয়, বরং প্রধান প্রধান সামাজিক বর্গের সামাজিক লক্ষ্যের পক্ষে সম্মতি আদায়কারী। আর যদি সম্মতি আদায় করা না যায়– তাহলে জনতার উপর রাষ্ট্রের ক্ষমতাতন্ত্রের প্রয়োগকে ন্যায্যতা দেয়া তাদের কাজ হতে পারে। অধিপতিশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের সেটা বড় ‘দায়িত্ব’।
অর্থাৎ প্রভুশ্রেণীর বুদ্ধিজীবিতার কাজ হলো প্রভাবশালী সামাজিক শ্রেণীর স্বপক্ষে জনতার সম্মতি আদায়। জনতার উপর আইনের বলে ক্ষমতাতন্ত্রের চাপ সৃষ্টির পটভূমি তৈরি করা। গতানুগতিক বুদ্ধিজীবী পছন্দমতো মতাদর্শ সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু অঙ্গাঙ্গী বা অর্গানিক সম্পর্কে আবদ্ধ বুদ্ধিজীবিতা নিজ নিজ শ্রেণীর মতাদর্শ বহন করে এবং তার আধিপত্য নিশ্চিত করে।
বুদ্ধিজীবী বিদ্যাপীঠ থেকে আসে না
গ্রামসি যদিও বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই নানান স্তরের বুদ্ধিজীবীদের সম্প্রসারণ ঘটে তবে তিনি মূলত গুরুত্ব দেন এই বক্তব্যে যে, যেকোন বুদ্ধিজীবিতাই আসলে বিশেষ আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি থেকে উদ্বুদ্ধ। সাধারণভাবে বুদ্ধিজীবী তার শ্রেণীর ভাবাদর্শ ও আকাঙ্খার কথাই বলার কথা। তারাই কোন বিশেষ ভাবাদর্শের পক্ষে ন্যায্যতা তৈরি করে রাজনৈতিক পরিসরকে প্রভাবিত করে অথবা বুদ্ধিজীবীরা নিপীড়িতের সমর্থক হয়ে বিদ্যমান ভাবাদর্শের পরিবর্তনের কথা বলবে।
বুদ্ধিজীবীরা পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত গোষ্ঠীগুলোর ভাবাদর্শের সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়। যদি কোথাও নিপীড়িতের মাঝে তার অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর চৈতন্য কাজ করে তখন সেটা আসলে সেখানকার শাসক শ্রেণীর ভাবাদর্শের বিজয় হিসেবেই দেখতে হবে। আবার প্রথাগত বুদ্ধিজীবীরা যদি মজলুমের পক্ষ নেয়– সেই ‘আদর্শান্তর’কে এই জনগোষ্ঠীর বুদ্ধিজীবীদের বিজয় হিসেবে দেখতে হবে।
সমাজে বৈপ্লবিক সচেতনতার একটা স্তরে এমন হতে পারে; যখন শ্রমিক শ্রেণী তার আন্দোলনের মধ্যদিয়ে, তার নিজস্ব বুদ্ধিজীবীদের সাহায্যে ক্রমে প্রথাগত বুদ্ধিজীবীদের স্বপক্ষে আনে। এটাকে গ্রামসি বলেন, প্রথাগত বুদ্ধিজীবীদের ‘আত্মসাৎ’ করা বা মতাদর্শগতভাবে ‘জয়’ করা। এভাবে একটা ‘পাল্টা-হেজিমনি’ তৈরি হয়। বুর্জোয়ারা সবসময়ই সর্বহারা শ্রেণীর অর্গানিক বুদ্ধিজীবীদের ভাবনা, চিন্তা ও বিশ্লেষণের প্রচার বাধাগ্রস্ত করতে চায় মূলত এ কারণেই। তারা এই ‘পাল্টা যোগাযোগ প্রক্রিয়া’কে নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে দিতে অনিচ্ছুক। কিন্তু তারপরও সেটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারে। সে বিষয়েও গ্রামসির বিস্তারিত আলোচনা আছে।
বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক দল
গ্রামসির কাছে রাজনৈতিক কাজ প্রধানত বুদ্ধিজীবিতা। তিনি বলেন,
কোন রাজনৈতিক দলের সব সদস্যকেই বুদ্ধিজীবী বলে গণ্য করতে হবে এমন দাবি করলে তা হয়তো পরিহাস বা ব্যঙ্গের বিষয় হয়ে উঠতে পারে। অথচ কথাটা একটু ভেবে দেখলে বোঝা যাবে, এর চেয়ে যথার্থ কিছু হতেই পারে না।
অর্থাৎ কোন শ্রেণীর উন্মেষের সঙ্গে তার নিজস্ব বুদ্ধিজীবীদের উন্মেষ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ‘যে কোন শ্রেণীর সাংগঠনিক কাজই হলো নিজস্ব বুদ্ধিজীবী গড়ে তোলা, লালন করা।’ পুঁজিবাদী সমাজের মালিক শ্রেণী তাদের উৎপত্তি ও বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে গড়ে তোলে বা তোলার কাঠামো তৈরি করে প্রযুক্তিবিদ, অর্থনীতিবিদ, বিপণন বিশেষজ্ঞ ইত্যাদি। এসব করে মালিক শ্রেণী নিজেকে এদের শীর্ষদেশে নিজেদের স্থাপন করে। এটা উদ্যোক্তা শ্রেণীর ক্ষেত্রে যেমন সত্য– মজলুমের ক্ষেত্রেও একইভাবে সত্য।
নিজস্ব বুদ্ধিজীবী ছাড়া সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রধান শ্রেণীকে মোকাবেলা অধস্তন শ্রেণীর পক্ষে সম্ভব হয় না।
ফলে মজলুমকেও তার ভেতর থেকে নিজস্ব বুদ্ধিজীবী সৃষ্টি করতে হয়। যারা জনমানসে বিকল্প নীতিবোধ ও সাংস্কৃতিক ধ্যান-ধারণা গড়ে তোলে। যারা সমাজে তাদের মতাদর্শ ছড়ায় এবং সেই মতাদর্শের পক্ষে সম্মতি আয়ত্ত করে। ঐ সম্মত্তির সমর্থনেই সমাজে রূপান্তর ঘটে।
বুদ্ধিজীবীরা সমাজ পাল্টাতে যেভাবে মানুষকে তৈরি করে
আলোচনার প্রসঙ্গ হিসেবে বুদ্ধিজীবিতার গতানুগতিক কোন পর্যালোচনা হাজির করা প্রিজন নোটবুকস্-এ গ্রামসির লক্ষ্য ছিল না। বরং সমাজের রূপান্তর চিন্তাই এই আলোচনার প্রণোদনা হিসেবে কাজ করছিল। সেই সূত্রেই বুদ্ধিজীবী প্রসঙ্গের আলোচনায় রাজনৈতিক দলের বিষয় চলে আসে।
গ্রামসির বিবেচনায় যেকোন সামাজিক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে তাদের রাজনৈতিক দল। ‘দল’ হতে পারে প্রচলিত অর্থের রাজনৈতিক দল কিংবা রাজনৈতিক সংবাদপত্র– এমনকি ব্যক্তিদের ছোট কোন সংঘও। কোন শ্রেণীর যদি আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক দল নাও থাকে– তাদের বিভিন্ন স্বার্থ-সংঘ থাকতে পারে– সেগুলোই তাদের অনানুষ্ঠানিক ‘দল’। এরকম দলের সক্রিয়তার জায়গা হলো সিভিল সোসাইটি এবং পলিটিক্যাল সোসাইটি।
গ্রামসির মতে,
যেকোন সামাজিক শ্রেণী ততক্ষণ কেবল একটা বিশুদ্ধ অর্থনৈতিক সত্তা– যতক্ষণ না তারা নিজের শ্রেণী স্বার্থের সচেতনতার ওপর দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক দল আকারে সমাজে হাজির না হচ্ছে। আর ঐ শ্রেণীকে এভাবে গঠন ও পুনর্গঠন করে সেই শ্রেণীর অঙ্গীভূত বুদ্ধিজীবীরা (organic intellectuals)। এই প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়েই সেই শ্রেণীর ‘ইচ্ছা’র একটা সম্মিলিত অবয়ব তৈরি হয়। সে অনুযায়ী বাস্তব ‘পদক্ষেপ’ নেয় তারা। আর এভাবে পুরো দলই ‘সম্মিলিত বুদ্ধিজীবী’ হয়ে ওঠে। তাদের ‘ইচ্ছা’ পরিণত হয় ‘জাতীয় গণ-যৌথ-ইচ্ছা’য়। গ্রামসির ভাষায়, ‘রাজনৈতিক দলসমূহ বুদ্ধিজীবী বৃদ্ধির সহায়ক।
লক্ষ্য করার মতো বিষয়, এই পুরো আলাপের মধ্যে গ্রামসির প্রবল একটা অভিমত হলো পুঁজিতান্ত্রিক একটা সমাজ-রাষ্ট্রে পরিবর্তনবাদী শক্তি সরাসরি এবং অনিবার্যভাবে তৈরি হয়ে যায় না। সেটা তৈরি হয় যৌথ-সক্রিয়-নির্মাণের মাধ্যমে। অর্থাৎ এটা অবশ্যই একটা রাজনৈতিক দলের ব্যবহারিক কাজের ফল হিসেবে বের হয়ে আসে।
গ্রামসির মতে, সাধারণ মানুষের মধ্যে দুটি চৈতন্য কাজ করতে পারে। কিংবা তার চৈতন্যের দুটি বিপরীতমুখী দিকও বলা যায় একে। এর একটি হলো তার প্রতিদিনকার হাতে-কলমের কাজ থেকে পাওয়া চৈতন্য। যে চৈতন্য তাকে দেখায় প্রতিদিন তার অংশগ্রহণের মধ্যদিয়েই বিশ্ব কীভাবে পাল্টে যাচ্ছে। আরেক চৈতন্য সে অতীত-পরম্পরা থেকে পায় এবং পর্যালোচনা ছাড়াই যা গ্রহণ করে। এই শেষের চৈতন্যের এমন জোর থাকতে পারে যে, সেটা মানুষের সমালোচনামূলক আত্ম-উপলব্ধির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। রাজনৈতিকভাবে তাকে নিষ্ক্রীয় করে রাখতে পারে। এই মানুষ যদি তার শ্রেণীর হেজিমনির সংগ্রামে শামিল হয় তখনি তার মাঝে সমালোচনামূলক মন তৈরি হয়ে। তার এতদিনকার বিশ্ববোধ তখন এক পর্যালোচনামূলক বোধের স্তরে উন্নীত হয়। এই চৈতন্যে মানুষকে নিয়ে আসে ঐ শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীরা। এটা একটা ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া। এভাবেই বাস্তব রাজনৈতিক অগ্রগতি সূচিত হয়। বুদ্ধিজীবীরা একাজে সংগঠক ও নেতৃত্বের ভূমিকা নেয়।
[ বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখা যেতে পারে ‘গ্রামসি ও তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা’, ২০২১, প্রথমা প্রকাশন]
আপনার মতামত জানানঃ