জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে আটক হওয়া প্রায় দুই হাজার ৩০০ বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে মিয়ানমার জান্তা সরকার। বুধবার (৩০ জুন) দেশটির বিভিন্ন কারাগার থেকে তাদের মুক্তি দেওয়া হয়। এদিকে মিয়ানমারের কারাগারে বন্দি দেশটির গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চি ও ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টকে এখনই ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ।
২৩০০ বন্দিকে মুক্তি দিল মিয়ানমার জান্তা
মিয়ানমারের বিভিন্ন কারাগার থেকে ২৩০০ বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে জান্তা সরকার। মুক্তি পাওয়াদের মধ্যে সাংবাদিকও রয়েছেন। যারা বর্তমান সেনা-শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ নিয়ে লেখালেখি করতেন।
বৃহস্পতিবার (১ জুলাই) মিয়ানমারের উপ-তথ্যমন্ত্রী মেজর জেনারেল জ মিন তুন বলেছেন, যারা শুধু বিক্ষোভ করেছেন কিন্তু কোনো সহিংসতা করেনি, তাদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে অন্যদেরও মুক্তি দেওয়া হবে। তবে যারা সহিংসতায় যুক্ত ছিল তাদের আটক রাখা হবে।
অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের পর থেকেই মানবাধিকার সংস্থা ও পশ্চিমা দেশগুলোর সমালোচনার মুখে রয়েছে জান্তা সরকার। ১ ফেব্রুয়ারির এ অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশটিতে গণতন্ত্রকামীদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে আসছে সেনা প্রশাসন। যাতে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন অন্তত ৮৮৩ জন। আটক রাখা হয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার আন্দোলনকারীকে।
গত ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী অং সান সু চিকে অপসারণ ও বন্দি করে জাতীয় ক্ষমতায় আসীন হয় সামরিক বাহিনী। দেশটির সেনাপ্রধান মিন অং হ্লেইং এই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন।
কিন্তু অভ্যুত্থানের পরপরই ফুঁসে ওঠেন মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থি জনতা। ক্ষমতাসীন সামরিক সরাকারের পদত্যাগ ও সু চির মুক্তির দাবিতে দেশজুড়ে তারা শুরু করেন বিক্ষোভ ও আন্দোলন।
বিক্ষোভের প্রথম পর্যায়ে দৃশ্যত সহনশীল থাকলেও সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তা দমনে কঠোর তৎপরতা শুরু করে জান্তা। দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রাবার বুলেট, লাঠি, জলকামানের পাশাপাশি প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়, পাশাপাশি গ্রেপ্তার করা শুরু হয় আন্দোলনকারীদের।
মিয়ানমারের কারাবন্দিদের সহায়তা দানকারী বেসরকারী সংস্থা অ্যাসিসটেন্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স জানিয়েছে, এ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে ৮৮৩ জন নিহত হয়েছেন,এবং কারাগারে অন্তরীণ আছেন ৫ হাজার ২০০-এরও বেশি বিক্ষোভকারী।
কারা অন্তরীণদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে দেশটির প্রচলিত আইনের ৫০৫ (এ) পেনাল কোড অনুসারে মামলা করেছে জান্তা। মামলায় যারা দোষী বলে প্রমাণিত হবেন, তাদের তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।
গ্রেপ্তারদের মধ্যে মিয়ানমারের অভিনেতা, ক্রীড়াব্যক্তিত্ব, সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারসহ বিভিন্ন অঙ্গণের সেলিব্রেটিরাও আছেন। অবশ্য দেশটির সামরিক বাহিনী পরিচালিত টিভি চ্যানেল মিয়াওয়াদি টেলিভিশনে সম্প্রতি প্রচারিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন অঙ্গণের ২৪ জন সেলিব্রেটির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা বিষয়ক অভিযোগ তুলে নেওয়া হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে গত ১৮ জুন মিয়ানমারের ওপর অস্ত্রনিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। দেশটির জান্তা সরকারের প্রতি একটি নিন্দাপ্রস্তাবও গৃহীত হয়েছে সেখানে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মিয়ানমারের ওপর অস্ত্রনিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাবে সমর্থন দিয়েছে ১১৯টি দেশ। স্বৈরশাসিত বেলারুশই একমাত্র এর বিপক্ষে মত দেয়। আর চীন-রাশিয়াসহ মোট ৩৬টি দেশ প্রস্তাবে মতামত দেয়া থেকে বিরত থাকে।
ঠিক তার কিছুদিন পর (২১ জুন) রাশিয়া সফরে যায় জান্তাপ্রধান। ধারণা করা হচ্ছে বিদেশে রাষ্ট্রীয় সফরের মাধ্যমে জান্তা সরকার বহির্বিশ্বে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর চেষ্ট করছে। রাশিয়া সফরে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাবিষয়ক সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং। যেখানে তিনি নিজদেশ মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন।
এর আগে গত ২৪ এপ্রিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক জোট আসিয়ান সম্মেলনে যোগ দিতে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় গিয়েছিলেন মিন অং হ্লাইং। মিয়ানমারের জান্তাপ্রধান ছাড়াও সে সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আসিয়ানভুক্ত ১০টি দেশের প্রতিনিধিরা। সেসময় তারা মিয়ানমারের বর্তমান সংকট নিয়ে আলোচনা করেছিলেন।
এদিকে মিয়ানমারের চলমান সেনা শাসনের বিরুদ্ধে জনঐক্যের ডাক দিয়েছেন দেশটির ক্ষমতাচ্যুত গণতন্ত্রপন্থী নেতা অং সান সু চি। ২৯ জুন আদালতে হাজির হয়ে নিজের আইনজীবীকে এমনটা জানান তিনি।
সু চিকে মুক্তির আহ্বান জাতিসংঘের
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে দেশটির গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চি ও ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টকে এখনই ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। দেশটির বিভিন্ন কারাগার থেকে কয়েক হাজার বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার পরদিন এ আহ্বান জানাল জাতিসংঘ।
বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের এক মুখপাত্র এ কথা জানান বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
জাতিসংঘ মহাসচিব সু চি ও উইন মিন্টের মুক্তির আহ্বান জানিয়েছেন উল্লেখ করে এরি কানেকো সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা আগেও বহুবার বলেছি, আবারও বলছি- অবিলম্বে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট ও স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চিসহ সব কারাবন্দিকে মুক্তি দিন।’
এছাড়াও তিনি আরো বলেন, ‘মিয়ানমারে অব্যাহত সহিংসতা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর নির্বিচারে গণগ্রেপ্তারসহ মানুষকে ভয় দেখানোর কর্মকাণ্ড নিয়ে আমরা এখনও গভীরভাবে উদ্বিগ্ন’।
গত ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর আটক করা হয় ৭৫ বছর বয়সী সু চিকে। পরে তাকেসহ গৃহবন্দি করা হয় ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে।
গৃহবন্দি অং সান সু চির বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রচারণায় স্বাস্থ্যবিধি ভঙ্গ, লাইসেন্স ছাড়া ওয়াকিটকির ব্যবহারসহ মোট ছয়টি অভিযোগের বিচার চলছে। যা শেষে হতে সময় লাগতে পারে জুলাইয়ের শেষ পর্যন্ত। সু চির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো আর্থিক দুর্নীতি। এর দায়ে ১৫ বছরের জেল হতে পারে তার।
সু চির পাশাপাশি অভ্যুত্থানে উৎখাত হওয়া দেশটির কারাবন্দি প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টের বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা করেছে সামরিক সরকারের লোকজন।
সু চিসহ সব রাজনৈতিক কারাবন্দিদের মুক্তি ও সামরিক সরকারের পদত্যাগের দাবিতে এখনও বিক্ষোভ চলছে মিয়ানমারে। সামরিক বাহিনীর নির্দেশে আন্দোলনকারীদের ওপর দমন-পীড়নও অব্যাহত রেখেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২৯
আপনার মতামত জানানঃ