‘একে যুদ্ধ বলে না, এ ছিল গণহত্যার ব্যাপার। তারা আত্মসমর্পণ করতে জানত না। যতক্ষণ তাদের নাগরা বাজবে, তারা সকলেই দাঁড়িয়ে পড়বে, তীর ছুড়তে থাকবে, গুলি খেয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে। তাদের তীরে সরকারি সৈন্যরাও মারা যেত। এই যুদ্ধে এমন সিপাই ছিল না যে নিজের কাছে লজ্জ্বিত বোধ না করত। বন্দীরা প্রায়ই ছিল আহত লোক। এমন সত্যবাদী আর সাহসী মানুষের দল আমি আর দেখিনি’, সেনাপতি মেজর জারভিস।
আজকের সাঁওতাল পরগণায় ১৭৯০-১৮১০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিরভূম থেকে জমিদারদের দ্বারা বিতারিত হয়ে সাঁওতালরা বসবাস শুরু করেছিল। অঞ্চলটিকে বলা হয় দামিন-ই-কোহ, অর্থ পাহাড়ের ঘাঘরা। এটা ছিলো পাহাড়িদের জন্য কলোনিয়াল সরকারের খাস জমি। এই রাজমহলের পাহাড়ের কাছে সমতলের জঙ্গল কেটে গড়ে তোলা হয় ছোট ছোট সাঁওতাল গ্রাম। প্রতিটি গ্রামেই ছিল নির্বাচিত একজন সর্দার। তাকে বলা হতো মাঝি। মাঝি ছাড়াও একটি গ্রামে ছিল একজন পরামাণিক, একজন গোরাইত, একজন যোগ-মাঝি, একজন দেশ-মাঝি। প্রতিটি গ্রাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ছিল এদের হাতে। আর কয়েকটি গ্রাম নিয়ে গঠিত হয় ‘সাঁওতাল পরগণা’।
জমিদারদের উৎপীড়নের মুখে শান্তিপ্রিয় সাঁওতালরা ঝাড়খণ্ড রাজ্যের ‘রাজমহল’ পাহাড়ের কাছাকাছি সমতলের জঙ্গল কেটে বিশাল ভূখণ্ড আবাদযোগ্য জমিতে পরিণত করে। তারা বিশ্বাস করতো, পতিত জমিতে যে প্রথমবার চাষ শুরু করে, সেই জমি তার। তবে রাজমহল পাহাড়ের নিকটবর্তী এলাকার নতুন পত্তনেও তাদের শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সাঁওতালদের আসার আগে সেখানে খাজনা আদায়ের ব্যাপারে কোনও কড়াকড়ি ছিল না। তবে যখনই সেই জমি থেকে ফসল ফলাতে শুরু করে সাঁওতালরা, তাদের উপর খাজনা আদায়ের জন্য শুরু হয় অত্যাচার।
তবে শুধু জমিদাররা নয়, সাঁওতালদের উপর অত্যাচার করেছে মহাজন, এমনকি স্থানীয় মধ্যবিত্ত হিন্দু ব্যবসায়ীরাও। মহাজনদের সুদে ঝুঁকে গিয়েছিল সাঁওতালদের কাঁধ। সমসাময়িক এক ইংরেজ লেখকের বর্ণনা থেকে জানা যায় সুদের হার ছিল ক্ষেত্রবিশেষে ৫০ থেকে ৫০০ শতাংশ। ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে শস্য, গবাদি পশু, এমনকি নিজে কিংবা নিজের পরিবারের সদস্যকে আজীবন বিক্রি করে দিতে হতো।
এদিকে সহজ সরল সাঁওতালদের প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা না থাকায় এদেরকে ওজনে কম দিয়ে ঠকাতো মহাজন ও হিন্দু ব্যবসায়ীরা। ঠকানোর জন্য কেনাবেচায় দুই ধরনের ঝুড়ি, দাড়িপাল্লা ব্যবহার করা হতো। গরীব সাঁওতাল যখন হাটে তার জিনিসপত্র বিক্রি করার জন্য নিয়ে আসতো তখন তা মাপা হতো বড় পাল্লায়। নকল তলা লাগানো কৌটায় মেপেও ঠকানো হতো এদের। আর লবণ, তেল ইত্যাদি দ্রব্যাদি কিনতে গেলে, ব্যবসায়ীরা তা হালকা ভরের বাটখারা দিয়ে ওজন করতো। প্রতিবাদ করেও কোনও লাভ হতো না।
তাই কঠোর পরিশ্রম করেও চাষের সময় বীজ কিনতে উচ্চ সুদে ধার করা ছাড়া উপায় থাকতো না তাদের। এরপর উৎপাদিত ফসল ঘরে তোলা মাত্রই হানা দিত মহাজন, জমিদার আর পাওনাদারেরা। এরপর আবার ঠকানো, বীজ কিনতে সুদ নেয়া। পাওনা আদায়ের নামে ফসল লুটপাট। এভাবেই অদ্ভুত এক চক্রের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল সাঁওতালরা।
তৎকালীন সময়ের আদালতের একটি মামলার সূত্র মতে, এক সাঁওতাল চাষী টাকা প্রতি ১২ আনা সুদে ২৫ টাকা ঋণ নিয়েছিল। একসময় পাহাড় পরিমাণ সুদে চাপা পড়ে পুরো জীবন ধরে দাসত্ব করেও সে সেই ঋণ শোধ করতে পারেনি। উত্তরাধিকারসূত্রে তার পুত্র, পৌত্রদের কাঁধেও ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়। পাকুড় জেলা থেকে চল্লিশ মাইল দূরের ভাগানডিহি গ্রামে এমনই এক অত্যাচারের নির্মম ঘটনা ঘটে। সিধু, কানু, চাঁদ আর ভৈরব নামে চার ভাইয়ের সাঁওতাল পরিবারটি ছিল অবস্থাসম্পন্ন। তবে মহাজনর সর্বশান্ত করে পরিবারটিকে। এতে পুরো এলাকার তরুণ সাঁওতালদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে।
গ্রামগুলোতে তারা বৈঠক করতে থাকে কীভাবে এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। সিধু আর কানুর নেতৃত্বে সংগঠিত হতে থাকে যুবকেরা। তীর-ধনুক নিয়ে মহড়া চলতে থাকে গ্রামগুলোতে। আশেপাশের সাঁওতাল গ্রামগুলোয় শালপাতা নিয়ে বার্তাবাহকেরা পৌঁছে গেল। ভাগনাডিহি গ্রামে সিধু আর কানুর কাছে চারদিক থেকে অসংখ্য সাঁওতাল আসা শুরু করেছিল। তবে সাঁওতালরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করবে বলে অনেকে জমিদার ও মহাজনেরা প্রচার করে পুলিশদের কান ভারী করছিল।
এদিকে, সাঁওতালরা শুধু ইংরেজদের কাছে তাদের দাবি দাওয়ার কথাগুলো বলতে চেয়েছিল। ইংরেজ লাটের কাছে সুদের নতুন ব্যবস্থা প্রণয়ন এবং অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য একত্রিত হয়েছিল। কলকাতায় গিয়ে লাটের সাথে দেখা করতে গিয়ে সেখান থেকে তারা থানার দারোগা, বীরভূমের জেলা শাসক, বিভিন্ন জমিদার আর মহাজনদের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখে জানিয়ে দেয় এই সমাবেশ শান্তিপূর্ণ এবং তারা শুধুমাত্র বর্তমান অবস্থার প্রতিকার চায়। বারবার প্রতিকার চেয়েও কোনো উত্তর তারা পায়নি।
কলকাতা অভিমূখে যখন রওনা হয়, তখন মূল দলেই ছিল ত্রিশ হাজার সাঁওতাল। তীর, ধনুক, টাঙ্গি, বর্শা আর দুই একদিনের খাদ্য নিয়ে তারা রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিল। রাস্তায় এই বিপুল মানুষের খাদ্য কীভাবে জোগাড় হবে তারা ভাবেনি। ইতিহাসবিদদের মতে, কিছু সাঁওতাল আশেপাশের জনপদে লুটপাট করে বলে জানা যায়। এতে পরিস্থিতি তাদের বিপক্ষে চলে যায়। স্থানীয় পুলিশ আর জমিদারদের লাঠিয়ালদের সাথে তার ছোটছোট লড়াই শুরু হয়। ভাগলপুর আর রাজমহলের মধ্যে রেল আর ডাক যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিছিন্ন করে দেয় সাঁওতালরা। বিভিন্ন ছোট বড় সড়কের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তাদের হাতে।
১৯ জুলাই তাদের দমন করতে প্রশাসন সামরিক আইন জারি করে। ১৩নং বাহিনী নিয়ে ক্যাপ্টেন ফ্রান্সিস, ৭নং বাহিনী নিয়ে লেফটেন্যান্ট লোকার্ত, ৪২নং বাহিনী নিয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল লিপট্রাপ সাঁওতালদের উপর বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণ করে। জমিদার আর নীলকরেরা সরকারের পাশে দাঁড়ায়। বন্দুকের গুলির সামনে দলবেঁধে তীর ধনুক নিয়ে যুদ্ধে নেমেছিল সাঁওতালরা। এদিকে, অনেক দলিল থেকে জানা যায় স্থানীয় জমিদাররা সৈন্য অভিযানে হাতি, ঘোড়া, অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিল। ইংরেজ বাহিনীর সাথে যুদ্ধে পেরে না উঠে দলে দলে সাঁওতালরা মারা যেতে থাকে। সাঁওতালদের বিদ্রোহের মাদলে সাড়া দিয়ে বাঙ্গালী এবং বিহারী হিন্দু-মুসলমান কৃষক আর কারিগরেরা এই বিদ্রোহে যুক্ত হয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে কামার, কুমোর, গোয়ালা, ডোম প্রভৃতি পেশার মানুষদেরকেও শোষণ করে আসছিল মহাজন আর জমিদাররা।
১৫ জুলাই মহেশপুরের সংঘর্ষে সিধু, কানু আর ভৈরব নিহত হয়। বিদ্রোহ দমনের নামে ইংরেজ সেনাদল সাঁওতাল গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেয়। ক্যাপ্টেন শেরবিল বারোটি গ্রাম জ্বালিয়ে দেন। ভাগনাডিহি গ্রামও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। খাবারের অভাব, রোগব্যাধি, তীব্র দমন পীড়নের কারণে শুরু থেকেই ভালো অবস্থানে ছিল না সাঁওতালরা।
১৭ আগস্ট সরকার দশ দিনের মধ্যে বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেয়। আত্মসমর্পণ করলে যাদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আছে তাদের বাদ দিয়ে বাকী সবাইকে ক্ষমা করে দেয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। বিদ্রোহীরা এই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে তাদের সংগ্রাম অব্যাহত রাখে। এই ঘটনায় সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসন সাঁওতালদের উপর ক্ষেপে যায়। বীরভূমের পালারপুরে ক্যাপ্টেন কোপির আদেশে প্রায় দেড় হাজার বিদ্রোহীকে হত্যা করা হয়। বিদ্রোহীদের অনেককে সিঊড়ি শহরের কেন্দুয়ার ডাঙ্গার স্কলের সামনে গাছে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেওয়া হয়। সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব, বীরসিং ছাড়াও শত শত নেতাকে হত্যা করা হয়। ফলে আন্দোলন নেতৃত্বশূন্য হয়ে যায়। এরপর বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন এলাকায় আক্রমণ করে বিদ্রোহী দমন করতে থাকে সরকারি বাহিনী। তার প্রতিবাদে তীর-ধনুক নিয়ে সাঁওতাল জনপদ বাঁধা দিতে থাকে। বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, ভাগলপুরসহ ঝাড়খণ্ডের বিস্তীর্ণ এলাকা লাল হয়ে ওঠে।
দমন পীড়ন থেকেও সরকার ধীরে ধীরে সরে আসে। দাবির পুরোটা মেনে না নিলেও দাবির কিছু অংশ মেনে নেয় সরকার। তাদেরকে সরকার দালিলিকভাবে ‘মাইনোরিটি’ বা সংখ্যালঘু জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সাঁওতালদের বাসের জন্য সাঁওতাল পরগণা নামে নতুন জেলা গঠন করা হয়।
আপনার মতামত জানানঃ