২০১৮ সালের জুন মাসে মেহবুবা মুফতির সঙ্গে বিজেপির জোট ভাঙার পরে জম্মু-কাশ্মীরে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হয়। এরপর ২০১৯ সালের আগস্টে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা রদ করে রাজ্যকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করে নরেন্দ্র মোদী সরকার। জম্মু ও কাশ্মীর পুনর্গঠন আইনে লাদাখ এবং জম্মু-কাশ্মীর নামে দু’টি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গড়া হয়। এরপর দুই বছরে অনেক জল গড়িয়ে গেছে, আর রক্তও। তবু শান্ত হয়নি কাশ্মীর।
এদিকে, ভারতীয় হিটলারের তকমা জুটেছে মোদির কপালে। করোনা ভাইরাসে বিধ্বস্ত ভারতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আগাগোড়া ব্যর্থ নরেন্দ্র মোদি, তার ডুবতে থাকা জনপ্রিয়তাকে আবার চাঙ্গা করতে খুঁড়ে বের করেছে কাশ্মীরকে। মিমাংসা চাইছেন নাকি বদলাতে চাইছে রাজনৈতিক হাওয়া, আলোচনার বিষয় আর সমালোচনার তীরের লক্ষ্য, এখনও স্পষ্ট নয়। সাম্প্রতিক কাশ্মীর ইস্যুতে তার ডাকা সর্বদল বৈঠককে ঘিরে কাশ্মীরের ভবিষ্যত নিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কিছুটা আশার আলোও দেখতে পাচ্ছে কাশ্মীরের নিপীড়িত মানুষেরা।
মোদির সর্বদল বৈঠক
কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সর্বদল বৈঠককে ঘিরে জম্মু-কাশ্মীর ফের পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা ফিরে পাবে কি না, তা নিয়ে ভারতীয় রাজনীতিতে শুরু হয়েছে জল্পনাকল্পনা।
কাশ্মীর পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য আগামী বৃহস্পতিবার (২৪ জুন) এই সর্বদল বৈঠক ডেকেছেন মোদি সরকার। উপত্যকার নেতারাও ডাক পেয়েছেন ওই বৈঠকে। বৃহস্পতিবারের সর্বদলীয় ওই বৈঠকে এখন পর্যন্ত ৯টি দল আমন্ত্রণ পেয়েছে। এছাড়া, মোট ১৬টি দলের নেতারা ডাক পেতে পারেন বলে জানা গেছে।
জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (পিডিপি)-র সভানেত্রী মেহবুবা মুফতি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বৈঠকের জন্য আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ পেয়েছি এবং আমরা বিষয়টি বিবেচনা করছি’।
এর আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে লোকসভায় ‘জম্মু ও কাশ্মীর পুনর্গঠন (সংশোধন) বিল’ পেশের সময় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জানিয়েছিলেন, ‘যখন কাশ্মীর বিভক্ত করা হয়েছিল, তখন কোথাও লেখা ছিল না যে ভূস্বর্গ রাজ্যের মর্যাদা ফিরে পাবে না। সঠিক সময়ে রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া হবে জম্মু ও কাশ্মীরকে।’ এর পরেই জল্পনা বাঁধে, উপত্যকাটিতে শান্তি ফেরাতে কৌশল বদলাতে পারে বিজেপি সরকার।
চলতি মাসে কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিংহ পাকিস্তানের একটি সংবাদমাধ্যমকে জানান, আগামী নির্বাচনে কংগ্রেস যদি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে, অনুচ্ছেদ ৩৭০ বিলোপের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা হবে। এরপর কংগ্রেসের সঙ্গে পাকিস্তানের গোপন আঁতাতের অভিযোগ তোলে বিজেপি। যদিও জম্মু কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ফারুক আবদুল্লা দিগ্বিজয়ের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।
কী ভাবছে ভারত?
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট জম্মু-কাশ্মীরের চিত্রটা পুরো বদলে গিয়েছিল। এরপর প্রায় দুই বছর হতে চলল, তবে রাজ্যের মর্যাদা ফিরে পায়নি জম্মু-কাশ্মীর। তবে এবার ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরের ‘পুনর্গঠনের’ পর প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক বৈঠক করতে যাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। যেখানে উপত্যকার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করতে সেখানকার স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলিকে ডাকা হবে।
সেই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলি বৈঠকে বসে কী আলোচনা করবে, সেদিকে তাকিয়ে রাজনৈতিক মহল। যদিও বৈঠকের নির্দিষ্ট তারিখ এখনও জানা যায়নি। তবে আগামী সপ্তাহে এই বৈঠক হবে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গিয়েছে।
এর আগে কাশ্মীর ইস্যুতে শুক্রবার একটি বৈঠক করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। এরপরই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর দফতরের পক্ষ থেকে এই বৈঠকের কথা জানিয়ে দেয়া হয়। এদিকে অমিত শাহের ডাকা এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জম্মু ও কাশ্মীরের লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহা, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল সহ উচ্চপদস্থ আধিকারিক এবং আমলারা।
সেই বৈঠকের পর অমিত শাহের দফতরের তরফে বলা হয় কাশ্মীরের সার্বিক উন্নয়নই কেন্দ্রের অগ্রাধিকার। এদিকে করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় কাশ্মীর প্রশাসনের দক্ষতাকে স্বাগত জানান অমিত শাহ। মনোজ সিনহাকে এই বিষয়ে শুভেচ্ছা জানান শাহ।
কেন মত পাল্টাচ্ছে ভারত?
বিশ্বব্যাপী মোদিকে হিটলারের ভার্চুয়াল পুনর্জন্ম এবং তার ফ্যাসিবাদী বিজেপিকে নাৎসি পার্টি রিডেক্স হিসাবে চিত্রিত করতে সফল হয়েছেন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। এদিকে, ইতিমধ্যেই বিজেপির বিভাজনমূলক রাজনীতি এবং মোদির স্বৈরাচারী শাসন নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে বিতর্ক। এতে করে ব্যাকফুটে চলে গেছেন নরেন্দ্র মোদি। তাই ইমেজ শুধরাতে কিছুটা নমনীয় হতে হচ্ছে তাকে।
এদিএক, করোনা ভাইরাসের প্রকোপে ভারতে যে অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি করেছে তা মোদির জনপ্রিয়তায় ধস নামিয়েছে। মারাত্মক সংক্রমণের ভয়াবহ প্রসারে মোদির মহাকাব্যিক ব্যর্থতা এই জনপ্রিয়তা হ্রাসকে আরও গতিশীল করেছে। সবমিলিয়ে মোদি তার ডুবতে থাকা রাজনৈতিক ভাগ্য বাঁচাতে পাকিস্তানের প্রতি বৈরিতা পরিত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন।
এছাড়া ভারত বিশ্বাস করে যে, তার প্রধান উদ্বেগ চীন। পাকিস্তান নয়। গত বছরই লাদাখের বিরোধপূর্ণ সীমান্তে সামরিক লড়াইয়ের পর চীন নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে ভারতের। যদিও উভয় পক্ষই আংশিক প্রত্যাহারে সম্মত হয়েছে, তবুও তাদের সেনা এখনও অঞ্চলে একাধিক স্থানে অবস্থান নিয়ে রয়েছে। এখনো মহামারিতে বিধ্বস্ত মোদির ভারত জানে যে, একই সাথে দুটি পরমণু-সমৃদ্ধ প্রতিপক্ষের সাথে সীমান্ত উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলা খাল কেটে কুমির আনার সামিল।
চীনের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা জোরদার করতে মনোযোগ বাড়াতে, পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের উন্নতি দরকার। আর আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে পাকিস্তান যে আবারও আমেরিকার স্পটলাইটে ফিরে এসেছে, তা ভালো করেই জানে মোদি সরকার। তাই কাশ্মীর ইস্যুতে বিবাদ মেটানোটা মোদির জন্য এখন সবথেকে ফায়াদামান রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হবে।
পাকিস্তানের অবস্থান
কাশ্মীর নিয়ে ছাড় দিতে নারাজ পাকিস্তান। এক কাশ্মীরকে ঘিরেই প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে সম্পর্ক মেরামতে দীর্ঘদিন অনীহা দেখিয়ে আসছে ইসলামাবাদ। তবে ভারতের সঙ্গে আবারও আলোচনা শুরু করতে প্রস্তুত পাকিস্তান, যদিও তার আগে ভারতকে কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন পুনর্বহালের পরিকল্পনা নিতে হবে বলে জানান পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।
এ মাসের প্রথম সপ্তাহে ইসলামাদের সরকারি বাসভবনে রয়টার্সকে এ কথা বলেন তিনি। এ সময় কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলকে জাতিসংঘের ঘোষণা এবং আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলেও উল্লেখ করেন ইমরান খান।
তিনি বলেন, যদি একটি রোডম্যাপ থাকে, তাহলে আমরা আলোচনা করব। এমনকি তারা যদি আমাদেরকে একটি রোডম্যাপও দেয় যে কাশ্মীরের মর্যাদা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে এসব পদক্ষেপ নেওয়া হবে, সেটাও গ্রহণযোগ্য হবে।
মার্চে পাকিস্তানের অর্থনীতি বিষয়ক শীর্ষ সিদ্ধান্ত-গ্রহণকারী পর্ষদ ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য শুরু করার সিদ্ধান্ত জানালেও সরকারের পক্ষ থেকে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। এ ব্যাপারে ইমরান খান বলেন, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে ভারত সীমা অতিক্রম করেছে। আমাদের সঙ্গে আলোচনা শুরুর আগে তাদের পূর্বের অবস্থানে ফিরতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬০০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ