দেশভাগের এক মাসের মধ্যেই পূর্ববঙ্গের রাজনীতির গদিতে জাঁকিয়ে বসে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা। যার প্রথম আঘাত ঢাকাতে জন্মাষ্টমী শোভাযাত্রায় মুসলিমদের আক্রমণ। এরপর ১৯৪৮ সালে নিষিদ্ধ করা হয় বিখ্যাত ধামরাই রথযাত্রা ও জন্মাষ্টমী শোভাযাত্রা এরপরের বছর ১৯৪৯ সালে সমগ্র ঢাকা অঞ্চলে বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপুজোর বিরুদ্ধে পোস্টার লাগানো হয়। এতে করে দুর্গাপুজোর আয়তন ও সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে হ্রাস পায়। তবে এখানেই থেমে থাকেনি সাম্প্রদায়িকতার দখলদারিত্ব। বিজয়া দশমীর দিনে শত শত হিন্দুর বাড়িঘরে আগুন দেয় মুসলিমরা। যদিও এর শুরুটা আরও।
ব্রিটিশদের কলোনিয়াল এজেন্ডার ফুলেফেঁপে ওঠা চেহারা এই সাম্প্রদায়িকতা। ১৯৪০ এর দশকেই দেশভাগের নামে ভারতবর্ষকে ধর্মের মাপকাঠিতে ভাগ করতে এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যকে এক ধাপ এগিয়ে নিতে হিন্দু নির্মূলীকরণের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। এখানে প্রসঙ্গত বলে রাখি, ১৯৪১ সালের আদমশুমারি অনুসারে পূর্ববঙ্গের জনসংখ্যার ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ অমুসলিম, যাদের অধিকাংশ বাঙালি হিন্দু। আবার পশ্চিমবঙ্গের ৩০ দশমিক ২ শতাংশ ছিল মুসলিম, বাকি সবাই ছিল হিন্দু। যদিও তা বদলে যায় অনেক দ্রুত।
দেশ ভাগের দোরগোড়ায় যখন ভারতবর্ষ, তখন একে ধর্মীয় চেহারা দিতে অনেকটাই সাহায্য করেছিল ‘নোয়াখালী দাঙ্গা’। সালটা ছিল ১৯৪৬। ওই বছরের শেষ ভাগে পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) নোয়াখালী এবং ত্রিপুরা জেলার বাঙালি হিন্দুরা মুসলিমদের দ্বারা ধারাবাহিক ভাবে নির্মম গনহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরকরণের শিকার হয়। ধর্মীয় ভেদনীতির সফল বাস্তবায়নে অবিভক্ত বাংলার মুসলিমগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ যুক্ত হয় পাকিস্তানের সঙ্গে এবং হিন্দুগরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গ যুক্ত হয় ভারতের সঙ্গে। আসাম প্রদেশের অন্তর্গত বৃহত্তর সিলেট গণভোটের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়।
এরপর জাতিগত বিদ্বেষ চরমে পৌঁছায় ১৯৪৯ সালের আগস্ট মাস থেকে। তখন প্রায় ৩ মাস জুড়ে পূর্ববাংলার অমুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর নৃশংস বর্বরতা শুরু করে স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়। ওই মাসে সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার এবং বড়লেখা পুলিশ স্টেশনের আওতাধীন এলাকার স্থানীয় মুসলিম অধিবাসীরা পুলিশ এবং আনসার বাহিনীর সহযোগিতায় নিরীহ হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ শুরু করে। তারা লুটপাট চালায়, বাড়ি ঘর গুঁড়িয়ে দেয়, আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। হিন্দুদের উপর চালানো হয় অত্যাচার। করা হয় হত্যা। অনেক হিন্দু মেয়েকে এসময় পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা ধর্ষণ করে।
এর কিছুদিন পরে সাম্প্রদায়িকতার খড়গ নেমে আসে বরিশাল জেলার ভাণ্ডারিয়া গ্রামের হিন্দুদের উপর। এ সময় রাজশাহী বিভাগের একজন পাদ্রী ফাদার থমাস ক্যাটানিও রিপোর্ট করেন যে, সেখানকার সাঁওতাল গ্রামের অধিবাসীরা আক্রান্ত হয়েছে। তাদেরকে আটক করা হয়েছে এবং সাওতাল নারীদেরকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ডিসেম্বরের ১০ তারিখে উন্মত্ত মুসলিম জনতা রাজশাহীর পুঠিয়া রাজবাড়িতে ও আশপাশের বাড়ি-ঘরে হামলা চালিয়ে সম্পদ লুটপাট করে এবং সে সব বাড়িঘর দখল করে নেয়।
এরপর ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ শে ডিসেম্বরে কালশিরা হত্যাকাণ্ড ঘটে অবিভক্ত পূর্ববঙ্গের খুলনা জেলার বাগেরহাট উপজেলার মোল্লাহাট থানার কালশিরা গ্রামে। গ্রামের জয়দেব বর্মণের বাড়িতে কমিউনিস্টরা লুকিয়ে আছে, এই অভিযোগে ৪ জন পুলিশ কনস্টেবল ঢুকে পড়লো তার বাড়িতে। কিন্তু সে বাড়িতে কোনো কমিউনিস্টকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এরপর পুলিশ সদস্যরা জয়দেব বর্মণের স্ত্রীকে স্ত্রীকে ধর্ষণ করতে চেষ্টা করে। তার স্ত্রী চিৎকার শুরু করলে জয়দেব বর্মণ এবং তার আত্মীয়রা ক্ষিপ্ত হয়ে দু’জন পুলিশ কনস্টেবলের উপর চড়াও হয় এবং ঘটনাক্রমে একজন পুলিশ কনস্টেবল সেখানেই মারা যায়। বাকি দু’জন পুলিশ বিপদ ঘণ্টা বাজিয়ে দিলে পাশের প্রতিবেশীরা এসে তাদের উদ্ধার করে। পরের দিন জেলা পুলিশ সুপারিনটেনড সশস্ত্র পুলিশ কন্টিনজেন্ট এবং আনসার বাহিনী সহযোগে কালশিরা ও এর আশেপাশের হিন্দু গ্রামগুলোতে নির্দয় ভাবে আক্রমণ করে।
তারা আশেপাশের গ্রামগুলোর মুসলিম অধিবাসীদেরকে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর এবং সম্পত্তি লুটপাটে উৎসাহ দিতে থাকে। তারা হিন্দুদেরকে নির্দয়ভাবে হত্যা করতে শুরু করে এবং হিন্দু পুরুষ-মহিলাদেরকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে। হিন্দু সম্প্রদায়ের পবিত্র প্রতিমা, ছবি ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং হিন্দু মন্দিরগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়। ঐ গ্রামগুলোর ৩৫০টি বাড়ির সবগুলোকে ধ্বংস করে ফেলা হয়। তিনটি মাত্র ঘর অবশিষ্ট ছিল। হিন্দুদের গবাদি পশু, নৌকা সব কিছু জোর করে ছিনিয়ে নেয়া হয়। মাত্র এক মাসের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে খুলনার ৩০,০০০ হিন্দু প্রাণের ভয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
এদিকে পুলিশ বাহিনী বিনা কারণে একজন সাঁওতাল আদিবাসীকে আটক করলে, ৫ জানুয়ারি, ১৯৫০ সালে নাচোল পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন চণ্ডীপুর গ্রামের অধিবাসীরা পুলিশ স্টেশনের সামনে বিক্ষোভ শুরু করে কারণ। কিন্তু পুলিশ ঐ জনসমাবেশের ওপর গুলি চালালে সাঁওতাল আদিবাসীরা সহিংস হয়ে ওঠে এবং পুলিশের সাথে সংঘর্ষে ঘটনা স্থলে পাঁচ জন পুলিশ বাহিনীর সদস্য মারা যায়।
[নাচোল পুলিশ স্টেশনের অন্তর্গত এলাকা ছিল অমুসলিম প্রধান। এখানকার বেশিরভাগ অধিবাসী ছিল সাঁওতাল এবং বাঙালি হিন্দু। দেশভাগের পরপরই পাকিস্তান তেভাগা আন্দোলনকে দমন করতে পৈশাচিক বর্বরতা এবং বর্ণনাতীত নৃশংসতার ঘৃণ্য পথ বেছে নেয়। কিন্তু নাচোলে তখনও এই আন্দোলন সক্রিয় ছিল আত্মগোপনে থাকা কিছু ব্যক্তির নেতৃত্বে।]
পাঁচ পুলিশ সদস্য নিহর হবার ঘটনার ফলশ্রুতিতে ৭ জানুয়ারি তারিখে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ২ হাজার সদস্যের একটি সেনাবাহিনীর কন্টিনজেন্ট প্রেরণ করে এবং এর সাথে সশস্ত্র পুলিশ ও আনসার বাহিনী যুক্ত হয়। এই সশস্ত্র বাহিনী বারটি গ্রাম সম্পূর্ণরূপে পুড়িয়ে দেয়। চণ্ডীপুরগামী গ্রামবাসীদেরকে ধরে ধরে হত্যা করা হয়। চণ্ডীপুরের পুরুষ সদস্যদেরকে তারা হত্যা করে আর মহিলাদেরকে ধর্ষণ করে। শতশত সাঁওতাল এবং হিন্দুদেরকে হত্যা করা হয়।
এ সময় রোহানপুরের তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ইলা মিত্র সহ আরও শতাধিক দরিদ্র কৃষককে গ্রেফতার করা হয়। নাচোল পুলিশ স্টেশনে নিয়ে তাদের উপর নৃশংস অত্যাচার চালানো হয় বাকি নেতাদের নাম জানার জন্য। পুলিশের এই বর্বর অত্যাচারে সেখানেই প্রায় ৭০-১০০ জন কৃষক মারা যায়। ইলা মিত্রকে নওয়াবগঞ্জ পুলিশ স্টেশনে হস্তান্তরের আগে টানা চার দিন ধরে পাশবিক শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা।
[ইলামিত্রের জবানবন্দির কিছু অংশ: ৭-১-৫০ রাহানপুরে আমি গ্রেফতার হই এবং পরের দিন নাচোল নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ রক্ষীরা পথে আমাকে লাঞ্ছিত করে এবং এরপর আমাকে সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। হত্যাকান্ড সম্পর্কে আমি সবকিছু স্বীকার না করলে আমাকে নগ্ন করা হবে বলে এসআই হুমকী দেন। যেহেতু আমার কিছুই বলার ছিল না, আমার সমস্ত পরিধেয় বস্ত্র খুলে নেওয়া হয় এবং সম্পূর্ন নগ্ন অবস্থায় আমি সেলের ভেতর বন্দী ছিলাম।
আবারও সেলের ভেতর এসআই সিপাহিদের আদেশ করেন ৪ টি গরম ডিম নিয়ে আসতে এবং বলেন, ‘এবার সে (ইলা মিত্র) কথা বলবে’। এর পরে ৪/৫ জন সিপাহি আমাকে জোর করে শুইয়ে ফেলে এবং একজন আমার গোপন অঙ্গে ডিম ঢুকিয়ে দেয়। আমার আগুনে পুড়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি হয় এবং অচেতন হয়ে পড়ি।
৯-১-৫০ সকালবেলা যখন আমি আমার চেতনা ফিরে পাই, এসআই এবং কিছু সিপাহি আমার সেলে আসে এবং বুট পরা অবস্থায় আমার পেটে লাথি মারতে শুরু করে। এরপরে আমার ডান পায়ের গোড়ালিতে একটি পেরেক বিদ্ধ করা হয়। আমি তখন অর্ধচেতন অবস্থায় শুয়ে থাকি এবং এসআই কে মৃদুস্বরে বলতে শুনতে পাই, রাতে আমরা আবার আসব আর তুই যদি স্বীকার না করিস, একে একে সিপাহীরা তোকে ধর্ষণ করবে। গভীর রাতে এসআই এবং সিপাহীরা আবার ফেরত আসে এবং আবার হুমকি দেয়। কিন্তু তারপরেও আমি কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানাই, তিন কিংবা চার জন মানুষ আমাকে জোর করে ধরে রাখে এবং একজন সিপাহি সত্যিই আমাকে ধর্ষন করতে শুরু করে। এরপর খুব দ্রুতই আমি অচেতন হয়ে যাই।]
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৮৪৮
আপনার মতামত জানানঃ