ইয়ামিনা পার্টির নাফতালি বেনেট ইসরায়েলের নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। দেশটির পার্লামেন্টে নতুন জোট সরকারের অনুমোদনের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দীর্ঘ ১২ বছরের শাসনের অবসান ঘটলো। তবে ইসরায়েলে ক্ষমতার পালাবদলে নতুন শাসক এলেও ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ আপাতদৃষ্টিতে নেই বলে বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
ইসরায়েলের নতুন প্রধানমন্ত্রী বেনেট
স্থানীয় সময় রোববার সন্ধ্যায় ইসরায়েলের পার্লামেন্ট ‘নেসেট’ এ নতুন সরকার গঠনে হাড্ডাহাডি লড়াই অনুষ্ঠিত হয়। পার্লামেন্টে ৬০-৫৯ ভোটের মাত্র ১ ভোটের ব্যবধানে অনুমোদন পায় নাফতালি বেনেটের নেতৃত্বাধীন সরকার।
কথিত “কিং অব ইসরায়েল (ইসরায়েলের সম্রাট)“ বিনইয়ামিন নেতানিয়াহু ক্ষমতা হারিয়েছেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন আরেক কট্টর ইহুদি জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক নাফতালি বেনেট।
আগামী সেপ্টেম্বরে ভোটের পর ইয়ামিনা পার্টির নাফতালি বেনেটের শপথ নেওয়ার কথা রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী আগামী দুই বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের অগাস্ট পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকবেন কট্টর জাতীয়তাবাদী দল ইয়ামিনার নেতা নাফতালি বেনেট। তারপর তাকে ক্ষমতা তুলে দিতে হবে মধ্যপন্থী রাজনীতিক ইয়ার লাপিডের হাতে, যিনি নতুন এই কোয়ালিশন তৈরির মূল হোতা ছিলেন।
ইসরায়েলের নতুন প্রধানমন্ত্রী বেনেটকে অভিনন্দন জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও স্থায়ী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করার প্রত্যাশায় আছেন বলে অভিনন্দনবার্তায় জানিয়েছেন।
নাফতালি বেনেট বলেছেন, আমরা শত্রু নই, আমরা একই রক্তের মানুষ। ভোটাভুটিতে জয়লাভের পর তিনি বলেন,এটা শোকের দিন নয়। এখানে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তন হয়েছে এতটুকুই।
ইসরায়েলে কেউ যাতে ভীতসন্ত্রস্ত না হয়, সে জন্য যথাসাধ্য সব চেষ্টাই করবেন বলে জানান বেনেট। উৎসব না করার জন্য সমর্থকদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। বেনেট বলেন, তারা ইসরায়েলের শত্রু নন। তারা ইসরায়েলেরই মানুষ।
প্রধানমন্ত্রিত্ব গেলেও মাঠ ছাড়বেন না নেতানিয়াহু
টানা ১২ বছর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। দোর্দণ্ড এই প্রতাপশালী শাসককে সরাতেই জোট বেঁধেছেন বিরোধীরা। যে জোট অবশেষে নেসেটে আস্থাভোটে জয়ের মাধ্যমে সরকার গঠন করেছে।
কিন্তু জোট সরকারকে যে শান্তিতে থাকতে দেবেন না নেতানিয়াহু তা আগেই পরিষ্কার ছিল। এবার তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা দিলেন— প্রধানমন্ত্রিত্ব গেলেও রাজনীতি ছাড়ছেন না তিনি।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বের শেষ দিন রোববার তিনি এ কথা বলেন। খবর জেরুজালেম পোস্টের।
খবরে বলা হয়, নেতানিয়াহু প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়লেও রাজনীতিতে সক্রিয় থাকবেন।
নেতানিয়াহু সমর্থকদের বলেন, তিনি লিকুদ পার্টির প্রধান এবং বিরোধী নেতা হিসেবে থাকবেন। এ ছাড়া পরেরবারের নির্বাচনে হবেন প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী।
তিনি বলেন, আজ ছুটির দিন। কিন্তু হলেও কী হবে প্রকৃত অর্থে আজ লাখও ইসরায়েলির জন্য কঠিন একটি দিন যাচ্ছে। আমি আপনাদের বলব— হতাশ হবেন না। আমরা ফিরে আসব।
সমর্থকদের মাথা উঁচু করে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন নেতানিয়াহু।
তিনি বলেন, আমরা একসঙ্গে কাজ করব। আমি আপনাদের এ ভয়ঙ্কর সরকারের হাত থেকে মুক্তি দেওয়ার লড়াই চালিয়ে যাব। সৃষ্টিকর্তার সহযোগিতায় এটা এত দ্রুত হয়ে যাবে, যা আপনাদের ভাবনারও বাইরে।
ফিলিস্তিনিদের আশাবাদী হওয়ার কারণ নেই
ইসরাইলের ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর এখন দুটো প্রশ্ন সামনে চলে আসছে— নানা মত ও পথের সমন্বয়ে এই কোয়ালিশন আদৌ কতদিন টিকবে এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট নিয়ে নতুন এই সরকারের অবস্থান কী হবে?
ইসরায়েলে সরকারে পরিবর্তন এলেও তাতে খুব কমই পার্থক্য দেখছেন ফিলিস্তিনিরা। নাফতালি বেনেট ইসরায়েলের স্পেশাল ফোর্সের সাবেক কমান্ডো। অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণের মূল সংগঠনের প্রধান ছিলেন তিনি। ফিলিস্তিনিবিরোধী উগ্র ও বিতর্কিত বক্তব্যের জন্য বেনেট আলোচিত-সমালোচিত।
নাফতালি বেনেটের রাজনৈতিক আদর্শ, তার বিশ্বাস, ফিলিস্তিন সংকট নিয়ে তার অতীতের বক্তব্য-বিবৃতি বিবেচনা করলে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ আপাতদৃষ্টিতে নেই।
তার কট্টর ডানপন্থী আদর্শ নিয়ে তার কোনো রাখঢাক নেই। বিভিন্ন সময় বড়াই করে তিনি বলেছেন নেতানিয়াহুর চেয়েও তিনি বেশি ডানপন্থী। অতি ধার্মিক ইহুদিদের মত অধিকাংশ সময়ে মাথায় কিপা (এক ধরণের টুপি) পরে থাকেন। উদারপন্থী ইহুদিদের সুযোগ পেলেই উপহাস করেন।
বলতে গেলে বেনেট ইহুদি জাতীয়তাবাদ এবং জাত্যভিমানের এক প্রতীক।
অধিকৃত পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম এবং সিরিয়ার কাছ থেকে দখল করা গোলান মালভূমির ওপর ইসরায়েলের স্থায়ী কর্তৃত্ব এবং সার্বভৌমত্ব কায়েমের পক্ষে বেনেট। কট্টর ইহুদিদের মত তিনি বিশ্বাস করেন, ঐতিহাসিকভাবে এসব এলাকা ইসরায়েলের এবং সে কারণে পশ্চিম তীরকে তিনি সবসময় হিব্রু বাইবেলে বর্ণিত ‘জুদেয়া-সামারিয়া’ নামে অভিহিত করেন।
পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণের কট্টর সমর্থক তিনি। একসময় তিনি ইহুদি বসতি-স্থাপনকারীদের সংগঠন ইয়েশা কাউন্সিলের প্রধান ছিলেন। তাকে মানুষ চেনে ‘বসতি-স্থাপনকারীদের নেতা’ হিসেবে।
স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ঘোরবিরোধী তিনি। বিভিন্ন সময় তিনি ফিলিস্তিন সমস্যাকে ইসরায়েলের ‘পশ্চাৎদেশের ওপর বিষফোঁড়া’ বলে বর্ণনা করেছেন।
যে সাতটি দলের জোটের শরিক হিসেবে বেনেত প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন সেখানে ইসলামপন্থী একটি আরব দল ছাড়াও মেরেতজের মত বামপন্থী দল রয়েছে যারা পশ্চিম তীরে ইহুদি দখলদারিত্বে ঘোরবিরোধী।
জেরুজালেমে সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক হারিন্দার মিশ্র মনে করেন, ক্ষমতায় গিয়ে শরীকদের সঙ্গে আপোষ করা ছাড়া হয়তো কোনো কোনো উপায় থাকবে না।
তিনি বলেন, পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি হোক বা ইসরায়েলে সমকামীদের অধিকারের প্রশ্ন হোক— যে কোনো ইস্যুতেই জোটের শরিকদের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হবে। কিন্তু সরকার টিকিয়ে রাখতে যে আপোষ করতে হবে, সেটা তারা সবাই অনুধাবন করে।
তিনি আরও বলেন, প্রথমত বেনেট এবং শরিকরা জানেন তাদের ভেতর মত-পার্থক্য চরমে গেলে নেতানিয়াহু ক্ষমতায় ফিরে আসবেন। দ্বিতীয়ত, এই শরিকে যোগ দিয়ে বেনেট নিজে বিরাট ঝুঁকি নিয়েছেন। তার সমর্থকরা ক্ষুব্ধ। সুতরাং এই সরকার যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে ইসরায়েলের রাজনীতি থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারেন বেনেট। ফলে সেই ভয়েই তিনি আপোষ করবেন বলে আমার ধারণা।
তবে, পশ্চিম তীরের ইহুদি বসতি এবং ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আলোচনা শুরুর মত স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নতুন সরকার এখন এড়িয়ে চলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ক্ষমতা থেকে নেতানিয়াহুর প্রস্থান এবং ক্ষমতায় বেনেটেরর আগমনকে ফিলিস্তিনিরা কীভাবে দেখছে সে প্রসঙ্গে হারিন্দার মিশ্র বলেন, ফিলিস্তিনিরা এখন মনে করে, ইসরায়েলে ক্ষমতার রদবদলে তাদের ভাগ্যের কোনো বদল হবে না।
তবে, আরব-মুসলিম একটি দলের (মনসুর আব্বাসের ইউনাইটেড আরব লিস্ট) সমর্থন পেতে ইসরায়েলে ফিলিস্তিনি আরব নাগরিকের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কিছু সমঝোতা হয়েছে। আরব শহরগুলোতে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং সেইসঙ্গে পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের অনুমোদন-হীন বাড়ি ভাঙা বন্ধ রাখার চুক্তি হয়েছে।
কীভাবে নাফতালি বেনেটের মতো একজন কট্টর ডানপন্থি রাজনীতিক এমন শরিকদের সঙ্গে হাত মেলালেন, তা নিয়ে বিস্ময় এখনও কাটেনি। তার দলের ভেতরেও এ নিয়ে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। তার বহু সমর্থক ক্ষুব্ধ।
ক্ষমতায় গিয়ে কি বেনেট তার এতদিনের আদর্শের সঙ্গে আপস করবেন? ভিন্ন পথে হাঁটবেন?
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩৪
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ