সাহারা মরুভূমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বালির স্তুপ। এতোটাই বড় যে, এখানকার বালি দিয়ে গোটা পৃথিবীকে ৮ ইঞ্চি পুরু করে ঢেকে ফেলা যায়! তবে প্রায় দশ হাজার বছর আগে সাহারা অঞ্চল ছিলো সবুজ, উর্বর আর জনবসতিপূর্ণ! বর্তমানের পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম এই স্থান, কয়েক কোটি বছর আগেও ছিলো টেথিস সাগর! অবাক করার মতো, না? এর প্রমাণাদি পরে নিয়ে আসছি।
এখন আরেকটা হাইপোথিসিস তুলে ধরি, তা হলো, আদি মানব এই সাহারা দিয়েই রওনা হয়েছিলো য়ুরোপের উদ্দেশ্যে। ইতিহাসের শেকড়টা এখনও হয়তো বালির অনেক গভীরে কোন এক মৃত নদীর আড়ালে লুকিয়ে আছে। দ্য রয়্যাল নেদারল্যান্ডস ইনস্টিটিউট ফর সি রিসার্চ (এনআইওজেড)-এর বিজ্ঞানীদের একটি দল এবং জার্মানির দ্য ইউনিভার্সিটি অব ব্রিমেনের মতে নর্থ আফ্রিকার সাহারা ও সাহেল অঞ্চলে বড়সড় ধরনের জলবায়ুর পরিবর্তনই আফ্রিকা কন্টিনেন্ট থেকে আদি মানবের মাইগ্রেশনের কারণ। সাহারা মরুভূমি এবং সাহেল (সাহারা মরুভূমির দক্ষিণের অংশকে সাব-সাহারান আফ্রিকা বলে এবং সাব-সাহারান অঞ্চলের মধ্যবর্তী অঞ্চলকে সাহেল বলা হয়) নিয়ে এই দুই দলের সবথেকে বড় খোঁজ হলো, এই দুই অঞ্চল পর্যায়ক্রমে ৯ হাজার বছর, ৫০ হাজার বছর এবং ১ লক্ষ ২০ হাজার বছর আগে জলসিক্ত ছিলোো, বৃষ্টি হতো, মানুষের বসবাস উপযোগী ছিলো। আর এই জলসিক্ত সাহারার মধ্যবর্তী সময়ইগুলো জুড়ে এই অঞ্চলে দাপিয়ে বেরিয়েছে বালি আর বালি। সাহারা নিয়ে তাই রহস্যের শেষ নেই। যতটা জানি, তার থেকে অনেক বেশি না জানি আমরা।
সাহারা নিয়ে অন্য একটি মিথ হলো এটি ‘ম্যান মেড’। চাঞ্চল্যকর এই মিথের জন্ম সিওল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের থেকে। তাদের দাবি, মানুষই ক্রমাগত গাছ কেটে সাফ করেছে এ অঞ্চলে। ফলে একটু একটু করে কমে এসেছে বৃষ্টি। ধীরে ধীরে সবুজের জায়গা নিয়েছে বালি। নব্যপ্রস্তর যুগে এই অঞ্চলে মানবিক কারণেই পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। সাহারা অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কমে আসে। ইউরোপ, আমেরিকা ও নিউজিল্যান্ডে এমন পরিবর্তন পরেও দেখা গিয়েছে।
তবে সে যাই হোক, এবার হয়তো আবারও নিজের পুরনো চেহারায় ফিরতে চলেছে সাহারা! কিন্তু এও কি সম্ভব? আর সম্ভব হলেও এই ফেরা কতটাই বা মঙ্গলজনক হবে পৃথিবীর জন্য! তবে এবার সাহারা নিয়ে পরিবেশিবিদদের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে গাছ নিজেই।
যেভাবে খুঁজে পাওয়া গেল ১৮০ কোটি গাছ
সম্প্রতি ধূ ধূ সাহারার বুকে হঠাৎ সবুজের সমারোহ খুঁজে পাওয়া গেছে। স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবি দেখে গবেষকরা অনুমান করছেন, ১৮০ কোটি গাছ রয়েছে পশ্চিম আফ্রিকার এই মরুভূমিতে।
এটি খুঁজে পেয়েছে একটি গবেষক দল। এই দলের নেতৃত্বে আছেন কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূবিজ্ঞানের অধ্যাপক মার্টিন ব্র্যান্ড। তিনি তার সহকর্মীদের সঙ্গে ১১ হাজার ১২৮টি স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবি বিশ্লেষণ করেছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সাহায্যে। পশ্চিম আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি, সাহেল এবং দক্ষিণের তুলনামূলক আর্দ্র অঞ্চলের পাঁচ লাখ বর্গমাইলে উদ্ভিদের পরিমাণ নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন। ছবি বিশ্লেষণ করে ওই অঞ্চলে মোট ১৮০ কোটি আলাদা উদ্ভিদ খুঁজে পান তারা।
গবেষণাপত্রে তারা জানিয়েছেন, মরুভূমিতেও এমন উচ্চ ঘনত্বে উদ্ভিদ থাকতে পারে, তা তাদের জানা ছিলো না। মোট কথা, মরুভূমি সম্পর্কে বিদ্যমান ধারণা বদলে দিয়েছে। তারা এখানে পদ্ধতির বিবরণসহ প্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছেন যে প্রতিটি উদ্ভিদ আলাদা করে শনাক্ত করা সম্ভব। এই মরুভূমিতে উদ্ভিদশূন্য রুক্ষ অংশের পরিমাণ বেশি হলেও, চমৎকার বিষয় হলো বালির নিচেও গাছ জন্মাচ্ছে। এদিকে, বিশাল মরুভূমিতে সবুজের খোঁজ করে হিসাব রাখার মতো কঠিন কাজটি করতে রীতিমতো বেগ পেতে হয়েছে মার্টিন ব্র্যান্ড এবং তার গোটা দলকে।
৯০ হাজার গাছ আলাদা আলাদা করে খুঁজে চিহ্নিত করেছেন ব্র্যান্ড নিজেই। গাছেদের শ্রেণীবিভাগের উপরেও জোর দিয়েছেন ব্র্যান্ড। সেই জন্য গবেষকদলকে আলাদা করে প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছিলো। অন্য একটি সমীক্ষায় পাঁচ লাখ বর্গ মাইল অঞ্চলের ১১ হাজার ছবি নিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে নেচার পত্রিকায়। এই ফলাফলও ইঙ্গিত দিচ্ছে সাহারায় সবুজের এই বিপুল অস্তিত্বের।
কতটা দুশ্চিন্তার সাহারার এই গাছের অস্তিত্ব?
কিন্তু গাছ কীভাবে দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে! যেকোন স্থানে গাছ জন্মাতেই পারে, এতে ভয়ের কী আছে? মরুভূমির বুকে গাছ জন্মানোর বিষয়টি কতটা ভালো সংবাদ, তা নিয়ে যদিও দ্বিমত আছে।
পরিবেশবিদরা এর পিছনে ক্রমশ বদলে যাওয়া পৃথিবীর জলবায়ুর প্রভাব দেখতে পাচ্ছেন। ঠিক এই একই কারণে বরফে ঢাকা অ্যান্টার্কটিকার শীতল বুকেও জন্ম নিচ্ছে প্রচুর সবুজ উদ্ভিদ। শেষ পর্যন্ত এর পরিণাম কী, তা নিয়ে ভাবছেন বিজ্ঞানীরা!
মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল এয়ারোনটিকস অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (নাসা) এক বিজ্ঞানী জেস মেয়ার জানিয়েছেন, পরিবেশ সংরক্ষণ, জলবায়ুর পরিবর্তন আটকানোর ক্ষেত্রেও এই তথ্য খুবই সাহায্য করবে। আগামী এক, দুই অথবা দশ বছর পর ফের স্যাটেলাইট মারফত ছবি পেলে তখন বদলটা ধরতে পারা সহজ হবে, নাসার এক প্রেস বিবৃতিতে জানানো হয়েছে এ কথা।
এদিকে ব্র্যান্ড জানান, এই আবিষ্কার পরিবেশবিদদের গবেষণায় অনেক সাহায্য করবে। সারা বিশ্বে কতটা কার্বন জমছে, সেই হিসেব আরও নিখুঁত হবে।
কী কারণে এই পরিবর্তন?
শুরুতেই বলেছিলোাম, সাহারার জায়গায় কয়েক কোটি বছর আগে টেথিস সাগর ছিলো। এবার এই বলার কারণটা জানা যাক। সাহারা মরুভূমি যে পূর্বে সাগর ছিলোো তার প্রমাণ মিলে মিশরের রাজধানী কায়রো থেকে দেড়শো কিলোমিটার দূরে। সাহারা মরুভূমির ওয়াদি আল হিতান বা তিমির উপত্যকা নামক একটি স্থানে প্রায় ৩৬ লক্ষ বছর আগে বিলুপ্ত ডোরাডান প্রজাতির তিমির ফসিল খুঁজে পাওয়া যায়। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জীবাশ্ম পাওয়া গেছে ওয়াদি আল হিতানে।
আর বালুর রাজ্য হলেও সাহারায় বেশ কয়েকটি অংশে তৃণভূমি আর পর্বত রয়েছে। ছোটবড় বেশ কটি হ্রদ আর নদীর অস্তিত্বও রয়েছে সাহারায়। যা এই স্থানে সাগরের অস্তিত্বের দিকেই আমাদের সায় জানিয়ে মাথা হেলাতে বাধ্য করে।
এছাড়া, গোটা আফ্রিকা মহাদেশ পৃথিবীর একটা টেকটনিক প্লেটের উপর অবস্থিত। আমরা জানি, বহুকাল আগে আফ্রিকা ও ইউরোপের মাঝে টেথিস সাগর ছিলো। ধারণা করা হয় ৪ কোটি বছর আগে টেকটনিক প্লেটের গতির ফলে টেথিস সাগর উত্তরের দিকে সরে আসে এবং আফ্রিকা আর ইউরোপ একসাথে মিলে যায়। ফলশ্রুতিতে আফ্রিকার উত্তর অংশ সংকুচিত হয় এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উপরে উঠে যায়। এরপর এই এলাকা ধীরে ধীরে পানিশূন্য হয়ে পড়ে।
জার্মানির এক গবেষকের ৪০ বছরের গবেষণা থেকে উঠে আসে, ৪ থেকে ১২ হাজার বছর আগেও সাহারা ছিলোো সবুজ ও উর্বর। প্রায় প্রতি ২০ হাজার বছর পর পর সাহারা মরুভূমি জলাভূমি থেকে তৃণভূমিতে পরিণত হয়। প্রতি ২০ হাজার বছর পর পর পৃথিবী উত্তর দিকে সামান্য কাত হয়। এর ফলে পৃথিবীর মৌসুমি বায়ুর গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে সাহারা মরুভূমিতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। ফলে এই অঞ্চলে প্রচুর গাছপালা জন্মায় এবং মানুষ বসবাসের অনুকূলে চলে আসে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ১৫ বছর পর সাহারা আবার সবুজ হয়ে উঠবে।
মরুভূমির তুলনায় সাহারার বিচিত্র জীববৈচিত্র্য
উষ্ণতা, খড়খড়ে মরুভূমি সাহার। তবে এখানে প্রাণের স্পন্দন নেই ধারণা করলে তা বড়সড় এক ভুল। ভৌগলিক আর বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এখানকার জীবজগৎও কিছুটা বিচিত্র তবে বৈচিত্র্যে ভরপুর। সাহারা মরুভূমিতে উদ্ভিদ জগতের প্রায় ২ হাজার ৮০০ প্রজাতির বৃক্ষ রয়েছে। এখানকার এক চতুর্থাংশ উদ্ভিদ স্থানীয়। যা পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায়না।
খেজুর, সাকুলেন্ট, আকাসিয়াসহ অনেক গাছ রয়েছে সাহারায়। আবহাওয়ার সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে এদের আকৃতিও অন্যান্য গাছের চেয়ে ভিন্ন। বালুঝড় কিংবা তীব্র বাতাসের হাত থেকে রক্ষা পেতে গাছের আকার ছোট। শুষ্ক মৌসুমে পানি ধরে রাখার জন্য স্থুলকায় কাণ্ড এবং সহজে পানি সন্ধান পেতে মাটির নীচে রয়েছে প্রশস্ত মূল।
বৃক্ষরাজির পাশাপাশি সাহারা মরুভূমির প্রাণীকূলও বেশ সমৃদ্ধ। এডেক্স নামক এক ধরনের হরিণের বাস সাহারা মরুভূমিতে। পানি ছাড়া প্রায় এক বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে এডেক্স। দরকাস গ্যাজেল নামক হরিণও দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে। যেটিরও বাস এই সাহারায়। এছাড়া কয়েক প্রজাতির শিয়ালের বাস সাহারায়। মালি, নাইজার, তোগো, আলজেরিয়া অঞ্চলে সাহারান চিতা বাস করে।
বিভিন্ন সরীসৃপ প্রজাতির প্রাণীর দেখা মিলে এখানে। মৌরিতানিয়া এবং এনেদি মালভূমিতে ছোট প্রজাতির কুমির বাস করে। অত্যন্ত বিপদজনক ডেথস্টার বিছার বাসও এখানে। ১০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা এই বিছার বিষে অধিক পরিমাণে এজিটক্সিন ও সাইলাটক্সিন রয়েছে। পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষকে মেরে ফেলতে ডেথস্টারের এক দংশনই যথেষ্ট!
একই প্রসঙ্গে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষক ক্যাথলিন জনসনের একটি প্রতিবেদিনের কিছু অংশ তুলে ধরে শেষ করি। ওই প্রতিবেদনে তিনি জানান, ১১ হাজার থেকে ৫ হাজার বছরের মাঝামাঝি কোন একটা সময়ে লাস্ট আইস এইজ শেষ হবার পর সাহারা মরুভূমিতে পরিবর্তন আসে। বালির মধ্যে সবুজ গাছপালা জন্মাতে শুরু করে। পর্যাপ্ত বৃষ্টির কারণে শুষ্ক গুহাগুলো হ্রদে রূপ নেয়। নর্দার্ন আফ্রিকার প্রায় ৩.৫ মিলিয়ন স্কয়ার মাইলস এলাকা সবুজে বদলে যায়। যদিও এই সবুজ প্যারাডাইস, অনেকদিন আগেই হারিয়ে গেছে। কিন্তু তা কি আবার পুরনো রূপে ফিরবে, এমন প্রশ্নে হ্যাঁ বলছেন বিজ্ঞানীরা। এই সবুজ সাহারা আফ্রিকান হিউমিড পিরিয়ড নামেও পরিচিত। যা পৃথিবীর ক্রমাগত তার অক্ষে অরবিটাল রোটেশনের কারণে ঘটেছিলো। যেটা ২৩ হাজার বছর পর পর আবার ঘটতে পারে এবং সাহারায় ১৮০ কোটি গাছ খুঁজে পাওয়ার ঘটনা এইদিকে ইঙ্গিত করে যে, চিরচেনা সাহারা মরুভূমি আবারও গাছপালাবেষ্টিত এক বিস্তৃণ উর্বর ভূমিতে বদলাতে শুরু করেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৮৩৪
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ