মনজুরুল হক
বার্লিন পতনের পর পরই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে কোনো সময় জার্মান বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। ৩০ এপ্রিল হিটলার আত্মহত্যা করার পর নাৎসি লিডাররা সকল ফ্রন্ট থেকে বিশেষ করে ইস্টার্ণ ফ্রন্ট থেকে একত্র হয়েছিলেন। ৭ তারিখেই চার্চিল এবং রুজভেল্টের কাছে আত্মসমর্পনের প্রস্তাব চলে গেছে এবং আত্মসমর্পনের ঘটনাক্রম অনুষ্ঠিতও হয়েছিল, কিন্তু সোভিয়েত তথা মিত্র শক্তির সর্বাধিনায়ক জোসেফ স্তালিন সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন পূর্ব জার্মানিতেই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠিত হবে। সেই মতে হয়েছিলও। কেন স্তালিন এই সিদ্দান্ত নিলেন এবং কেন তা চার্চিল এবং রুজভেল্টকে মুখ বুজে মানতে হলো সেটাই ৮৫ বছরের স্তালিনবিরোধীতার ইতিহাস। সেই ক্ষত চার্চিল-রুজভেল্ট জীবনেও ভুলতে পারেননি। তারা গত হওয়ার পর পরম্পরায় তাদের উত্তরসূরিরাও ভুলতে পারেননি। এখনও পারেন না। তারা মনে করেন-জর্জিয়, কার্যত এশীয় এবং বাদামী চামড়ার ছোটখাট অল্প শিক্ষিত মানুষের কাছে ব্রিটিশ-আমেরিকার আভিজাত্য পরাজিত হয়েছে। এ তো কেবল জার্মানির পরাজয় নয়। সেই দগদগে ক্ষত আজও বয়ে বেড়ায় আর স্তালিনের বিরুদ্ধে নগ্ন ভিত্তিহীন মিথ্যাচার করতে কোটি কোটি ডলারের ফান্ড গড়ে তোলে। যার নিট ফলাফল- এই বঙ্গভূমিতেও হাফ জানা-বোঝা, বা একেবারেই স্তালিনকে না-জানা তালেবররা স্তারিনের নামে দুএকটা গালাগাল দিয়ে রাতে ঘুমাতে যায়।
২
আজ ৯ মে।এই তারিখটা এক ঐতিহাসিক গৌরবোজ্জল তারিখ।। এদিন মানব জাতির লিখিত ইতিহাসের ভয়াবহতম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি হয় নাৎসি ডিকটেটর কুখ্যাত হিটলারের বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। চূড়ান্ত বিজয় হয়েছিল ফ্যাসিবাদবিরোধী যুদ্ধের। পরাজয় ঘটে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর।
এবার পালিত হল ফ্যাসিবাদবিরোধী যুদ্ধজয়ের ৭৬ তম বার্ষিকী। এই যুদ্ধজয়ের ঐতিহাসিক ঘটনাবলির পূর্বাপর এই পরিসরে লেখার স্পেস নেই।তাই সংক্ষিপ্তাকারে বলা চেষ্টা।
৩
যুদ্ধ কেন বেঁধেছিল?
১ম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) ফলাফল নিয়ে জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়েই অসন্তুষ্ট ছিল। ব্রেস্ট-লিটোভ্স্কের চুক্তি
(মার্চ, ১৯১৮) অনুযায়ী সোভিয়েত রাশিয়া পূর্ব ইউরোপে বিস্তর ভূখণ্ড হারায়, এতে পেট্রোগ্রাডে বলশেভিকগণ জার্মানদের দাবি মেনে নেয় এবং অক্ষশক্তির কাছে পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, ফিনল্যান্ড এবং অন্যান্য অঞ্চলসমূহের কর্তৃত্ব হস্তান্তর করে দেয়। আবার জার্মানি ১ম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে (নভেম্বর, ১৯১৮) এবং ভার্সাই নগরীতে অনুষ্ঠিত প্যারিস শান্তি সম্মেলনে(১৯১৯) গৃহিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উল্লিখিত ভূখন্ডসমূহ স্বাধীন হয়ে যায়। এ সম্মেলন চলাকালে সোভিয়েত রাশিয়া রুশ গৃহযুদ্ধে লিপ্ত ছিল, এবং মিত্রবাহিনী বলশেভিক সরকারকে অনুমোদন না দেয়াতে সোভিয়েত রাশিয়ার কোন প্রতিনিধি প্যারিস সম্মেলনে অংশ নিতে পারেনি।
৪
জার্মান মতাদর্শ বা হিটলারের অভিপ্রায় ছিলঃ
হিটলার Lebensraum বা “জীবনযাপনের স্থান” ধারণা পোষণ করেন: তার মতে জার্মানদের বসবাসের জন্যে পূর্ব ইউরোপে, বিশেষ করে রাশিয়ায় নতুন ভূখণ্ড অধিকার করা প্রয়োজন। তিনি এসকল স্থানে জার্মানদের বসতি স্থাপনের স্বপ্ন দেখেন, কেননা নাৎসি মতবাদ মতে জার্মানরা “মনিব জাতি” (‘master race’) হিসেবে গণ্য, তাই অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীকে হয় হত্যা অথবা সাইবেরিয়ায় নির্বাসন দেয়া হবে, অবশিষ্ট যারা থাকবে তারা জার্মানদের দাসত্ব করবে। ১৯১৭ সালেই হিটলার রুশদেরকে ‘নিকৃষ্ট’ বলে উল্লেখ করেন, তার বিশ্বাস ছিল বলশেভিক আন্দোলনের ফলে ইহুদিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ স্লাভদের ওপর কর্তৃত্ব পেয়ে গেছে, যারা, হিটলারের মতে, নিজেদের নেতৃত্ব দেয়ার অযোগ্য, বরং তাদের ইহুদি প্রভুদের আজ্ঞাবহ।
এরই প্রক্রিয়ায় হিটলারের বাহিনী ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করার মাধ্যমে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করে। এবং ১৭ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন পোল্যান্ডের পূর্বাঞ্চলে আক্রমণ চালায়, ফলে পোল্যান্ড জার্মানি, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও লিথুয়ানিয়ার মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
৫
এর পরের ইতিহাস ব্যাপক বিস্তৃত। তবে এখানে একটা ‘মজার’ ব্যাপার আছে! জার্মানিরা এই যুদ্ধকে ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ বলত না! তারা বলত- “পূর্ব রণাঙ্গন”। যেখানে একপক্ষে ছিল অক্ষশক্তির সদস্যসমূহ ও তাদের সহযোগী ফিনল্যান্ড এবং অপরপক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড এবং মিত্রবাহিনীর অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রসমূহ। এই যুদ্ধ মধ্য ইউরোপ, পূর্ব ইউরোপ, উত্তর-পূর্ব ইউরোপ, বাল্টিক অঞ্চল এবং বলকান অঞ্চল জুড়ে সংঘটিত হয়; যুদ্ধের সময়কাল ছিল ১৯৪১ সালের ২২এ জুন থেকে ১৯৪৫ সালের ৯ই মে পর্যন্ত। এই যুদ্ধকে প্রাক্তন সোভিয়েত ও আধুনিক রাশিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে “মহান দেশাত্মবোধের যুদ্ধ” (রুশ: Великая Отечественная война,Velikaya Otechestvennaya Voyna) বলা হয়, অপরদিকে জার্মানির দৃষ্টিকোণ থেকে একে বলা হয় “পূর্ব রণাঙ্গন” (জার্মান: die Ostfront), অথবা অন্যান্যদের দৃষ্টিকোণ থেকে একে বলা হয় জার্মান-সোভিয়েত যুদ্ধ।
৬
জয়-পরাজয়, ক্ষয়-ক্ষতি নিয়ে লিখলে ফুরোবে না। থাক সেসব। আজ শুধু আমরা নাৎসি বাহিনীর আত্মসমর্পণের এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে মিত্র বাহিনীর বিজয় স্মরণ করব। দুই পক্ষের বাহিনীর হিসাব দেব না। শুধু একটি বিস্ময়কর তথ্য উল্লেখ করব- সোভিয়েত বাহিনীতে নারী যোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৮,০০,০০০ !!
২৯ ও ৩০ এপ্রিল, সোভিয়েত সেনাবাহিনী আক্রমণ চালিয়ে বার্লিনের কেন্দ্রে পৌঁছে গেলে অ্যাডলফ হিটলার তার সঙ্গিনী ইভা ব্রাউনকে বিবাহ করেন অতঃপর তিনি সায়নাইড বিষ গ্রহণ করে ও নিজের মাথায় গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন। বার্লিনের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত রক্ষীবাহিনীর প্রধান হেলমাথ উইডলিং ২রা মে তারিখে সোভিয়েত বাহিনীর কাছে বার্লিন নগরী সমর্পণ করে দেন। সবমিলে বার্লিন অভিযানে (১৬ এপ্রিল – ২ মে) লাল ফৌজের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৩,৬১,৩৬৭ জন (নিহত, আহত, নিখোঁজ ও অসুস্থ), এছাড়া ১,৯৯৭টি ট্যাংক ও কামান ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এ যুদ্ধে জার্মানদের ক্ষয়ক্ষতি নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।
১৯৪৫ সালের ৭ই মে, দিবাগত রাত ২টা ৪১ মিনিটে, ফ্রান্সের রেইমসে, মিত্রবাহিনীর অভিযান পরিচালনার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সদর দপ্তরে জার্মান সেনা-প্রধান জেনারেল আলফ্রেড জোড্ল মিত্রবাহিনীর কাছে জার্মানির নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ দলিলে সাক্ষর করেন। এই দলিলে উল্লেখ করা থাকে, “৮মে, ১৯৪৫ তারিখে কেন্দ্রীয় ইউরোপীয় সময়ে ২৩০১ ঘটিকায় জার্মান নেতৃত্বাধীন সকল বাহিনির সকল কর্মকান্ড বন্ধ হবে”। মাঝরাতের ঠিক আগমুহূর্তে ফিল্ড মার্শাল উইলহেম কাইটেল, বার্লিনে সোভিয়েত জেনারের জুকভের সদর দপ্তরে এই দলিলের অনুরূপ আরেকটি দলিলে সাক্ষর করেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নে ৯ই মে তারিখকে যুদ্ধ সমাপ্তির তারিখ গণ্য করা হয়, কেননা মস্কো সময়ে আত্মসমর্পণের সময়টি ৯ই মে তারিখে পড়েছিল। বর্তমানে এ তারিখটি রাশিয়ার জাতীয় দিবস- “বিজয় দিবস” হিসেবে গণ্য হয়, যাতে দুই দিন ব্যপী (৮ ও ৯ মে) ছুটি উদযাপন করা হয়, এছাড়া প্রাক্তন সোভিয়েত সদস্য কতিপয় রাষ্ট্রেও এ ছুটি উদযাপিত হয়। মস্কো বিজয় কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয় ২৪ জুনে।
৭
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ভেঙ্গে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ;রুশ ফেডারেশন’ গঠনের পর এই দিনদুটি তেমন আড়ম্বরে পালিত হতো না। তবে ২০১৪ সালের পর থেকে আগের মতই আড়ম্বরে দিনটি পালিত হয়। এখন আবার আগের মত বলা হচ্ছে- ‘মস্কোই বিজয় দিবসের সূতিকাগার’। সেই থেকে এদিন মস্কোর রেড স্ক্যয়ারে প্রায় ২০/২৫ লাখ মানুষ কাক ভোরে এসে জড়ো হয়। সারাদিন ধীর লয়ে মিছিল করে। লাখ লাখ হাতে শোভা পায় যুদ্ধাহত সেই সব বীরদের ছবি। কারো ভাই, কারো ছেলে, কারো বাবা, কারো চাচা….লাখ লাখ বেদনাক্লিষ্ট মুখ অথচ কি এক অপরূপ স্বর্গীয় হাসিতে উদ্ভাসিত! গত বছর সাড়ে সাত কিলোমিটারব্যাপী মার্চ পাস্ট চলেছে… কোথাও কোনো অনিয়ম নেই, বিশৃঙ্খলা নেই, হুড়োহুড়ি নেই, শোরগোলও নেই। কারণ, সমাজতন্ত্র সাময়ীক সরে গেলেও কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক প্রজন্ম তৈরি হয়েছিল রাশিয়াসহ পুরোনো সোভিয়েত ইউনিয়নে। তারা এখনো সমাজতন্ত্রের ঐক্য, শৃঙ্খলা আর পূর্বপুরুষের দায় বয়ে চলে। সমাজতান্ত্রিক মানুষ রাষ্ট্র হারাতে পারে, চেতনা নয়।
তথ্য সহায়তাঃ
১. May 8, 1945, was ‘zero hour’ for Germany in multiple ways
২. 9th May, 72 years after the Great Anti-fascist Victory of the Peoples
মনজুরুল হক, লেখক ও গবেষক
আপনার মতামত জানানঃ