কোথায় নির্যাতনের শিকার হচ্ছে না শিশুরা। রাস্তা-ঘাট, নিজের বাড়ি, আত্মীয়স্বজনের বাড়ি, মাদ্রাসা, স্কুল কোথাও নিরাপদ নয় শিশুরা। সবথেকে প্যাথেটিক ব্যাপার হলো শিশুরা পরিবারের অতি আপনজনদের দ্বারাই ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, যে বাবা সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়, যে বাবা সন্তানের লালন-পালন করে, সেই বাবাই একসময় তার কন্যা শিশুটিকে নিজের ভোগের সামগ্রী ভাবে।
বাংলাদেশে প্রতি চার জন মেয়ে শিশুর মধ্যে একজন যৌন নিপীড়নের শিকার হয়৷ আর প্রতি ছয় জন ছেলে শিশুর মধ্যে যৌন নিপীড়নের শিকার হয় একজন৷ শুধু পুরুষ নয়, শিশুরা কখনো কখনো নারীর হাতেও যৌন হয়রানির শিকার হয়৷
নব্বই ভাগ শিশুই পরিবারে ধর্ষণের শিকার
বাংলাদেশে শিশু অধিকার কর্মীদের ভাষ্যমতে, দেশটির শতকরা নব্বই ভাগ শিশুই পারিবারিক গণ্ডিতে ধর্ষণ থেকে শুরু করে অনাকাঙ্ক্ষিত শারীরিক স্পর্শসহ নানা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে থাকে।
ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স নামে একটি বেসরকারি সংস্থা বলছে, ১৯৯৬ সালে তারা যৌন নির্যাতনের শিকার ৫০ জন মানুষের সাক্ষাতকার নেয় যাদের মধ্যে ৪৬ জনই ছিলেন পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন বা পরিচিতদের হাতে নির্যাতনের শিকার।
সাধারণত দেখা যায়, আমাদের সমাজে এবং পরিবারেই প্রথম যৌন অভিজ্ঞতার শিকার হয় শিশুরা। তাও খুব কাছের মানুষের দ্বারা। কোনও কোনও ক্ষেত্র নিকটাত্মীয় বিশেষ করে, বাবা, চাচা, কিংবা ভাইয়ের হাতেও যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে শিশুরা।
কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিকটাত্মীয় বা পরিবারের সদস্যদের দ্বারা ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের ঘটনাগুলো প্রকাশ হয়না। প্রথমত লোকলজ্জা ও পারিবারিক কারণে বিষয়গুলো পরিবারের মধ্যেই মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়। যেগুলো প্রকাশিত হয়, সে সব ক্ষেত্রেও দেখা যায় বেশিরভাগ অভিযোগকারী আইনের আশ্রয় নিতে আগ্রহী হয় না।
দেশে আইন আছে৷ কিন্তু আইন থাকলেও বিচারহীনতার কারণে শিশু যৌন নিপীড়ন বাড়ছে৷ কারণ, অনেক সময় এর বিচার চাইতে গিয়ে ভিকটিমের পরিবার সামাজিক নিন্দার শিকার হয়৷ আর যারা যৌন হয়রানি করে, তারা তুলনামূলকভাবে প্রভাবশালী থাকে৷ ফলে তারা বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত বা নিজেদের পক্ষে নিতে সক্ষম হয়৷
তবে বাংলাদেশে এখন বেশ কিছু সংস্থা শিশু ধর্ষণের বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে, নানা পরামর্শ দিচ্ছে এবং সচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রচারণা চালাচ্ছে।
ভুগছে মানসিক সমস্যায়, হয়ে উঠতে পারে যৌন নিপীড়ক
যৌন নিপীড়নের শিকার শিশুদের জন্য বিশেষ সেবার প্রয়োজন হয়৷ নির্যাতনের কারণে তারা ট্রমায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে৷ এমনকি বাবাকে দেখলেও ভয় পায়৷ বিশেষ কোনও স্থান বা পোশাকের প্রতিও তাদের ভীতির সৃষ্টি হতে পারে৷ কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্যই হারিয়ে ফেলে৷
ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট ফরিদা আক্তার বলেন, প্রতি মাসে তিনি এ ধরনের অন্তত তিন থেকে চারজন রোগী পান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এ ধরনের নিপীড়নের যারা শিকার তারা যৌন সংশ্রবের ব্যাপারে চরম অনাগ্রহী হয়ে পড়ে।
তারা পুরুষ মানুষ সহ্য করতে পারে না। কেউ কেউ যে কোনো ধরণের স্পর্শেই চমকে ওঠে। আবার কোনও কোনও ক্ষেত্র উল্টোটাও দেখা যায়। অর্থাৎ তাদের কেউ কেউ যৌন সম্পর্কের ব্যাপারে অতিমাত্রায় আগ্রহী হয়ে পড়ে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যেসব শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, তারা পরবর্তী জীবনে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভোগেন৷ কেউ কেউ যৌন নিপীড়কও হয়ে ওঠে৷
কীভাবে বুঝবেন আপনার শিশু নিপীড়ণের শিকার?
ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সিল সেন্টারের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ইশরাত শারমিন রহমান বলছেন, তিনি তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় দেখেছেন শিশুরা বাইরের মানুষের দ্বারা নয় বরং পরিবারের খুব কাছের মানুষদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
তিনি বলেন, এটা অনেক দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে শিশুরা অপরিচিত ব্যক্তিদের চেয়ে বেশি নির্যাতিত হয় পরিচিত ব্যক্তিদের দ্বারা। এক্ষেত্রে বড় ভাই, কাজিন, চাচা, ফুফু, টিউটর, বাড়ির দারোয়ান বা কাজের লোক এরকম যে কোন ব্যক্তির দ্বারাই নির্যাতনের শিকার হবার আশঙ্কা থাকে।
শিশুরা সাধারণত যৌন নিপীড়নের শিকার হলে কোনও ব্যক্তিকে দেখলে ভয় পেতে পারে৷ কোনও বাসায় যেতে না চাইতে পারে৷ কোনও স্থানকে ভয় পেতে পারে৷ কাউকে দেখলে লুকিয়ে থাকতে পারে৷ কারোর কাছে আগে যেতো, কিন্তু এখন যেতে চায় না – এমন হতে পারে৷ আবার সে তার যৌনাঙ্গে ব্যথার কথা বলতে পারে।
পাশাপাশি শিশু হঠাৎ করে ভয় পাচ্ছে কিনা, চমকে উঠছে কিনা, অন্ধকার ভয় পায় কিনা এই বিষয়গুলো লক্ষ্য করতে হবে। বাচ্চা হঠাৎ করে বিরক্ত হচ্ছে কিনা, মেজাজ খারাপ করছে কিনা, ছোট ছোট বিষয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে কিনা, টেনশন করছে কিনা এসব দিকগুলো খেয়াল করতে হবে।
অনেক সময় বাচ্চারা নিজেদেরকে গুটিয়ে নেয়, একা একা থাকে, মন খারাপ থাকে। কোন কাজে মনোযোগ দিতে না পারা, পড়ালেখাতে মনোযোগ না থাকা, দৈনন্দিন কাজে আগ্রহ না থাকা।
এছাড়া, অনেক সময় নির্যাতনের শিকার শিশু নিজের যৌনাঙ্গে হাত দিতে থাকে আবার অন্য বাচ্চাদের যৌনাঙ্গে হাত দিয়ে থাকে।
এক্ষেত্রে অভিভাবকদের করণীয় কী?
শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন অনেক ক্ষেত্রে একটা শিশু নিজেই বুঝতে পারে না কোনটা নির্যাতন। নির্যাতনকারীরা খেলার ছলে অনেক শিশুকে নির্যাতন করে, শিশুরা তখন মনে করে এটা একটা খেলা।
তাই আগে থেকেই অভিভাবকদের কিছু বিষয়ে শিশুদের সাথে কথা বলতে হবে। গুড টাচ-ব্যাড টাচ নামে যে ধারণা আছে সেটার সাথে বাচ্চাকে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। কোন স্পর্শ ভালো, কোনটা খারাপ সেটা শিশুকে বোঝাতে হবে।
মেয়ে শিশুদের ক্ষেত্রে বুক, ঠোঁট, যৌনাঙ্গ এবং পশ্চাতদেশ আর ছেলে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ঠোঁট, যৌনাঙ্গ এবং পশ্চাতদেশকে স্পর্শকাতর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই দুই বছর বয়স থেকে শিশুকে শরীরের এসব অঙ্গ সম্পর্কে ছবি একে বা গল্পের মাধ্যমে ধারণা এবং সচেতন করতে হবে। কিছুদিন পরপর তাদেরকে বিষয়টা মনে করিয়ে দিতে হবে।
পরিবারের নির্দিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া কেউ তার শরীরের এসব স্থানে হাত দিতে পারবে না এটা তাকে বলতে হবে, সেক্ষেত্রে বাবা-মা হতে পারে।
যদি শরীরের এই অঙ্গগুলো কেউ স্পর্শ করে তাহলে তাৎক্ষনিকভাবে শিশুটি চিৎকার করতে পারে এবং যাকে পাবে তার কাছে বলে দিতে হবে। আর যখন বাবা-মাকে কাছে পাবে তখনই তাদেরকে সব খুলে বলবে, এটা শেখাতে হবে।
বাচ্চাদের ছোটবেলা থেকে মন খুলে কথা বলা শেখাতে হবে। তারা যখন কিছু বলবে তখন বকাঝকা না করে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। তাহলে যৌন নির্যাতনের মত যে ঘটনাগুলো আছে সেগুলো ভয় না পেয়ে তারা বাবা-মায়ের সাথে শেয়ার করতে পারবে।
নির্যাতনের ঘটনা যদি ঘটে তাহলে কখনও বাচ্চাকে দায়ী করা যাবে না। তাকে মানসিক সমর্থন করতে হবে। তার সামনে এই ঘটনা নিয়ে বার বার আলোচনা করা বা কান্নাকাটি করা যাবে না।
গত বছরে নির্যাতনের শিকার ১৫২১ শিশু
২০২০ সালে এক হাজার ৫২১টি শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এরমধ্যে মেয়ে শিশু ১০৮৮ আর ছেলে শিশুর সংখ্যা ৪৩৩।
নির্যাতনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ৬২৬টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে মেয়ে শিশুর সংখ্যা ৬১৬ এবং ছেলে শিশুর ১০। নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছে ১৪ শিশু।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ‘শিশু পরিস্থিতি রিপোর্ট ২০২০ পত্রপত্রিকার পাতা থেকে’ প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানানো হয়। পুরো প্রতিবেদনটি আটটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ধর্ষণ রোধ করে শিশুদের নিরাপদ রাখার জন্য যে ধরনের অবকাঠামো, লোকবল বা সেবা দরকার সেগুলো এখনও অনেক কম। কিছু সার্ভিস আছে বা লোকজন আছে। কিন্তু শিশুদের বিষয় বা এধরণের ঘটনাকে কেউ সেভাবে আমলে নেন না। দায়িত্বপ্রাপ্তরা ভালোভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত না এবং শিশুদের বিষয়গুলো যেভাবে দেখা উচিত বা কেস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম থাকা উচিত সেগুলো এখনও ওইভাবে আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২০৪৫
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ