দেশে দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক সব ব্র্যান্ডের নাম নকল করে নকল স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি করছে কিছু চক্র। যা ব্যবহারের ফলে নারীরা ক্যান্সার ও বন্ধাত্বসহ মারাত্মক সব স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলেও ঋতুস্রাব বা পিরিয়ডে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ছে। ন্যাপকিনের গুরুত্ব আর ব্যবহার বেড়েছে বহুগুণে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে রাতারাতি ধনী হওয়ার আশায় বিভিন্ন চক্র নকল স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি করছে। সেগুলো আবার রাজধানীর ছোট-বড় ফার্মেসি ও নামিদামি শপিংমলসহ ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। দাম কম হওয়ায় বেশি লাভ করার জন্য অনেক দোকানি নকল স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনে আসল দামেই তা বিক্রি করেন।
কেইস স্টাডি
২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর রাজধানীর মিরপুর-২ এ হুইসপার ব্র্যান্ডের পিএনজিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের নকল স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি ও সরবরাহকারীদের গ্রেপ্তার করে পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) রতন কৃষ্ণ নাথ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক কোম্পানির নাম ব্যবহার করে নারী স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এবং নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে তৈরি বিপুল পরিমাণ নকল হুইসপার আলট্রা ক্লিন স্যানিটারি ন্যাপকিন উদ্ধার করা হয়।’
গ্রেফতারকৃত আজিম উদ্দিন (৩৫) চক্রের মূলহোতা। তার সহকারী হিসেবে কাজ করতেন গোলাম রহমান ওরফে মিথুন (৩২)।
সিআইডি ঢাকা মেট্রো-পশ্চিমের একটি টিম গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারে, একটি চক্র পিএনজি কোম্পানির স্যানিটারি ন্যাপকিন হুইসপারসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মালামাল নকল করে বাজারজাত করছে।
এমন অভিযোগের ভিত্তিতে ২৮ ডিসেম্বর মিরপুর-২ এ প্রায় টানা ১২ ঘণ্টার অভিযানে বিজনেস কোম্পানি নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে নকল স্যানিটারি ন্যাপকিনসহ তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক কোম্পানির নাম ব্যবহার করে নারী স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ও নিম্নমানের পণ্য দিয়ে তৈরি বিভিন্ন সাইজের ৪০টি কার্টনভর্তি ২২০০ প্যাকেট নকল হুইসপার স্যানিটারি ন্যাপকিন উদ্ধার করা হয়, যার বাজারমূল্য প্রায় ৪ লাখ টাকা। এ ঘটনায় মিরপুর মডেল থানায় সিআইডি বাদী হয়ে মামলা করে।
হতে পারে ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধি
নকল স্যানিটারি ন্যাপকিন নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়। পিরিয়ডের সময় পরিচ্ছন্নতায় গাফিলতি থেকে নারীর জরায়ুমুখের ত্বকে নানা সমস্যা ছাড়াও হতে পারে জরায়ু সংক্রমণ ও জরায়ুমুখ ক্যান্সার বা সার্ভিক্যাল ক্যান্সার।
ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সারের (আইএআরসি) গবেষণা বলছে, জরায়ুমুখে ক্যান্সার বাংলাদেশে নারীদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ। দেশে প্রতিবছর ৫ হাজার ২১৪ জন নারী জরায়ুমুখের ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করছেন।
বাংলাদেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারের পরই জরায়ুমুখে ক্যান্সারের অবস্থান। প্রতি বছর এই ক্যান্সারে নতুন করে আক্রান্ত হন ৮ হাজার ৬৮ জন নারী। আর তাতে মৃত্যুবরণ করেন ৫ হাজার ২১৪ জন। মোট ক্যান্সার আক্রান্ত নারীর ১২ শতাংশই ভুগছেন জরায়ুমুখের ক্যান্সারে।
জরায়ুমুখ ক্যান্সার ১৫-৪৫ বছর বয়সের নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, কিন্তু ক্যান্সারের লক্ষণ প্রকাশের প্রায় ২ থেকে ২০ বছর আগেই একজন নারী এ রোগের ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হন।
বন্ধ্যা পর্যন্ত হতে পারে
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের গাইনি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. লুৎফা বেগম লিপি বলেন, এই নকল স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের ফলে অল্প বয়সী নারীদের ইনফেকশন হলে বিবাহিত জীবনে তাদের সমস্যা সৃষ্টি হবে। তলপেটে সব সময় ব্যথা থাকবে, এমনকি অনেক সময় বন্ধ্যা পর্যন্ত হতে পারে।
নকল স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারে হাইজিন মেইনটেইন হবে না। নিশ্চয় এগুলোর গুণগত মানও ভালো না এবং এগুলো ব্যবহারে প্রজননতন্ত্রে ইনফেকশন হতে পারে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. আমানুল রসুল বলেন, নকল স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারে ইউরিন ইনফেকশন বেশি হবে। রিপিটেড ইউরিন ইনফেকশন হলে কিডনির ওপর চাপ পড়বে। এছাড়া শারীরিক নানাবিধ সমস্যা হতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ