সভ্যতার বিকাশে মুদ্রণ ও সম্প্রচার সাংবাদিকতা বিরাট অবদান রেখে চলছে। বাংলাদেশে মুদ্রণ ও সম্প্রচার সাংবাদিকতা পেশা হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। সাংবাদিকতার এ দুটি ধারাই বৈচিত্র্যময় এবং স্ফিতকায়, যাকে এখন ‘ইন্ডাস্ট্রি’ হিসেবে ধরা হয়। প্রথাগত ধারণায় বলা হয়, তথ্য ও বিনোদন পরিবেশনের জন্য মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি বিকশিত হয়েছে। তবে তথ্য ও বিনোদন প্রদানের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা
বাংলাদেশের সাংবাদিকরা রাজনৈতিক ঘটনাবলী কভার করতে গিয়ে ঘন ঘন গ্রেপ্তার ও আক্রমণের শিকার হয়ে তাদের বাকস্বাধীনতার উপর ক্রমবর্ধমান কড়াকড়ির মুখোমুখি হচ্ছেন। ২০১৬ সালে ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম ইনডেক্সে ১৫২ তম থেকে অবনতি হয়ে ১৪৪ তমে স্থানে হয়েছে।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের তথ্য অনুসারে এ বছর অন্তত ২ জন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন। নোয়াখালীর সংবাদপত্রের সাংবাদিক বোরহান উদ্দিন মুজাক্কির ফেব্রুয়ারিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলের প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলির মধ্যে সংঘর্ষের সময় গলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
এই ঘটনার পাঁচদিন পরই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার লেখক মুশতাক আহমেদ কারাগারে নির্যাতনের শিকার হয়ে নিহত হন। তিনি গত বছর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারের নানা অসংগতি তুলে ধরতেন এবং রাজনৈতিক মন্তব্য করতেন বলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হন। কারাগারে লেখক মুশতাক আহমেদকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন তাকে নির্যাতন করা হয়েছিল এবং জামিনের জন্য তার আবেদন বেশ কয়েকবার প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল।
মার্চে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে দেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে বিরোধীতা করে হেফাজত ইসলাম কর্তৃক এক সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও পুলিশ বাহিনী এবং হেফাজত কর্মী কর্তৃক অন্তত ৪০ জন সাংবাদিক আক্রমণের শিকার হয়ে আহত হন। তবে আক্রমণকারীদের কাউকেই বিচারের আওতায় আনা হয়নি।
স্থানীয় সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে হেফাজতে ইসলাম ইসলামপন্থী দল, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও পুলিশ আধিকারিকরা তখন কর্তব্যরত সাংবাদিকদের উপর হামলার সাথে জড়িত ছিল।
ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে-কে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বাক স্বাধীনতা ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আর্টিকেল নাইনটিন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বাংলাদেশে ‘মুক্ত সাংবাদিকতার’ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর করোনার মধ্যে বাংলাদেশে ৩ জন সাংবাদিক অপহৃত ও এক জন নির্যাতনের শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন। এছাড়া মোট ২৫৬ জন সাংবাদিক প্রভাবশালী পক্ষের আক্রমণের শিকার হয়েছেন। তিনটি অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করা হয়েছে বা তাদের তথ্য বা সংবাদ কোনো না কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। সাংবাদিক ও সামাজিক মাধ্যম কর্মীদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (২০১৮) আওতায় মামলার ঊর্ধ্বগতি আশঙ্কাজনক বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে৷
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ২০২০ সালে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ১৭২টি মামলার মধ্যে ৭০টি মামলা দায়ের করা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেশে মোট ৬৩টি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি করা হয় ৮৬ জনকে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এর মধ্যে আট জন সাংবাদিক। এছাড়া অজ্ঞাত আরো ৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। ৫০ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দুই জন সাংবাদিক রয়েছেন।
১১ জনের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা হয়েছে। অনলাইনে মত প্রকাশের কারণে ৪১০টি মামলা দায়েরের ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর মধ্যে ৪টি আদালত অবমাননার মামলা৷
করোনার কারণে মিডিয়া হাউজগুলোর আয় সঙ্কুচিত হওয়ায় ২০২০ সালে এক হাজার ৬০০ সাংবাদিক চাকরি হারিয়েছেন বলেও প্রতিবেদনে দাবি করা হয়৷
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের এশিয়া প্যাসিফিক ডিরেক্টর ড্যানিয়েল বাস্টার্ড ডয়েচে ভেলেকে জানান, গত এক দশকে দেশে ১৭ জন সাংবাদিক ও ব্লগার হত্যা করা হয়েছে। আর নির্যাতিতের সংখ্যা অগণিত।
বাস্টার্ড বলেন, বাংলাদেশি সাংবাদিকরা ডিউটিতে থাকাকালীন নিরাপত্তার অভাব রয়েছে এবং উচ্চ মাত্রায় সহিংসতার মুখোমুখি হন।
সিভিকাসের গবেষক জোসেফ বেনেডিক্ট একই মত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হ্রাসের মূল কারণ হল শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশে নাগরিক স্বাধীনতার উপর নিয়মতান্ত্রিক হামলা।
উভয়েই এই বিষয়ে একমত হন যে, দেশে বাকস্বাধীনতার খর্ব করার মূলে রয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যা ২০১৮ সালে পাস হয় এবং অনলাইন মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করে এমন কাউকে কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই পুলিশের গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা অর্পন করা।
বাংলাদেশে গণমাধ্যমের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল ডয়েচে ভেলেকে বলেন, “সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সাংবাদিকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে কিনা সেটা একটি বড় প্রশ্ন। কারণ, এখানে স্টেট এবং নন স্টেট ফ্যাক্টর কাজ করে।”
তার মতে, বাংলাদেশের সংবিধান মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। কিন্তু সেটা শর্তসাপেক্ষ এবং আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। আর নন স্টেট ফ্যাক্টরের মধ্যে মালিক পক্ষও আছে। তারা যদি সাংবাদিকতাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ফেলে দেন, তাহলে কিন্তু সাংবাদিক স্বাধীন নয়। সেখানে সম্পাদকও অসহায় হয়ে পড়তে পারেন। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় সেটা স্পষ্ট হয়েছে।
আর্টিকেল নাইনটিনের বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল মনে করেন, বাংলাদেশে বিবিসির মতো পাবলিক ব্রডকাস্টারের পরিবেশ তৈরি হয়নি। ফলে যা হয়েছে, তা হলো, হয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে অথবা ব্যক্তি মালিকানার নিয়ন্ত্রণে। ফলে সাংবাদিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই থাকছে।
মালিকের ব্যবসায়িক স্বার্থ
বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্ন উঠলে সাধারণত সরকারের নানা কালাকানুন, বিধিনিষেধ বা চাপের প্রতি ইঙ্গিত করেন অনেকে। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের আমলে করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কথা উল্লেখ করা হয়।
কিন্তু গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পথে বাধা কি কেবল সরকার? গণমাধ্যমের মালিক যারা— তারা নিজেরাও কি স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে বাধা সৃষ্টি করছেন না?
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের সাথে জড়িতদের অনেকে স্বীকার করছেন, সেলফ সেন্সরশিপ, অর্থাৎ নিজেরাই খবর চেপে যাওয়া বা প্রকাশ না করার ঘটনা অনেক বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশের সম্পাদক এবং সাংবাদিকরা স্বীকার করছেন, গণমাধ্যমে বিগত দশকগুলোতে যে ধরণের পুঁজির লগ্নি হয়েছে, তাতে করে মালিকের ব্যবসায়িক স্বার্থ প্রাধান্য পাচ্ছে এবং সাংবাদিকতার নয়, মালিকের স্বাধীনতার নিশ্চিত হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের মুল ধারার গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের আস্থার সংকটের অভিযোগ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা চলছে।
ঢাকার গুলশানে একজন কলেজ ছাত্রীর কথিত আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেয়ার অভিযোগে সম্প্রতি যে মামলা হয়, মামলাটির খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে মুলধারার কিছু প্রভাবশালী সংবাদ মাধ্যমে প্রথমে অভিযুক্ত বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের নাম প্রকাশ করা হয়নি।
সেই প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমে সেলফ সেন্সরশিপের ইস্যু আবারও আলোচনায় এসেছে। এই প্রবণতা উদ্বেগজনকহারে বেড়ে চলেছে বলে গণমাধ্যমের সাথে জড়িতদের অনেকে মনে করেন।
সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ বিবিসিকে বলেছেন, গণমাধ্যমে প্রশ্নবিদ্ধ পুঁজি এবং কর্পোরেট হাউজের বিনিয়োগ বেড়েই চলেছে।
তিনি মনে করেন, বিনিয়োগকারীদের অনেকে তাদের ব্যবসার স্বার্থে এবং অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতা বা রাজনৈতিক স্বার্থে গণমাধ্যমকে ঢাল হিসাবে ব্যবহারের চেষ্টা করেন।
তিনি বলেন, “মালিকদের অনেকে ক্ষমতার অংশীদার। সেই মালিকরা তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বার্থে তার প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করছে। এটি ব্যবহার করতে যেয়ে সেলফ সেন্সরশিপটা চলে এসেছে এবং এক ধরনের কর্পোরেট সাংবাদিকতার মধ্যে চলে গেছে”।
একটি বেসরকারি টেলিভিশন এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী সম্পাদক মুন্নী সাহা বিবিসিকে বলেছেন, নানা কারণে পেশাদারিত্বই হুমকির মুখে পড়েছে।
তিনি বলেন, “আমাদের এখনকার অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আমরা তারাই ভাল সম্পাদক বা ম্যানেজার, যারা ব্যবসায়িক স্বার্থটা ঠিক করে সেন্স করতে পারি, মালিকের স্বার্থটা ঠিকভাবে সেন্স করতে পারি। এছাড়া সরকারের অহেতুক খবরদারি থাকে অনেক সময়, সেগুলো যারা সেন্স করতে পারি, তারাই এখন ভাল সাংবাদিক”।
তিনি আরও বলেন, “কী করবো বা কী করবো না- সেটাও একেক সময় একেকভাবে প্রকাশিত হয়। আগ বাড়িয়ে কিন্তু আমরা এখন আর সাংবাদিকতা করতে পারি না।”
সেলফ সেন্সরশিপের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে সাংবাদিকদের অনেকেই যখন প্রতিষ্ঠানের ভেতর থেকেই চাপের অভিযোগ করেছেন, সেই অভিযোগের ব্যাপারে একাধিক মালিক সম্পাদকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা কথা বলতে রাজি হননি।
সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের একজন নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী এখন একটি ইংরেজী দৈনিকের মালিক সম্পাদক। তিনি বেসরকারি টেলিভিশন ডিবিসি নিউজেরও অন্যতম একজন মালিক।
তিনিও বলেছেন, এখন মালিকদের স্বাধীনতা রয়েছে, কিন্তু স্বাধীনতা নেই সাংবাদিকের।
তিনি বলেন, “কর্পোরেট হাউজগুলোর এখন মিডিয়ার মালিক হওয়ার একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।”
বলেন, “আমাদের এখানে নতুন যে ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে, তা হচ্ছে, কর্পোরেট গোষ্ঠীর মালিকানার যে হাউজগুলো, সেখানেও একটা বিভক্তি দেখা যায়। কখনও কখনও এক হাউজ আরেক হাউজকে তাদের ব্যবসায়িক বা রাজনৈতিক স্বার্থে আঘাত হানছে, সেখানে কিন্তু কর্মরত সাংবাদিকরা অংশীদার হয়ে যাচ্ছেন। এটি কিন্তু সাংবাদিকতার নীতি নৈতিকতার বিপরীত”।
আর্টিকেল নাইনটিনের বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, ব্যক্তি মালিকানার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনসহ নানা স্বার্থ থাকে। সেই স্বার্থের বাইরে গিয়ে কোনো সাংবাদিকের পক্ষে ওই প্রতিষ্ঠানে স্বাধীনভাবে কাজ করা সম্ভব নয়। আবার এখানে নিয়োগ বা চাকরিচ্যুত করা হয় মালিকপক্ষের ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের ভিত্তিতে। এসব কারণে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা সবচেয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকেন।
সাংবাদিকতায় বেড়েছে দলবাজি, ধস নেমেছে নৈতিকতায়
দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নীতি-নিষ্ঠতার পরীক্ষায় কিংবা নৈতিকতার চর্চায় প্রায়ই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে মিডিয়ার ভূমিকা। আকারে ও প্রকারে সাংবাদিকতা এগিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সাংবাদিকরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নীতিগর্হিত নানামুখি কর্মকাণ্ডের সাথেও নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছে। অথচ নীতি-নিষ্ঠতা সাংবাদিকের পেশাদারিত্বের অন্যতম দাবি।
বাংলাদেশে সাংবাদিকতার ‘এথিকস’ কতটুকু মানা হয়? আর নীতিহীন সাংবাদিকতার বিস্তারের কারণই বা কী? প্রশ্ন উঠেছে সাংবাদিকদের দলবাজি নিয়ে৷
দলবাজ সাংবাদিক। এটা একটা পরিচিতিমূলক শব্দবন্ধ। যে সাংবাদিক দলবাজি করে তার জন্য এবং তাকে এটা বলা হয়। অর্থাৎ তার আসল পরিচয় সাংবাদিক, এর সঙ্গে সে কিছুটা দলবাজিও করে।
সাংবাদিকতায় দলবাজির চর্চাটা আগে থেকেই ছিল। তবে ইদানিং এর অবস্থা আরও শক্তিশালী রুপে অবতীর্ণ হয়েছে। কিছু রাজনৈতিক অন্ধ কর্মী ও টাউট যেন সাংবাদিকতায় ঢুকে গেছে! স্পর্শকাতর সময়ে সাংবাদিকসুলভ নির্লিপ্ততার লেশমাত্র তারা রাখতে পারছে না। দলবাজির ‘হক’ আদায় করেই সফল সাংবাদিক হয়ে যাচ্ছে!
দলবাজ সাংবাদিকের জায়গায় মিডিয়াবাজ রাজনৈতিক কর্মীর প্রাবল্য দ্বন্দ্বমুখর এ পরিস্থিতিটাকে আরো ঘোলাটে করে তুলেছে। সাংবাদিকের দলবাজি একটা স্বতন্ত্র সমস্যা; যে কোনো দেশে এটা বড় রকম অবক্ষয় ও পতনের সূচক। কিন্তু তবু একটা সান্ত্বনার জায়গা এই ছিল যে, দলবাজি করলেও তার মূল পরিচয়টা সাংবাদিক। সাংবাদিকতা ও দলবাজি কখনো মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেলে যে মানুষটা ন্যূনতম সাংবাদিক, সে সাংবাদিকতার পক্ষে নিজেকে দাঁড় করায়। দলবাজির চাদর কিছুক্ষণের জন্য শরীর থেকে সে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
আরেকটা হচ্ছে, মিডিয়াবাজ দলীয় কর্মী। এই লোকটা আসলে সাংবাদিক না, তার প্রধান পরিচয় হলো, সে দলের অন্ধ-কর্মী। তবে দলবাজি করার জন্য সাংবাদিকতার অঙ্গনটাকে সে বেছে নিয়েছে। তার নিবেদনের জায়গা অন্ধ রাজনীতি। সাংবাদিকতা সেই রাজনীতির ব্যবহারের হাতিয়ার।
যে লোকটা আগাগোড়াই অন্ধ রাজনৈতিক কর্মী, ধান্ধা, পেশা ও জীবিকার ক্ষেত্র হিসেবে সাংবাদিকতাকে বেছে নিয়েছে, সাংবাদিকতার জন্য তার পক্ষ থেকে কোনো সুসংবাদ নেই। অন্ধ দলবাজি কখনো সাংবাদিকতার মাথায় কুঠারাঘাত করলেও সে ফেরাতে আসে না, ব্যথিতও বোধ করে না। সাংবাদিকতার জন্য তার মমতা নয়, সাংবাদিকতা কেবলই তার ব্যবহারের বিষয়, তার মমতা ও সমর্পণ সবটুকুই অন্ধ দলবাজির পায়ের কাছে।
এক সময় দেশে দল ও রাজনীতির সাথে যুক্ত সাংবাদিক থাকতো, এখন সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত অন্ধ রাজনীতিকের ভিড় বেড়ে গেছে। সাংবাদিকতা ও দলবাজির এই বিবর্তন ও বিকৃতি দেশের ‘পোকায় খাওয়া সাংবাদিকতা’কে ভবিষ্যতে কোথায় নিয়ে ফেলবে দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
গত দুই দশকে সংবাদমাধ্যমের বড় একটি অংশ তার গণমুখী চরিত্র হারিয়েছে। এরমধ্যে বেসরকারি টেলিভিশন এসেছে। এসেছে অনলাইন সংবাদমাধ্যমও। যত বেশি সংবাদমাধ্যম এসেছে, তত বেশি গণমুখী চরিত্র হারিয়েছে। আর শুধু সংবাদমাধ্যম নয়, সাংবাদিকরাও দলীয় সাংবাদিকে পরিণত হয়েছেন। আগে যেমন দলীয় মুখপত্র ছিল এখন তেমন দলীয় সাংবাদিকও আছেন। আর সংবাদমাধ্যমগুলোও দলীয় বিবেচনায় সংবাদ পরিবেশন করছে। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম তার গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখতে পারছে না। সাংবাদিকরাও তাদের মর্যাদার জায়গাটি হারাচ্ছেন। তাই এখন দলবাজ-দলদাস সাংবাদিক পদবাচ্য দু’টি খুব শোনা যায়।
সাংবাদিকতার নীতিমালা না মানায় অনেক সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে৷ কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন৷ আবার তথ্য বিভ্রান্তিতে পড়ছেন গণমাধ্যমের গ্রাহক৷ এমনকি কোনো কোনো মানুষের জীবনে চরম বিপর্যয়ও নেমে আসছে৷ আর সার্বিকভাবে গণমাধ্যম আস্থার সংকটে পড়ছে৷
সাম্প্রতিক সময়ে সাংবাদিকদের নৈতিকতা দুর্বল হয়ে যাওয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত দেখেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেন, আমাদের দেশে এখন প্রচুর সাংবাদিক হয়ে গেছে৷ এখন যে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক সাংবাদিকতা হয় তাই নয়, প্রচুর লোকজন আজকাল ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে যান, যেনতেন প্রেস কার্ড নিয়ে ঢুকে পড়েন৷ এতে করে আমাদের যে প্রাতিষ্ঠানিকতা, সেটা খুব লোপ পাচ্ছে৷ আবার সোশ্যাল মিডিয়ার নাম করেও কিছু লোকজন ভিড়ে যায়৷ এটাও একটা বড় সমস্যা৷ এই কারণে আমরা দেখছি, সাংবাদিকদের নৈতিক দিকগুলো খুবই হালকা হয়ে যাচ্ছে৷ এতে করে সাংবাদিকতার মান বা ভাবমূর্তি সবকিছুই ক্ষুন্ন হচ্ছে৷ নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষা করার জন্য সাংবাদিকদের নিজেদেরই এদিকে তাকানো দরকার৷ এটাকে সুষ্ঠু-শোভনভাবে দাঁড় করানো তাদেরই দায়িত্ব৷
তারা মনে করেন, পেশার দিকে সাংবাদিকদের আরো একটু গুরুত্ব দেওয়া, পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য যে ভদ্রতা শেখানো, নৈতিক দিক থেকে এগুলো মেনে চলা- এগুলোর জন্য প্রশিক্ষণ হওয়া দরকার৷ এগুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা হওয়া দরকার৷ না হলে সার্বিক সাংবাদিকতায় নৈতিক দিক থেকে অনেক পিছিয়ে পড়বে৷
তারা বলেন, এখন অনেকে হয়তো বলবেন, সংবাদমাধ্যম তো চাপের মুখে আছে। তার তো হাত-পা বাঁধা। এটাকে অজুহাত বলে মনে হয়। চাপ সবসময়ই ছিল। বিশ্বের কোথাও কখনও সংবাদমাধ্যম চাপমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারেনি। ভবিষ্যতেও পারবে না। কিন্তু সংবাদমাধ্যমকে তার টিকে থাকার জন্যই পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে হবে। জনগণের, গ্রাহকের আস্থায় থাকতে হবে। এটাকেই একটি স্বাধীন ব্যবসা হিসেবে দেখতে হবে। সংবাদমাধ্যম অন্য ব্যবসা বা অন্য ধরনের ক্ষমতায়নের হাতিয়ার হলে স্বাভাবিকভাবেই পরগাছায় পরিণত হবে।
তারা আরও বলেন, সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিকের কোনও দল বা কোনও দলের প্রতি সমর্থনকে খারাপ বলে মনে করি না। কিন্তু সেটা সংবাদমাধ্যম বা সংবাদ পরিবেশনে প্রভাব ফেলতে পারবে না। যদি ফেলে তাহলে সেটা দলবাজি। আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশের সংবাদমাধ্যমই আছে, যারা প্রকাশ্যেই কোনও দলকে সমর্থন দেয়। কিন্তু সংবাদে তার কোনও প্রতিফলন থাকে না। থাকে না দলবাজি। থাকে না মতলববাজি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৫
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ