মানুষের মৃত্যুকে পুঁজি করে অনৈতিকভাবে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের একশ্রেণীর মানুষ। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সারা ভারতেই প্রতিদিন হাজার হাজার রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। আর সেই মৃত রোগীদের দেহ সৎকারে চলছে রমরমা বাণিজ্য। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতায় দেহ সৎকারে বিভিন্ন ‘প্যাকেজও’ চালু হয়েছে এরই মধ্যে। অক্সিজেনের অভাবে পুরো দেশ ভুগছে শ্বাসকষ্টে। তবু এখানেও ব্যবসা ফেঁদে বসেছে কিছু মানুষ। ক্ষেত্রে বিশেষ দশগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে অক্সিজেন সিলিন্ডার। অবস্থা নিয়ন্ত্রণে কোন পদক্ষেপ নেই রাজ্য সরকারের। তারা ব্যস্ত নির্বাচন নিয়ে। একটি সংস্থার প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গে করোনা পরিস্থিতির বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ এই বিধানসভা নির্বাচন।
সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার জানিয়েছে, করোনায় মৃতদের দেহ সৎকার করা নিয়ে কলকাতা শহরে নানা অলিখিত ‘প্যাকেজ’ চালু হয়েছে। প্রতিদিন মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে যত বাড়ছে, ততই সেই সব প্যাকেজের খরচ বাড়ছে।
শ্মশানে পৌঁছে দিতে লাগছে মোটা অঙ্কের টাকা
করোনায় আক্রান্ত হলে বিপদ, এটা সকলের জানা। তবে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেও বিপদ থেকে মুক্তি নেই মৃত ব্যক্তির। এমনই ঘৃণ্য আর কুৎসিত ব্যবসায় নেমেছে কলকাতার একশ্রেণীর মানুষ। কারও থেকে স্রেফ সরকার নির্ধারিত শ্মশানে মৃতদেহ পৌঁছে দিতে নেয়া হচ্ছে ১২ হাজার টাকা, তো কারও থেকে ১৫ হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
যদিও গত বছর এই সব কাজ করতে তিন হাজার টাকার বেশি নেওয়া যাবে না বলে ঘোষণা করেছিল পৌরসভা। তবে কে মানছে সেটা! করোনায় কাতর কলকাতাকেই ব্যবসার ক্ষেত্রে বানিয়ে নিয়েছে কিছু মানুষ।
শুধু বাড়তি টাকা চাওয়াই নয়, প্রিয়জনের শেষকৃত্যের ছবি পাওয়ার বা বিশেষ কিছু জিনিস মৃতদেহের সঙ্গে পাঠানোর ইচ্ছে থাকলে সেই সংক্রান্ত খরচও আলাদা করে দিতে বলা হচ্ছে মৃতের পরিবারকে। আবার মোটা টাকার প্যাকেজ নিতে রাজি থাকলে বাড়ি বসেই মিলছে চিতাভস্ম! রয়েছে মৃতদেহের সঙ্গে শেষ বার ছবি তোলার ‘ইচ্ছাপূরণের’ সুযোগও!
ভুক্তভোগী এক কোভিডে মৃতের আত্মীয়ের মন্তব্য, ‘রাজধানীর অবস্থা রোজ দেখছি, আর ভয় ধরছে। এখানেও তেমনটা হওয়ার আগে প্রিয়জনকে সসম্মানে বিদায় জানাতে চাই। এইটুকু চাওয়া নিয়েও যারা ব্যবসা করছেন, তারা আর যা-ই হোন, মানুষ নন।’
যুক্ত আছে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল
খবরে বলা হয়, ‘লাস্ট রাইটস উইশ’, ‘গুডবাই’, ‘সি ইউ ইন দ্য অ্যানাদার ওয়ার্ল্ড’ নামে বেশ কিছু সংস্থা তৈরি হয়েছে গত কয়েক দিনে। এরাই মূলত এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা। বেসরকারি হাসপাতাল তো বটেই, সরকারি হাসপাতাল থেকেও এই সব সংস্থা কোভিড মৃতদের দেহ সৎকারের জন্য নিয়ে যাচ্ছে। বেসরকারি ক্ষেত্রে হাসপাতাল থেকেই মৃতের পরিবারের ফোন নম্বর তাদের দিয়ে দেওয়া হচ্ছে কমিশনের ভিত্তিতে।
তবে কিছু ব্যতিক্রম মানুষও আছে। যারা নিজ দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করছেন। কলকাতা পৌরসভা থেকে কোভিড মৃতদেহ শ্মশানে পৌঁছে দেওয়ার অনুমতি পাওয়া এক সংস্থার মালিক বললেন, ‘মৃত্যুর আগে যেমন রোগ নিয়ে ব্যবসা চলছে, মৃত্যুর পরে মৃতদেহ নিয়েও একই জিনিস চলছে। প্রশাসনের কোনও হুঁশই নেই। আমরা প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া তিন হাজারের বেশি এক টাকাও নিচ্ছি না। ২২টা ছেলে আমার সংস্থায় কাজ করছে।’
ষোল থেকে বিশ হাজার টাকার প্যাকেজ
আনন্দবাজারের পক্ষ থেকে হাজরা মোড়ের এমনই একটি সংস্থার নম্বরে ফোন করা হলে, মৃতের নাম, ঠিকানা, তিনি কোন হাসপাতাল ভর্তি ছিলেন জেনে নিয়ে তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘শেষকৃত্যের ছবি লাগবে? যদি লাগে, তা হলে আলাদা ১৫০০ টাকা। মৃতদেহের সঙ্গে তার পছন্দের কিছু পাঠাতে হলে আরও হাজার টাকা। সব মিলিয়ে ১৬ হাজার পাঁচশো!’
এত?— প্রশ্ন করলে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘অন্য রোগ হলে দু’হাজারও লাগত না। তা ছাড়া, আপনাদেরটা যাতে আগে হয়, সেটা আমরা দেখে দেব। বিডন স্ট্রিটের এমনই আর একটি সংস্থার আবার দাবি, ‘ছবি বা চিতাভস্ম না লাগলে আট হাজারে হয়ে যাবে। কিন্তু প্রচুর দেহ আসছে। ফলে কয়েক দিন যদি মৃতদেহটা কোথাও রেখে দিতে হয়, তা হলে কিন্তু আলাদা খরচ।’
কোথায় রাখা হবে?— এই প্রশ্নে সংস্থার দাবি, ‘পৌরসভার কোনো জায়গাই ফাঁকা নেই। রেফ্রিজারেটর বসিয়ে আমরাই একাধিক জায়গা করেছি, যেখানে দিন কয়েক দেহ থাকতে পারে।’ আর একটি সংস্থা আবার মৃতদেহের শেষকৃত্য থেকে শ্রাদ্ধের কাজ— সবই ২০ হাজার টাকায় করে দেওয়ার ‘প্যাকেজ’ ঘোষণা করেছে।
৭ হাজারের অক্সিজেনের দাম ৭৫ হাজার
অক্সিজেনের অভাবে নিদারুণ কষ্টে মরছে মানুষ। সোশ্যাল মিডিয়া এবং গণমাধ্যমে উঠে আসা বিভিন্ন ছবিতে ভারতের পরিস্থিতির ভয়াবহতায় শিউরে উঠছে গোটা বিশ্ব। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে বহু দেশ। অথচ ভারতের মধ্যেই মানুষ মৃত্যুকে নিয়ে শুরু করেছে ব্যবসা। এমনকি অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে এমন ঘৃণ্য কাজ করছে সেখানকার মানুষ।
অতিমারীতে এই অক্সিজেন আকালের আগে পর্যন্ত কলকাতায় এক একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছিল ৭ হাজার টাকায়। এখন সেই সিলিন্ডারের দাম পৌঁছেছে ৪০ হাজার থেকে ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। উত্তর কলকাতার বাসিন্দা অনুষ্কা সাহা নিজের বাবাকে বাঁচাতে অক্সিজেন সিলিন্ডার আনতে গিয়ে বুঝেছেন জীবন বাঁচাতে জীবনদায়ী গ্যাসের মূল্য আজ কোথায়! কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী অনুষ্কা বলেন, “বাবার কোভিড পজিটিভ রিপোর্ট আসার আগে থেকেই অক্সিজেনের পরিমাণ রক্তে কমতে শুরু করে। আমাদের চিকিৎসক জানান যে বাবার অক্সিজেন প্রয়োজন।”
“তখন সমস্ত সাপ্লায়ার্সদের ফোন করতে শুরু করি। একটি সিলিন্ডারের জন্য কেউ চাইছে ৩০ হাজার, আবার কেউ ৪০ হাজার।” কিন্তু বাবার প্রাণ বাঁচাতে বদ্ধপরিকর অনুষ্কা জানান তিনি সব টাকা দিয়েই সিলিন্ডার কিনতে চান। কিন্তু এরপরই অক্সিজেনের ‘ব্ল্যাক মার্কেটের’ একটি ছবি সামনে আসে।
অনুষ্কা সাহা জানান সাপ্লায়ার্স তাকে নগদ ২৭ হাজার টাকার বিনিময়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার দিতে রাজি হয়েছে। তবে উত্তর কলকাতা থেকে দক্ষিণ কলকাতায় এসে সেই সিলিন্ডার নিয়ে যেতে হবে। সব বাধাকে উড়িয়ে দিয়েই রাজি হন অনুষ্কা। কিন্তু পরবর্তীতে তাকে জানান হয় যে অন্য রোগীর থেকে বেশি টাকার বিনিময়ে সেই সাতাশ হাজারি সিলিন্ডার বিক্রি করে দিয়েছে সাপ্লায়ার্স।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৩১০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ