করোনা নিয়ে মানুষের আতঙ্কের শেষ নেই। আর কেনই বা হবে না! গোটা পৃথিবীটাকে জেলখানা বানিয়ে রেখেছে এই করোনা ভাইরাস। অহংকারে ডুবে থাকা যুক্তরাষ্ট্রকে পর্যদুস্ত ক’রে ইউরোপকে করেছে ধরাশায়ী। আফ্রিকার তাণ্ডবের মধ্যেই ভারতকে মাটিতে নামিয়ে এনেছে। বিশ্বের তাবড়-তাবড় স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে গুড়িয়ে দিতে সময় নেয়নি। সেখানে আমাদের দেশের শুরু থেকেই ধুকতে থাকা হাসপাতালগুলো যেন করোনা থেকেও বেশি আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছে। এমন রোগীর সংখ্যা অসংখ্য যাদের লক্ষণ দেখা দিলেও পরীক্ষা করাতে যায়নি, আর পরীক্ষা করালে হাসপাতাল মুখো হয়নি। তা সত্ত্বেও হাসপাতালগুলো রোগীর চাপ সইতে পারছে না। খালি নেই বেড। নাজেহাল চিকিৎসকেরা। এমন পরিস্থিতিতে, বিগত অসংখ্যবারের মতো দেশের সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।
সূত্র মতে, রাজধানীতে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের বাড়ি গিয়ে চিকিৎসাসেবা দেবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কোভিড-১৯ চিকিৎসক দল। করোনা রোগীর বাসা থেকে ফোন করলেই হাসপাতালের সুবিধা সম্বলিত অ্যাম্বুলেন্সসহ সেখানে চলে যাবেন গণস্বাস্থ্যের চিকিৎসক দল।
আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার দিকে ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের বীর উত্তম মেজর হায়দার মিলনায়তনে ‘গণস্বাস্থ্য ভ্রাম্যমাণ করোনা চিকিৎসাসেবা’র উদ্বোধন অনুষ্ঠান হয়।
ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে এই কর্মসূচি উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। উদ্বোধনকালে নতুন এই উদ্যোগ বিষয়ে ব্রিফ করেছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
‘গণস্বাস্থ্য ভ্রাম্যমাণ করোনা চিকিৎসাসেবা’
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘করোনা আক্রান্ত রোগীর বাসা থেকে ফোন করলেই সেখানে চলে যাবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কোভিড-১৯ চিকিৎসক দল। আজ থেকেই ঢাকার ভেতরে এই সেবা দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, সামনে হাসপাতালে মানুষের ভিড় আরও বাড়তে পারে। চিকিৎসক হিসেবে অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে, সব মানুষের হাসপাতালে যাওয়ার দরকার নেই। এখন আমাদের সেবা দেওয়ার এখানে দুটো বিষয়। প্রথমত, অধিক সংখ্যক পরীক্ষা করা। দ্বিতীয়ত, পরীক্ষায় শনাক্ত হয়ে কেউ যদি আমাদেরকে ফোন করে, তাহলে আমাদের চিকিৎসক দল সেখানে গিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেবে। যাতে হাসপাতালে ভিড় কমে এবং মানুষের মাঝে আতঙ্কও কমে। ফলে করোনা নিয়ে মানুষের মাঝে অহেতুক আতঙ্ক ছড়াবে না।
তিনি আরও বলেন, আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার কাজ শুরু করলে ১৫ দিন থেকে এক মাসের মধ্যে এর ইতিবাচক ফল দৃশ্যমান হবে।
যেভাবে রোগীদের দে’য়া হবে চিকিৎসা
সরাসরি রোগী বা তার পরিবার কিংবা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে থেকে ফোন পেলে ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসক দলটি উপস্থিত হবে নির্দিষ্ট বাসায়।
চিকিৎসক রোগের উপসর্গ বিবেচনা করে রোগীদেরকে চারটি ভাগে ভাগ করবেন। মৃদু, সহনীয়, সহনীয় উপসর্গের সঙ্গে সহরোগ যেমন ডায়াবেটিস, হার্ট বা কিডনি ডিজিজ, স্ট্রোক, হাঁপানি ইত্যাদি ও তীব্র করোনা রোগী।
প্রথম তিন ধরনের রোগীকে বাসায় রেখেই চিকিৎসা দে’য়া সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের চিকিৎসা দে’য়া হবে। মোবাইলে পাওয়া এক্সরের ছবি দেখে চিকিৎসক তাদের জন্যে নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ দিবেন।
টেকনিশিয়ান প্রয়োজনীয় পরীক্ষার জন্য রক্তের নমুনা সংগ্রহ করবে। করা হবে ইসিজিও। নার্স রোগী ও রোগীর লোকজনকে অক্সিজেন সিলিন্ডার ও পালস অক্সিমিটারের ব্যবহার শিখিয়ে দিবেন। প্রয়োজন হলে প্লাজমারও ব্যবস্থা করবেন এবং তা বাসাতেই দেওয়া হবে। তীব্র করোনা রোগীকে হাসপাতালে স্থানান্তর করা হবে।
যে যে এলাকায় এ সেবা দে’য়া হবে
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র জানিয়েছে, প্রথমে এই সেবা দে’য়ার জন্যে ঢাকার ধানমন্ডি, কলাবাগান, পুরান ঢাকা ও মিরপুর এলাকাকে নির্বাচন করা হয়েছে। তবে, এসব এলাকার বাইরে রাজধানীর অন্য এলাকা থেকেও কেউ যদি ফোন করে এবং যদি আমাদের কোনো দল ফ্রি থাকে, তাহলে আমরা সেখানেও এই সেবা দেওয়া যথাসাধ্য চেষ্টা করব।
পর্যায়ক্রমে পুরো ঢাকা মহানগরীর জন্যেই এই সুবিধা চালু করা হবে। আপাতত সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই সেবা দেওয়া হবে। প্রাথমিকভাবে তিনটি দল এই সেবা প্রদান করবে। ক্রমান্বয়ে দলের সংখ্যা আরও বাড়িয়ে ১০টি দল করা হবে।
আইসিইউ সুবিধাযুক্ত অ্যাম্বুলেন্সসহ প্রতিটি দলে থাকবে সিনিয়র ও জুনিয়র চিকিৎসক, নার্স, প্যাথলজি টেকনোলজিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট ও স্বেচ্ছাসেবক। দলটির সঙ্গে যাবে একটি মোটরসাইকেল এবং পোর্টেবল এক্সরে মেশিন।
করোনার নমুনা সংগ্রহ ও এক্সরে করে ক্যাসেট নিয়ে মোটরসাইকেল বাহক ফিরে যাবেন হাসপাতালে।
ফ্রি ওষুধ, এমনকি অর্ধেক খরচে করা হবে পরীক্ষা
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘গণস্বাস্থ্যের ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিম যে ওষুধ দেবে, তার জন্যে কোনো টাকা নেবে না। এ ছাড়া, করোনা পরীক্ষাসহ অন্যান্য যেসব পরীক্ষা করা হবে, সেগুলোর প্রায় অর্ধেক মূল্য নেবে তারা। যেমন বিভিন্ন পরীক্ষায় খরচ হলো ১০ হাজার টাকা, রোগীর পরিশোধ করতে হবে ছয় হাজার টাকা।’
একইসঙ্গে করোনায় আক্রান্ত রোগীর বাড়ির একজন লোককে গণস্বাস্থ্যের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। যাতে তিনি করোনা রোগীর দেখাশোনা করতে পারে। গত ২৩ এপ্রিল থেকেই প্রশিক্ষণ দেওয়ার কার্যক্রমটি শুরু করেছি আমরা। এই প্রশিক্ষণ নিতে কোনো খরচ নেই। এর জন্যে বাড়িতে থার্মোমিটার, পালস অক্সিমিটার ও ব্লাড প্রেসার মেশিন থাকতে হবে’, যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘এ ছাড়া, এখন যে কেউই গণস্বাস্থ্যের হাসপাতালে এসে করোনার চিকিৎসা নিতে পারবেন। ৪০ শয্যার একটা ইউনিট করেছি আমরা। পাঁচটি করোনা আইসিইউ, সেন্ট্রাল অক্সিজেন, কার্ডিয়াক মনিটর, ভ্যান্টিলেটর, ইসিজিসহ সব সুবিধা নিয়ে করোনা ইউনিট খোলা হয়েছে। ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে এগুলো করা হয়েছে। তারপর করোনা আইসোলেশন সেন্টারও করা হয়েছে। এখানে এখনই যেকোনো লোক এসে ভর্তি হতে পারবে।’
প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করতে সরকারের কাছে অনুরোধ
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, সরকারের কাছে কোনও ধরনের সুবিধা দেওয়ার চেয়েও বড় প্রত্যাশা হলো কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা যাতে তৈরি করা না হয়।
আমরা সবার আগে অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন কিট তৈরি করেও অনুমোদন পাইনি। স্বল্পমূল্যে ওষুধ সরবরাহ করতে চেয়েছি, সেখানেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। আমরা আরটি-পিসিআর পরীক্ষা করছি, সেখানে কোনেও ধরনের সহযোগিতা করা হয়নি। প্লাজমা সেন্টার করেছি, সেখানে কোনও সহযোগিতা পাইনি। কাজেই মহামারিকালে সরকারের কাছে সহযোগিতার চেয়েও কোনও ধরনের অসহযোগিতা না করার প্রত্যাশা থাকবে।
আমাদেরকে নির্বিঘ্নে কাজ করতে দেওয়া হোক। আমরা দেশের জনমানুষের জন্যে কাজ করছি। আমাদের কোনও ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য নেই। আমাদের উদ্দেশ্য বৈষম্য দূর করে চিকিৎসা সব মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দে’য়া। সবাইকে সেবা দিতেই আমাদের এই উদ্যোগ।
যোগাযোগ
গণস্বাস্থ্যের ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিমের চিকিৎসাসেবা পেতে ০১৭০৯-৬৬৩৯৯৪ ও ০৯৬০২১১১৯৪০— এই দুটি নম্বরে ফোন করতে হবে।
এ ছাড়াও, ‘সিওডিসিরেড এসওএস’ (CodcRed SOS) অ্যাপসের মাধ্যমেও এই সুবিধা পাওয়া যাবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর এই উদ্যোগ অত্যন্ত সময়োপযোগী। এটা যদি আমরা ঠিকমতো পরিচালনা করতে পারি, তাহলে করোনায় আক্রান্ত’রা নানাবিধ সুবিধা পাবে। এই ধরনের সুবিধা মানুষের জন্যে অত্যন্ত প্রয়োজন। কারণ, মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে, কিন্তু চিকিৎসা পাচ্ছে না কিংবা পেলেও যথার্থ চিকিৎসা পাচ্ছে না। সেক্ষেত্রে আমরা যদি সুশিক্ষিত একটি দল নিয়ে মানুষের দোরগোড়ায় গিয়ে সেবাটা দিতে পারি, তাহলে এটা জনসাধারণের জন্য দারুণ উপকারের হবে। হাসপাতালে চাপ কমবে। মানুষের মধ্যে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা গেলে আতঙ্ক কমবে। আরও সাহসের সাথে করোনা মোকাবেলা করা যাবে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২০৩৪
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ