করোনার সক্রমণ শুরু হবার পর শহরের ৭৩ দশমিক ৩ শতাংশ ও গ্রামের ৯২ দশমিক ৫ ভাগ মানুষ কাজ হারিয়ে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছেন। এই সময়ে নারীর ঘরে কাজের পরিমাণ এতটাই বেড়েছে যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৩ থেকে ৫ ঘণ্টার কাজ ৬/৭ বা ৮ ঘণ্টাতেও পৌঁছে গেছে। অর্থাৎ কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীকে আগের তুলনায় দ্বিগুণ কাজ করতে হয়েছে।
আজ শনিবার (২৪ এপ্রিল) ‘বাংলাদেশে ২০২০-এ করোনা চলাকালে সংসারের সেবাকাজের দ্রুত বিশ্লেষণ’ শীর্ষক এক জরিপ ভার্চুয়ালি উপস্থাপনের সময় এসব তথ্য উঠে আসে।
পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট ফোরাম ‘ফরমাল রিকগনিশন অফ দ্যা উম্যান’স আনকাউন্টেড ওয়ার্ক’ এর উদ্যোগে জরিপটি পরিচালনা হয়। এতে নেতৃত্ব দেন শারমিন্দ নিলোর্মী, সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
এই ফোরামের সদস্য সংস্থাগুলো হচ্ছে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংস্থা, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ, অক্সফাম ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।
এই সময়ে গ্রাম ও শহরের পরিবারগুলোতে কত মানুষ কাজ হারিয়েছেন, দারিদ্রের হার কতটা বেড়েছে, নারীর আয় কতটা কমেছে, ঘরে নারী-পুরুষের কাজের আনুপাতিক হিসাব, ইত্যাদি তুলে ধরার লক্ষ্যে জরিপটি পরিচালনা করা হয়েছে।
২০২০ সালের নভেম্বরে করোনা সংক্রমণের মধ্যেই জরিপের কাজ শুরু হয়েছিল। জরিপ চলে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত। দেশের ৯টি জেলায় শহরের ও গ্রামের বিভিন্ন পেশা ও বয়সের মধ্যে জরিপটি চালানো হলেও জরিপের পরিপ্রেক্ষিতের কথা ভেবে নারী উত্তরদাতার সংখ্যা বেশি ধরা হয়েছে। উত্তরদাতাদের ৮৭ শতাংশ নারী, ১৩ শতাংশ পুরুষ, ১ শতাংশ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। তাদের মধ্যে ২১৯ জন গ্রামের, ২২৪ জন শহরের। জরিপে অংশ নেওয়া ৫৮ শতাংশের বয়স ৩১ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। উত্তরদাতাদের মধ্যে ৪৭ শতাংশ গৃহিণী, বাকিরা অন্যান্য পেশায় যুক্ত।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, করোনার আগে গৃহিণীদের ৭১ দশমিক ৫ শতাংশ সাধারণত ৩ থেকে ৫ ঘণ্টা সময় অমূল্যায়িত গৃহস্থালী কাজে ব্যয় করতেন। করোনাকালে এসে এদের ৩৭ দশমিক ৮ শতাংশের কাজের সময় বেড়েছে। সেটি ৬/৭ ঘণ্টা থেকে শুরু করে ৮ ঘণ্টাতেও পৌঁছেছে কারও কারও ক্ষেত্রে। অর্থাৎ ঘরের কাজে আগের তুলনায় অনেক নারীকেই দ্বিগুণ সময় ব্যয় করতে হয়েছে। এই সময়ে ঘরের কাজে পুরুষের অংশগ্রহণও বেড়েছে।
জরিপে উঠে এসেছে, ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ নারীপ্রধান পরিবার অর্থনৈতিক অনটনে পড়েছে। এদের মধ্যে অধিকাংশই অনানুষ্ঠনিক খাতের। নারীদের অনেকেই কাজ বা চাকরি হারিয়েছেন। পাশাপাশি বেড়েছে অস্বাভাবিক মাত্রায় ঘরের কাজের চাপ। সার্বিক অর্থনৈতিক সংকটে এসব সেবা কাজকে আলোচনায় আনার কারণ বাংলাদেশে কাজে নিযুক্ত মানুষের মধ্যে ৯১ দশমিক ৩ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। তাদের ৯৬ দশমিক ৭ শতাংশ নারী।
জরিপে আরও উঠে এসেছে, রান্না করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও ধোয়ার কাজ গ্রামীণ নারীর মতো শহুরে নারীদেরও বেড়েছে। তবে তুলনামূলকভাবে এই কাজের চাপ বেড়েছে শহুরে নারীদের মধ্যে— এর পরিমাণ ১২৮ শতাংশ। শতকরা ৮৫ ভাগ কর্মজীবী নারী অমূল্যায়িত গৃহস্থালী কাজে অনেকটা সময় দিয়েছেন এবং সেটা ৪ ঘণ্টারও বেশি। শহরের নারী উত্তরদাতাদের কাছে গৃহস্থালী কাজের মধ্যে প্রথম দিকে আছে স্বামীর সেবা করা। এরপর আছে সন্তান ও পরিবারের অন্যদের দেখাশোনা করা।
জরিপে দেখা যায়, করোনাকালীন সময়ে সেবা কাজের আলোচনায় সার্বিক অর্থনৈতিক সংকটকে করোনাকালে শহর ও গ্রাম মিলিয়ে ৪৮.৪৯ শতাংশ পরিবার থেকে অন্তত একজন কাজ হারিয়েছেন বা কাজ পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কাজ হারিয়ে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছেন শহরের ৭৩.৩ ভাগ মানুষ এবং গ্রামের ৯২.৫ ভাগ মানুষ।
জরিপে অংশগ্রহণকারী উত্তরদাতাদের মধ্যে শতকরা ৭৬ জন বলেছেন, মহামারির সময়ে তাদের পরিবারের আয় কমে গেছে। ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা আয়কারী ব্যক্তিদের মধ্যে শতকরা ৬৮ জনের আয় কমেছে। এর মানে হচ্ছে এই মানুষগুলো দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়েছেন। ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয়কারীদের শতকরা ৭৩ জনের আয়ও হ্রাস পেয়েছে।
ফলাফলে আরো দেখা যায়, কৃষিনির্ভর পরিবারগুলোর অবস্থা কিছুটা ভালো থাকলেও, যারা অকৃষি কাজের সাথে জড়িত অর্থাৎ শ্রমজীবি মানুষের অবস্থা বেশি খারাপ।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের দেখতে হবে এই অনানুষ্ঠানিক কাজকে আমরা কীভাবে জাতীয় ডেটা বেইজে সন্নিবেশিত করতে পারি। আমরা নারীর এই শ্রমকে আসন্ন অর্থবছরের এসএনএ-তে যোগ করতে চাই। নারী যে প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষায় কাজ করছে, সেটারও একটা মনিটরিং ভ্যালু বের করতে হবে।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সোকো ইশিকাওয়া বলেন, ‘ইউএন ওম্যান সবসময় এই কাজের সঙ্গে ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। তবে আমাদের ভাবতে হবে— নারীর এই কাজকে আমরা কীভাবে দৃশ্যমান করবো।’
সভা প্রধানের বক্তব্যে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, ‘নারীর কাজকে দায়িত্ব মনে না করে যেদিন কাজ বলে মনে করতে শিখবো, সেদিনই নারীর কাজের মূল্য যোগ হবে।’
অনুষ্ঠানে প্রধান বিশেষ অতিথি ছিলেন— ইউএন উইম্যানের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ সোকো ইশিকাওয়া, জরিপের ওপর আলোচনা করেন সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন এবং ফিন্যান্স ডিভিশনের ডেপুটি সেক্রেটারি মেহেদী মাসুদুজ্জামান। আরও বক্তব্য রাখেন— বিএনপিএস-এর নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর, অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর সারাহ কবীর এবং অক্সফামের উইম্যান এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড কেয়ার প্রোগ্রামের ম্যানেজার সার হল।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ