গুলজার হোসেন উজ্জ্বল
কথিত শিশু বক্তা ওরফে মাদানী হুজুর ওরফে রফিকুল ইসলাম গ্রেফতার হয়েছেন। তার গ্রেফতারের পর সংবাদ মাধ্যম মারফত জানতে পারলাম তার মোবাইলে প্রচুর পর্ণ ভিডিও পাওয়া গেছে। এছাড়াও জনৈক নারীর সাথে গোপন সম্পর্কের আলামতও মিলেছে।
মাওলানা রফিক ২৭ বছরের একজন যুবক। তার মোবাইলে পর্ণ ভিডিও পাওয়া এমন কোন বিচিত্র ঘটনা নয়, অনেকের দৃষ্টিতে অপরাধও নয়। বয়ঃসন্ধি থেকেই এই বিষয়ে আমাদের কৌতুহল তৈরি হয়। এটা স্বাভাবিক। তবে পর্ণ একধরণের সেক্স ফ্যান্টাসি, রিয়েলিটি নয়। একে বাস্তব মনে করলে সমস্যা। সেটা ভিন্ন আলোচনা। সে আলোচনা আজ থাক। তবে পর্ণ সংরক্ষণ একজন আলেমের নৈতিক অবস্থানের সাথে সাংঘর্ষিক এ কথা বলাই যায়।
রাষ্ট্র একজন নাগরিকের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন, আলাপচারিতা, ব্যক্তিগত সম্পর্ক উন্মোচন করছে, মিডিয়ায় প্রকাশ করছে এটা কি ঠিক হচ্ছে? প্রশ্নটি কোন কোন সচেতন নাগরিকদের। কেউ কেউ প্রশ্নটি করছেন রাজনৈতিক অবস্থান থেকেই। হেফাজতে ইসলাম, মাওলানা মামুনুল, মাওলানা রফিক এখন শুধু ধর্মীয় শিক্ষকই নন নানাভাবে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে, বিব্রত করে, সরকারকে মুরতাদ ঘোষণা দিয়ে, ধ্বংসাত্মক আচরণ করে, কোভিড ভ্যাক্সিনের গাড়ি ভেংগে, রাষ্ট্রীয় স্থাপনা ও ম্যুরাল ধ্বংস করে তারা সরকারকে এবং পুরো সমাজকে একটি বার্তা দিয়েছেন। সরকার সেই বার্তা অনুভব করেছে এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। যারা আদর্শিক ও রাজনৈতিক কারণে সরকারের বিরোধী তারা ও এ বার্তা অনুভব করেছেন বলেই আমার বিশ্বাস।
সরকার ও মিডিয়া কি নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে নষ্ট করছে? উপরের দুটি ঘটনায় অবশ্যই করেছে। মিডিয়া এই কাজ আজ থেকে নয় অনাদিকাল থেকেই করছে। সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সকল ব্যাক্তির স্ক্যান্ডাল নিয়ে তারা সারাজীবনই কাজ করে এসেছে। বিনোদন জগত তো বটেই, রাজনৈতিক ব্যক্তিদেরও।
প্রশ্ন হলো সরকার সেটা পারে কিনা। এখানে অনেক সুক্ষ বিচার আছে। বিশেষজ্ঞরা আরো ভাল বলতে পারবেন।
রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ব্যক্তিজীবনকে দেখার ভিন্ন নৈতিকতা আছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ও মনিকা লিউনেস্কির সম্পর্ক আমেরিকার মত সমাজে যেখানে ব্যক্তির প্রায়ভেট স্পেস অনেক বেশি সেখানেও ব্যপকভাবে আলোচিত হয়েছে৷ এমনকি প্রেসিডেন্টকে ইম্পিচও করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে মাদ্রাসা শিক্ষকদের ধরে ধরে তাদের চরিত্রহনন করছে। যা ব্যাক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থী। তাদের যারা শুভাকাঙ্ক্ষী তারা অভিযোগ করছেন কেন প্রগতিশীলরা এর প্রতিবাদ করছেন না৷
আমার কাছে মনে হয়েছে সমস্যা অন্য জায়গায়। উনারা আসর জমিয়ে সমাজ থেকে অশ্লীলতা, বেহায়াপনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বলেন। নারীদের পোশাক ও জীবনাচরণ নিয়ে নোংরা মন্তব্য করেন৷ নরনারীর সম্পর্ক নিয়ে মোরাল পুলিশিং করেন। কিন্তু নিজেরা গোপনে তাদেরই কথিত বেহায়পনার চর্চা করেন৷ একারণে তাদের দ্বিচারিতা উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় অনেকেই আনন্দ পেয়েছে। গুলজার হোসেনের মোবাইলে পর্ণ পাওয়া গেছে এই সংবাদ মোটেও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করবেনা৷ এমনকি ওবায়দুল কাদেরের মোবাইলে পর্ন পাওয়া গেছে এটাও কাউকে টানবেনা। তবে মোস্তফা জব্বারের মোবাইলে পাওয়া গেলে অনেকেই কৌতুক অনুভব করবে।
বিগত কয়েকবছরে মাদ্রাসাপন্থীরা রীতিমতো হুংকার গর্জন দিয়ে সমাজের একাংশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ফেলেছে। উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়েছে। বুদ্ধিজীবিদের কাফের, মুনাফেক সহ আরো অনেকরকম গালমন্দ করেছে। সরকারকে মুরতাদ বলেছে। সমস্ত প্রগতি, বিজ্ঞান, করোনা, ভ্যাক্সিন সব কিছুর বিরুদ্ধে নিজেদের দাড় করিয়েছে। তাদের সাথে জুটেছে একদল ‘ঠিক ঠিক’বলা মানুষ। ফলে এদের দ্বিচারিতা উন্মোচন এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।
অনেকেই ভাবছে সরকার কি ধোয়া তুলশিপাতা?
না তা নয়। কিন্তু হেফাজতে ইসলাম যা করছে তা সরকার বিরোধী আন্দোলনও নয়। এরা যা করছে তা কেবলই ব্যক্তিগত ফায়দা হাসিল। ফলে আপাত দৃষ্টিতে এদের সরকারবিরোধী বিপ্লবী মনে হলেও এরা আসলে এদের পূর্বসুরি গুরু মাওলানা শফির মতই সুবিধাবাদী, লোভী।
আওয়ামীলীগ ব্যক্তির চরিত্র নিয়ে কাজ করেনা। মাদ্রাসা পন্থীরা করে৷ কারণ তাদের দাবী তারা ধর্মের হেফাজতকারী। তাদের দাবী তারা ব্যাক্তি ও সমাজের নৈতিকতার শিক্ষক।
আওয়ামীলীগ ক্ষমতাকেন্দ্রিক দল। তারা কাজ করে জনশক্তি ও পেশি শক্তি নিয়ে। তারা কারো রূহানী বাবা বা ভাই নয়। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সুবিধা নেয়। তবে সেটিও পার্থিব রাজনৈতিক চেতনা। তাদের এজেন্ডা পরিষ্কার, হিডেন কিছুনা। তাদের এজেন্ডা আধ্যাত্মিক বা আল্লাহ পাকের প্রবর্তিত ধ্রুব কিছুও নয়। তারা জনগণের স্পিরিচুয়াল বায়াসনেসকে ব্যাবহার করছেনা৷ ফলে রাজনীতির খেলায় যে কোন প্রকার খেলা খেলবে তারা এটাই বাস্তবতা। নিজের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীকে সুযোগ পেলেই ধরাশায়ী করবে। কারণ খেলাটা লেভেল প্লেয়িং নয়। মানুষের ধর্মীয় আবেগ নিয়ে কাজ করছে একটি দল। যে আবেগ কোন বাছবিচার না করেই আজগুবি কথাকেও ‘ঠিক ঠিক’ বলে সমর্থন দিতে পারে।
হেফাজতের জন্ম হয়েছে কৃত্রিম উপায়ে রাজনীতির ল্যাবরেটরিতে, একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে, বিশেষ রাজনৈতিক প্রয়োজনে৷ এখন অব্দি তারা যেসব ইস্যুতে মুভমেন্ট করেছে দুই একটা বাদে তার সবই রাজনৈতিক। কিন্তু তারা নিজেদের রাজনৈতিক বলতে নারাজ। তাদের প্রকাশ্য, সুগঠিত রাজনৈতিক কাঠামো নেই। কিন্তু সকল সরকার বিরোধি জনগোষ্ঠীর সহানুভুতি তাদের পক্ষে আছে এটা বুঝাই যায়। কারণটিও স্পষ্ট৷ মামুনুল হকরা এখন শুধুই মাদ্রাসা শিক্ষক নয়, তারা সরকার বিরোধিতার এই মুহুর্তের একমাত্র Viable agent. ফলে সকল আওয়ামী বিরোধী শিবিরের সহযোগিতা ও সহানুভুতি তাদের পক্ষে আছে৷
এই পরিস্থিতিতে যে দায়িত্বশীলতা ও পরিপক্কতা তাদের থাকা দরকার ছিলো তা আমি মনে করি তাদের নেই৷ সরকারের বিরোধিতা করলেও সেটিই তাদের মূল উদ্দেশ্য কিনা তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। অতীতে তাদের আদর্শিক গুরু মাওলানা শফি হাত মিলিয়েছিলো সরকারের সাথে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে মুসাফা করে কওমী সনদের স্বীকৃতি সহ আরো অনেক সুবিধা তারা আদায় করে বেশ কিছুদিন পোষ মেনে শান্ত ও সুবোধ হয়ে দিনাতিপাত করেছিল। সেসব নিয়ে তাদের নিজেদের ভেতরেও কম জলঘোলা হয়নি। সুতরাং বলা যায় সরকারবিরোধিতা নাকি গোষ্ঠি স্বার্থ উদ্ধার এটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে।
হেফাজতের নেতাদের মূল পেশা ওয়াজ। এই কাজে তাদের আয় বাংলাদেশের তুলনায় অবিশ্বাস্য রকমের বেশি। তারা নিজেদের ওয়াজেই বলে থাকেন ডায়েরি খালি নাই, শিডিউল খালি নাই। শিডিউল মেলাতে বাধ্য হয়ে তারা হেলিকপ্টার ব্যাবহার করেন। হেলিকপ্টারে সমস্যা নেই৷ আমি বোঝাতে চাইছি বাংলাদেশে ওয়াজের বাজারটা কত বড়৷ এত বড় বাজার ছেড়ে তারা সরকার বিরোধী রাজনীতির ঝুঁকিগুলো নেবেন সেটা আমার মনে হয়না। তাদের সর্বোচ্চ গন্তব্য হলো উত্তেজনা তৈরি করে, আমজনতাকে স্নায়ুর ক্ষরণ উপহার দিয়ে নিজেদের মেঠো বক্তৃতার জনপ্রিয়তাকে বাড়িয়ে নেওয়া৷
হেফাজতে ইসলাম সরকার বিরোধিতা করতে পারবেনা তা নয়, অবশ্যই পারবে৷ সেক্ষেত্রে তাদেরকে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা ও ঘোষণা দিয়েই আসতে হবে। সরকারের দূর্নীতি, অদক্ষতা, স্বজনপ্রীতি, ব্যর্থতা এসব নিয়ে কথা বলতে হবে৷ “এই সরকার আলেম বিরোধী” এরকম মাজুল কথাবার্তা আর মোরাল পুলিশিং দিয়ে আওয়ামী সরকারকে টলানো যাবে বলে মনে হয়না। তাহলে “তুমি কেমন আলেম” সেটা কাপড় খুলে বলে দেওয়াটাও সরকার তার দায়িত্ব বলে ধরে নেবে। এখানে পারসোনাল স্পেইস, প্রাইভেসি নিয়ে কথা বলা অর্থহীন।
কেউ সেইন্ট বা সাধু নয়। কিন্তু ধর্মগুরুরা দাবী করে তাদের সেইন্ট হিসেবে ট্রিট করা হোক। সেক্ষেত্রে তাদের দায়িত্বও বেশি থাকার কথা। কিন্তু যুগে যুগেই আমরা দেখেছি এর ব্যতিক্রম হয়েছে। বরং ছদ্মবেশে সেইন্টিজমের সুবিধা নেওয়া হয়েছে৷
ছদ্মবেশি শয়তান যখন ফেরেশতার ভেক ধরে তখন তারা প্রকাশ্য শত্রুর চেয়েও ভয়ংকর হয়। রাজনীতির মাঠে গোপন শত্রুর খেলা কখনোই ফেয়ার প্লে হয়না। এটাই বাস্তবতা। তাই সরকার যা করছে তা ফেয়ার প্লে নয়। সরকার এখানে ফেয়ার প্লে করতে বাধ্যও নয়।
মতামত ও বিশ্লেষন বিভাগে প্রকাশিত সকল মতামত লেখকের নিজস্ব এবং এটি State Watch এর সম্পাদকীয় নীতির আদর্শগত অবস্থান ধরে নেওয়া ঠিক হবে না। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, স্টেটওয়াচ কর্তৃপক্ষের নয়।
আপনার মতামত জানানঃ