গুলজার হোসেন উজ্জ্বল
আমাদের বিনোদন জগত ও গণমাধ্যমটি ছিল এককালে তৃণমূল সংষ্কৃতি কর্মীদের দখলে। তারাই নেতৃত্ব দিত। আমাদের নাটক ও চলচ্চিত্রে যারা কাজ করেছেন তারা অনেক ত্যাগ, অধ্যবসায় আর মেধার দীপ্তি দিয়ে আমাদের শৈশব, কৈশোর সমৃদ্ধ করেছেন এবং রাঙিয়ে দিয়ে গেছেন।
একুশ শতকে পা দেওয়ার পর থেকে একরকম অস্থিরতা শুরু হয়। একুশে টিভি আমাদের একটা নতুন আশার আলো দেখিয়েছিল। বেশ কজন মেধাবী শিল্পী ও নির্মাতা আমরা একসংগে পাই। কিন্তু একুশে বন্ধ হবার কিছুদিন পর থেকে শুরু হয় অস্থিরতা। মেধাবীরা নিজেদের গুটিয়ে নিতে থাকেন। বলা যায় বাধ্য হন। অনেক পুরনো মেধাবী নির্মাতা ও কুশলীরা কর্মহীন হয়ে পড়েন। অনেক নামকরা মিডিয়া ব্যক্তিত্ব অফিস গুটিয়ে নেন। অনেক টাকার লস খেয়ে পথে বসার উপক্রম হন।
এইসময়ে বাজারে আসেন এক শ্রেনীর অশিক্ষিত অসাংষ্কৃতিক নির্মাতা ও প্রযোজক। এদের মূল কাজ দালালি।
কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই৷ আমি মফস্বলের নিবেদিত সংষ্কৃতিকর্মী ছিলাম। ডাক্তারি পাশের কয়েকবছর পর ঢাকায় এসে শুরুতেই নাট্যজগতে সম্পৃক্ত হবার চেষ্টা করি। টুকটাক কাজ করে এর চারপাশের জগত ও পরিবেশ বুঝবার চেষ্টা করি। আমি একসময় নিয়মিত ছোটগল্প লিখতাম। আমার গল্পগুলোকে নাট্যরুপ দিতে চেষ্টা করি। অল্প দিনের ভেতর আমি একটি শর্ট ফিল্ম, চারটি নাটক, দুটো ডকুমেন্টারি ও একটি কমার্শিয়াল এডের স্ক্রিপ্ট লিখি। এগুলো নির্মিত হয়। প্রচারিত হয় টিভিতে, বিটিভি সহ তিনটি বেসরকারি চ্যানেলে। নেপথ্য নির্মানেও কিছুটা সময় দেই। টেকনিক্যাল দিকগুলো বুঝতে চেষ্টা করি স্রেফ আগ্রহ থেকে। একটি নাটক প্রযোজনাও করি। সর্বশেষ একটি প্রযোজনা সংস্থার হয়ে পঞ্চাশ পর্বের স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুষ্ঠান গ্রন্থনা ও পরিচালনা করি। ২০১২ সালে এমডি কোর্সে ঢোকার পর বিনোদন জগতে আমার এই অভিযানের ইতি ঘটে।
চারবছরের এই জার্নিতে আমি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি তা ভয়াবহ৷ প্রতারণা, মিথ্যা আর নানাবিধ অপরাধমূলক কর্মকান্ডের এক মিথজীবি পরিবেশ এই মিডিয়া সেক্টর। বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা নেই। সভ্যতা, ভদ্রতা, সুসংষ্কৃতি,পেশাদারিত্ব, কমিটমেন্টের বালাই নেই। কে কাকে কত সুচারুভাবে ঠকাতে পারে যেন তারই প্রতিযোগিতা। ঝড়ের বেগে কেউ কেউ আসছেন। বিপুল জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন আবার মিলিয়ে যাচ্ছেন।এসেই বাড়ি গাড়ি করে হুলস্থুল বাধিয়ে দিচ্ছেন। তারপর নাই। কেউ কেউ মনোযোগী হয়ে উঠছেন বহুবিধ যোগাযোগ আর মাফিয়াবৃত্তির দিকে।
গত বিশবছরে অধিকাংশ মিডিয়াকে ডমিনেট করতে শুরু করে কতগুলো এডফার্ম। এই এডফার্ম গুলোর মালিক বিপুল ধনী। এরা মূলত ব্যবসায়ী ছিলেন। গ্ল্যামার আর ভিন্ন আনন্দের লোভে এরা মিডিয়াতে অর্থলগ্নি করে৷ এরা একেকটা চ্যানেলকে মূলত কিনে ফেলেন। নিজেদের ঘরানার পরিচালক,অভিনেতা-অভিনেত্রী দিয়ে, নিজেদের পছন্দ মাফিক নাটক বানাতে থাকেন। দেখা যায় একেকটা ঈদ পার্বনে সবগুলো চাংক তারা নিজেদের দখলে নিয়ে নেন। টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ এদের কাছে জিম্মি। কারণ চ্যানেলের টাকা আসে এদের হাত দিয়েই। এরা এড এজেন্সিও বটে।
কে কার সাথে শোবে এটাতে আমাদের সমস্যা নেই। কিন্তু একটা সুক্ষ সুদুরপ্রসারি সমস্যা আছে৷ এভাবে মেধাবিদের বদলে বেশি বেশি কাজ পেতে থাকেন মেধাহীন, ব্যক্তিত্বহীন এক দল শিল্পী নামধারী অশিল্পী। তাদের দল ভারি হলে সরে যেতে থাকেন আমাদের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত তৈরি শিল্পীরা।
এইসব এজেন্সির বহুমাত্রিক ব্যবসা থাকে। ঠিকাদারি ব্যবসাও থাকে৷ নায়িকারা নায়িকা হতে এদের কাছে ধরনা দেয়৷ এরা ধরনা দেয় রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর লোকদের কাছে ঠিকাদারি কাজ পেতে। কাজ পেতে ক্ষমতাধর লোকদের খুশি রাখতে হয়। নানারকম ঘুষ, উপহার বা তোফার মধ্যে থাকে একেকজন সুন্দরী নায়িকা।
ধরা যাক একজন এডফার্মের মালিক কোন কোম্পানির এড এর কাজ পেতে চান। কোম্পানির এমডিকে উপহার হিসেবে দিলেন একজন উঠতি নায়িকাকে। নায়িকা আপু স্বেচ্ছায় সেখানে গেলেন কারণ ক্লায়েন্ট খুশি থাকলে কাজ সেও পাবে। তারও লাভ।
এই পর্যন্ত হলে মন্দ ছিলোনা। গিভ এন্ড টেইক। কে কার সাথে শোবে এটাতে আমাদের সমস্যা নেই। কিন্তু একটা সুক্ষ সুদুরপ্রসারি সমস্যা আছে৷ এভাবে মেধাবিদের বদলে বেশি বেশি কাজ পেতে থাকেন মেধাহীন, ব্যক্তিত্বহীন এক দল শিল্পী নামধারী অশিল্পী। তাদের দল ভারি হলে সরে যেতে থাকেন আমাদের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত তৈরি শিল্পীরা। আরো সমস্যা হচ্ছে সমাজের ক্ষমতাশীল মানুষদের সাথে এদের নানাবিধ যোগাযোগ বাড়তে থাকায় তারা মাত্রাতিরিক্ত উচ্চাভিলাসী ও আগ্রাসী হয়ে ওঠেন৷ একেকজন শিল্পি হয়ে ওঠেন এই স্টেইটের মাফিয়া চক্রের মধ্যমনি। মাদক থেকে শুরু করে হিউম্যান ট্র্যাফিকিং সহ নানারকম অপরাধমূলক কর্মকান্ডে তারা জড়িয়ে পড়েন৷ কারো কারো মূল পেশা হয়ে দাঁড়ায় ব্ল্যাক মেইলিং। কেউ যৌনকর্মী হলেও আমার আপত্তি নেই। দুনিয়ার সব দেশেই এই পেশা বিদ্যমান। কিন্তু তিনিও কাজ করবেন একটা পেশাদারিত্বের মধ্যে। ব্ল্যাক মেইলিং, প্রতারণা এগুলো যৌনকর্মীর পেশাদারিত্বের জন্যও হুমকি।
কিছুদিন আগেও আমরা দেখেছি একজন জাতীয় পুরষ্কার প্রাপ্ত নৃত্যশিল্পী নারী পাচারের সাথে জড়িত হিসেবে ধরা পড়েছেন। সারা বছর নাটক বা সিনেমায় কাজ না করেও অনেক নায়িকা বা মডেলদের দেখছি অল্প সময়ে ব্যাখ্যার অতীত অঢেল সম্পদের মালিক হতে। কেউ বিত্তশালী হলে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু অবৈধভাবে হলে তার প্রভাব পড়ে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে৷
প্রতিটি সমাজেই অপরাধী থাকে। অপরাধীর জেন্ডার খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছুনা। যেহেতু যৌনতা ও গ্ল্যামার এখানে একটি প্রভাবক উপাদান হিসেবে কাজ করে তাই সেখানে নারী শিল্পীরা আলোচ্য হন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই নিয়ে মুখরোচক স্পাইসি আলাপও হয়। এটা বাস্তবতা। নায়িকারা যখন ভাল করেন তখন তারা প্রশংসা ও সম্মানও পান। এই পরিমনি কম সিম্প্যাথি পান নি দেশের আমজনতার কাছে। গালি দিলেও তার বিশাল ফলোয়ার গ্রুপ প্রমান করে মানুষ তাকে আগ্রহ নিয়ে দেখে। এটাও একপ্রকার প্রাপ্তি। এর মান না রাখলে উল্টোটাও হবে৷ এইদেশের মানুষ কি কবরী, শাবানা,ববিতাকে দুহাত ভরে ভালবাসা সম্মান দেননি? সিনেমা হলে গিয়ে আমরাকি শাবানার দুঃখে অশ্রুপাত করিনি? তাহলে আজ কেন একজন নায়িকার গ্রেফতারে ট্রলে মেতেছি? দোষ কি কেবল আমাদের? নায়িকার দায় নেই?
আমাদের ত্রুটিপূর্ণ সমাজ কাঠামো, রাজনীতি অপরাধী তৈরির মূল কাজটি করে। তৃতীয় বিশ্বের প্রায় সব দেশেরই রাজনীতি করাপ্টেড৷ এই করাপশনের ভেতর দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে কেউ কেউ। আইনের শাসন নেই নেই করেও আছে। না থাকলে রাষ্ট্র ভেংগে পড়ত।
প্রায় সব দেশে, সব অপরাধীরই গড ফাদার থাকে৷ গড ফাদার স্বাভাবিকভাবেই আড়ালে থাকেন। আড়ালে থেকে কাজ করতে পারেন বলেই তিনি গড ফাদার। গড ফাদার দৃশ্যমান নন বলে রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনে তারা ধরা পড়েন না৷ অধিকাংশ অপরাধে এদের কোন চিহ্নও থাকেনা। গড ফাদার ধরা পড়ছেন না বলে তাদের অপরাধ হালকা হয়ে যায়না। যার যার অপরাধের দায় তার তার।
অনেক অপরাধী নিজেই হয়ে ওঠেন নানামুখি অপরাধের কারিগর। একক গডফাদারও থাকেনা তাদের। ছোট অপরাধ করতে করতে ক্রমেই সাহসী হয়ে ওঠেন। নিজের ক্ষমতার গন্ডি ভুলে যান৷ দুর্বীনিত হয়ে ওঠেন৷
আমাদের ত্রুটিপূর্ণ সমাজ কাঠামো, রাজনীতি অপরাধী তৈরির মূল কাজটি করে। তৃতীয় বিশ্বের প্রায় সব দেশেরই রাজনীতি করাপ্টেড৷ এই করাপশনের ভেতর দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে কেউ কেউ। আইনের শাসন নেই নেই করেও আছে। না থাকলে রাষ্ট্র ভেংগে পড়ত। আইন শৃংখলা বাহিনীরও কিছু লিমিটেশন থাকে। সব অপরাধী ধরা পড়ছেনা বলে, সব সমস্যার সমাধান হচ্ছেনা বলে কাউকেই ধরা যাবেনা এমন কোন কথা নেই৷
দুবছর আগেও এই দেশে ক্ষমতাসীন দলের অনেক প্রভাবশালী মাফিয়া নেতা ধরা পড়েছে। যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা কোনদিন ভাবেনি যে সে ধরা পড়বে। এদেশে এমন ইতিহাস নেই যে ক্ষমতাসীন দলের পদধারী নেতা দল ক্ষমতায় থাকতে দূর্নীতির দায়ে জেলে গেছে৷
র্যাবের সাম্প্রতিক কর্মকান্ডকে আমি এপ্রিসিয়েট করি। এটা মুখোশ উন্মোচনের খেলা। যারা সংষ্কৃতি কর্মীর মুখোশে বিরাট অপরাধচক্র সামলাচ্ছেন তাদের চেনা দরকার। চিয়ার্স র্যাব।
খুব স্ট্রং এভিডেন্স ছাড়া একজন সেলিব্রিটি নায়িকাকে গ্রেফতার করার মত ঝুঁকি যে তারা নেবেনা, এটা যেকোন কান্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ বুঝবেন। স্রেফ ব্যক্তিগত ইগোর খেলা এটা না। র্যাব সেটা জানে বলেই বিপুল সদস্য মোতায়েন করে সতর্কতার সাথে কাজগুলো করছে। একেকটা নায়িকার ঘরে অবৈধ পানশালা শুধু ব্যক্তিগত মদ্যপানকেই ইংগিত করেনা। ইংগিত করে এক বিরাট অপরাধ চক্রের কেন্দ্রবিন্দুর দিকে। যারা ভাবছেন শুধু মদ উদ্ধার করার অভিযান এটা, তারা শিশুতোষ ভাবনায় আটকে আছেন।
মুখোশ আরো আছে হয়ত৷ সব হয়ত ধরা পড়বেনা৷ কিন্তু যাদের ধরা সম্ভব তাদের ধরে ফেললেও অন্তত একটা বার্তা যাবে বলে আমি মনে করি।
দেশে করোনা পরিস্থিতি খারাপ বলে তো আর এসব কাজ বসে থাকবেনা। ঘরবন্দী মানুষ করোনা ভীতি ভুলে বাংলাদেশের খেলা দেখছে, নায়িকাদের গ্রেফতার দেখছে। ডাক্তাররা খেটে মরছে৷ যার যা কাজ, সে সে তা করবে। কিছু করার নেই।
যা করছেন করুন, সমস্যা নেই। শুধু মাস্কটি পড়ুন। যাদের দায়িত্বে স্বাস্থ্যখাত তারা হাসপাতালের দেখভাল করুন। সমস্যা তো ওখানেও আছে। সেসব নিয়েও আমরা কথা বলব। ভুলে যেন না যাই।
মতামত ও বিশ্লেষন বিভাগে প্রকাশিত সকল মতামত লেখকের নিজস্ব এবং এটি State Watch এর সম্পাদকীয় নীতির আদর্শগত অবস্থান ধরে নেওয়া ঠিক হবে না। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, স্টেটওয়াচ কর্তৃপক্ষের নয়।
আপনার মতামত জানানঃ