নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের ‘রয়েল’ রিসোর্টে নারীসহ হেফাজত ইসলামে কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হককে অবরুদ্ধ করার ঘটনার লাইভ করা স্থানীয় এক সাংবাদিকের বাড়িতে হেফাজতের কর্মীরা হামলা চালিয়েছে। এ সময় ওই সাংবাদিককে পিটিয়ে আহত করার পাশাপাশি তার ঘরের আসবাব ভাঙচুর করা হয়েছে। গতকাল সোমবার(৫ এপ্রিল) রাতে তাকে আহত অবস্থায় সোনারগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
সোনারগাঁ উপজেলার সনমান্দি ইউনিয়নের নাজিরপুর ভান্টি চর এলাকায় সোমবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
আহত সাংবাদিক হাবিবুর রহমান ‘চ্যানেল এস’ নামের একটি বেসরকারি সংবাদমাধ্যমের সোনারগাঁ প্রতিনিধি।
হাবিবের ছোট ভাই মোফাজ্জল হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ঘরে ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল আমার বড় ভাই হাবিব। রাত সাড়ে ৯টার দিকে হেফাজতের নেতা-কর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে আমাদের বাড়িতে হামলা করে। তারা ঘরের বিভিন্ন আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। টেনেহিঁচড়ে ঘরের বাইরে নিয়ে গেছে হাবিবকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মামুনুল হকের বাহিনী কয়েক দফায় লাঠি দিয়ে পিটিয়েছে আমার ভাইকে। মারধর করে তার দাঁত ভেঙে ফেলেছে।
এসময় হেফাজতের নেতাকর্মীরা হাবিবুর রহমানকে মারধর করে ঘরের বাইরে নিয়ে আসে। পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ক্ষমা চাইতে বলে মামুনুলের কাছে। সেই ভিডিতে দেখা গেছে, মামুনুলের অনুসারীরা সাংবাদিক হাবিবকে লাঞ্ছিত করছে।
তাদের মধ্যে একজন বলছে, হুজুরের (মামুনুল হক) কাছে মাফ চাইতে হবে, হুজুর যাতে আপনাকে ক্ষমা করে দেয় এ জন্য। আরেকজন বলছেন, আপনি বলবেন, হুজুর (মামুনুল হক) কাছে আমি ক্ষমা চাই। সাংবাদিক হিসেবে সেখানে গিয়ে ভুল করেছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।
তাদের কথা মতো ক্ষমা না চাওয়ায় সাংবাদিক হাবিবকে টেনে হিচঁড়ে মারধর করে সড়কের পাশে নিয়ে যায়। সেখানে কয়েক দফায় মারধর করে হাবিবের দাঁত ভেঙে ফেলে। লাইভে ক্ষমা চাওয়ার পর ফেসবুক লাইভ বন্ধ করে তাকে মারধর করে রাস্তার পাশে ফেলে রাখে হেফাজতকর্মীরা। পরে তার পরিবার এলাকাবাসীর সহযোগিতায় হাসপাতালে ভর্তি করে।
এসময় ৯৯৯ নাম্বারে ফোন করে পুলিশকে খবর দেন সাংবাদিক হাবিবের ছোটভাই মোফাজ্জল হোসেন।
আহত সাংবাদিক হাবিবুর রহমান বলেন, মামুনুল অনুসারীরা শনিবার থেকেই আমাকে নানাভাবে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল। তাদের ভয়ে আমি শনিবার থেকেই ঘরবন্দি। গতকাল শতাধিক হেফাজতকর্মী বাড়িতে হামলা চালালে আমি সোনারগাঁ থানা পুলিশের সহযোগিতা চাই। পুলিশ পৌঁছানোর পূর্বেই তারা আমাকে মারধর করে। আমার চিৎকারে এলাকাবাসী এগিয়ে আসলে তারা পালিয়ে যায়। বর্তমানে আমি ও আমার পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।
এ ঘটনায় আজ মঙ্গলবার দুপুরে সাংবাদিক হাবিবুর রহমান বাদী হয়ে ১৫ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৭০/৮০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে সোনারগাঁ থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।
সোনারগাঁ থানার পুলিশ পরিদর্শক খন্দকার তবিদুর রহমান জানান, এ ঘটনায় থানায় লিখিত অভিযোগ নেওয়া হয়েছে। মামলার প্রস্তুতি চলছে।
গত শনিবার নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের একটি রিসোর্টে এক নারীকে নিয়ে গিয়ে অবরুদ্ধ হন মামুনুল হক। কয়েক ঘণ্টার হাঙ্গামার পর হামলা চালিয়ে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা।
মামুনুল দাবি করতে থাকেন ওই নারী তার দ্বিতীয় স্ত্রী। দুই বছর আগে তারা বিয়ে করেছেন।
তবে মামুনুল তার কথিত দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার বাবার যে নাম বলেছেন, বাড়ি যেখানে বলেছেন, তার সঙ্গে সেই মেয়ের বক্তব্যের মিল নেই।
মামুনুল দাবি করেন, তার স্ত্রীর নাম আমেনা তাইয়্যেবা। শ্বশুরের নাম জাহিদুল ইসলাম। বাড়ি খুলনায়। তবে মেয়ে জানান, তার নাম জান্নাত আরা ঝর্ণা। বাবা ওলিয়র রহমান। বাড়ি ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার কামারগাঁও গ্রামে।
এর মধ্যে মামুনুলের আসল স্ত্রীর সঙ্গে তার, স্ত্রীর সঙ্গে মামুনুলের বোনের আর ঝর্ণার সঙ্গে হেফাজত নেতার মোবাইল কথোপকথন হিসেবে তিনটি অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়। এগুলো বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রকাশ হয়।
জানা যায়, হেফাজত নেতা মামুনুল হককে এক নারীসহ অবরুদ্ধ করে ওই সময় স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিক উপস্থিত হয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করে ফেসবুকে লাইভ করেন। ঘটনার সময় চ্যানেল এস নামের একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সোনারগাঁ প্রতিনিধি হাবিবুর রহমান মামুনুল হকের দাড়ি ধরে টান দিয়েছে, এমন অভিযোগ তোলে হেফাজতকর্মীরা। এ ঘটনার পর থেকে হেফাজত নেতাকর্মীরা তাকে মারধরের হুমকি দেয়। পরবর্তীতে সাংবাদিক হাবিবুর রহমান নিজেকে আত্মগোপন করে রাখেন। গতকাল সোমবার রাতে সনমান্দি ইউনিয়নের ভাটির চর গ্রামে নিজ বাড়িতে ঘুমন্ত অবস্থায় হেফাজতকর্মীরা হামলা চালায়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সাংবাদিকদের জীবনের নিরাপত্তা এ দেশে নেই। একের পর এক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। কিন্তু বিচার হয় না। এভাবে চলতে পারে না। এ দেশে মানুষের কোনো নিরাপত্তা নেই। সাংবাদিকদের জীবনও নিরাপত্তাহীন। কাজ করতে গিয়েও মামলা-হামলার শিকার হতে হয় তাদের। স্বাধীন দেশে এটা মেনে নেওয়া যায় না।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মফস্বলের প্রত্যেকটা সাংবাদিক পরিচিত। সবাই সবাইকে চেনে। ওখানে কোন সংবাদ হলে তাকে টার্গেট করা সহজ। ঢাকায় সেটা সম্ভব না। মফস্বলের সাংবাদিক প্রতি মুহুর্তে, প্রতিদিনই ঝুঁকির মধ্যে থাকে।মফস্বল সাংবাদিকদের কোনো ধরনেরই নিরাপত্তা নাই৷ আর্থিক বা শারীরিক কেনোটাই না৷ অধিকাংশ সাংবাদিক বেতন পান না আবার প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও দুর্বৃত্তদের চাপের মুখে থাকতে হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১৩৩
আপনার মতামত জানানঃ