১১ বছরের আগে দান্তেওয়াড়ার চিন্তলনার গ্রামে অভিযানে গিয়ে মাওবাদীদের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন ৭৬ জন ভারতীয় জওয়ান। সেই স্মৃতি তাজা হয়ে উঠল আরও একবার। শনিবার ছত্তিশগড়ে মাওবাদীদের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে ২২ জন সিআরপিএফ জওয়ান নিহত হন। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৩১ জন, নিখোঁজ এখনও একজন। সূত্র মতে, নিহতের সংখ্যা বাড়তে পারে।
শনিবার ছত্তিশগড়ে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার সময় এই হামলার ঘটনা ঘটে। রবিবার ভারতীয় কর্মকর্তারা এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
গত দুসপ্তাহের মধ্যে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার মাওবাদীরা নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর বিধ্বংসী আঘাত হানল, তবে এত বড় মাপের হামলা গত চার বছরের মধ্যে এই প্রথম।
ছত্তিশগড়ের সুকমা-বিজাপুর সীমানায় মাওবাদী দমন অভিযানে নেমেছিল সিআরপিএফ বাহিনী। সেখানেই মাওবাদীদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে আধাসেনা বাহিনীর ২২ জওয়ানের মৃত্যু হয়েছে।
রবিবার দুপুরে বিজাপুরের পুলিশ সুপার কমললোচন কাশ্যপ একটি জাতীয় পর্যায়ের সংবাদমাধ্যমকে জানান, ছত্তিশগড়ের সুকমা-বিজাপুর সীমান্তে মাওবাদী হামলায় ২২ জন জওয়ান প্রাণ হারিয়েছেন, জখম হয়েছেন ৩১ জন।
মাওবাদীদের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান
শুক্রবার রাতেই তারেম, উসুর, পামেড, মিনপা ও নারসাপুরম রাজ্যের এই পাঁচটি পয়েন্ট থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর দু’হাজারেরও বেশি সদস্য বস্তারের গহীন জঙ্গলে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে একযোগে যৌথ অভিযান শুরু করেছিল।
রাজ্যের অ্যান্টি-মাওয়িস্ট ফোর্সের ডেপুটি আইজি ও পি পল জানান, শনিবার দুপুর নাগাদ তারেম থেকে রওনা হওয়া একটি টহলদার বাহিনীর সঙ্গে জোনাগুডা গ্রামের কাছে মাওবাদী গেরিলাদের ‘এনকাউন্টার’ শুরু হয়।
বেশ কয়েক ঘন্টা ধরে চলা ওই বন্দুকযুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর বহু সদস্য হতাহত হন, তাদের অনেকেরই খোঁজ মিলছিল না।
গত মধ্যরাতের পর বস্তার রেঞ্জের পুলিশ মহাপরিদর্শক পি সুন্দররাজন সংবাদমাধ্যমকে জানান, দুটি হেলিকপ্টার পাঠিয়ে আহতদের নিয়ে আসা হয়েছে, তারা একজনের মরদেহও নিয়ে ফিরেছে।
এর আগে শনিবার মাওবাদী দমন অভিযানে ৫ জন আধাসেনা জওয়ানের মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছিল ছত্তিশগড়ের পুলিশ। রবিবার সকালে সেই সংখ্যা কিছুটা বাড়ে।
এর আগে ছত্তিশগড়ে পুলিশের মাওবাদী দমন শাখার ডিরেক্টর জেনারেল অশোক জুনেজা জানান, নিহত জওয়ানের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৮। খোঁজ মিলছে না আরও অন্তত ২১ আধাসেনা জওয়ানের।
রবিবার সকালে সিআরপিএফের ডিরেক্টর জেনারেল কুলদীপ সিং-ও পৌঁছে যান সুকমা-বিজাপুর সীমান্তে। ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেল জানান, নিখোঁজ জওয়ানদের খুঁজতে উদ্ধারকারী দল পাঠানো হয়েছে সুকমা-বিজাপুর সীমান্ত এলাকায়। পরে জানা যায় নিখোঁজ জওয়ানদের অধিকাংশেরই খোঁজ মিলেছে। তাদের মধ্যে ২২ জনই নিহত হয়েছেন মাওবাদীদের গুলিতে।
ছত্তিশগড় প্রশাসন জানিয়েছে, মাওবাদীদের গুলিতে জখম আধাসেনা জওয়ানদের মধ্যে ২৪ জনের চিকিৎসা চলছে বিজাপুর হাসপাতালে। বাকি ৭ জনের জখম গুরুতর হওয়ায় তাদের পাঠানো হয়েছে রায়পুরের হাসপাতালে।
ভারতীয় কর্তাব্যক্তিদের উদ্বেগ
মাওবাদীদের সঙ্গে সংঘর্ষে আধাসেনা জওয়ানদের মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। নিহত জওয়ানদের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না বলে টুইটও করেন মোদী।
ছত্তিশগড়ের কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাগেল আসামে নির্বাচনী প্রচারে ব্যস্ত ছিলেন, তড়িঘড়ি নিজের রাজ্যে ফেরার আগে তিনিও ঘোষণা করেন, মাওবাদীদের বিরুদ্ধে এখন অভিযান চালানো হবে দ্বিগুণ শক্তিতে।
তিনি বলেন, আমি যা খবর পেয়েছি টানা চার ঘন্টা ধরে লাগাতার বন্দুকযুদ্ধ চলেছে। সংঘর্ষে নকশালবাদীদের বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমাদের জওয়ানরাও শহীদ হয়েছেন, আমি তাদের পরিবারকে সমবেদনা জানাচ্ছি এবং কথা দিচ্ছি যে তাদের শাহাদাত ব্যর্থ হবে না। আমরা এখন নতুন শক্তিতে লড়ব, আর মনে রাখতে হবে মাওবাদীদের এখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে এবং তারা নিজেদের অস্তিত্ত্ব বাঁচানোর লড়াই লড়ছে।
দিল্লিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর সঙ্গে জরুরি আলোচনা সেরে ছত্তিশগড়ের দিকে রওনা দেন সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স বা সিআরপিএফের প্রধান কুলদীপ সিং।
রবিবার দুপুরে রাজধানী রায়পুরে সাংবাদিক বৈঠক করে আধাসামরিক বাহিনী সিআরপিএফের প্রধান কুলদীপ সিং দাবি করেন, বস্তার অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার নির্মাণ ঠেকাতেই মাওবাদীরা এই হামলা চালিয়েছে।
তিনি বলেন, সিলগেড় থেকে বাসাগুডা পর্যন্ত পূর্ব-পশ্চিমমুখী রাস্তা তৈরি হয়ে গেলে জোন সি-র গেরিলাদের পাহাড়ের দিকে যাওয়া কঠিন হয়ে যাবে, আমরা জাগরগুন্ডা থানা এলাকায় অনেক বেশি জওয়ান মোতায়েন করতে পারব।
এটা আটকাতেই তারা বড় আকারের হামলার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু সরকারি নীতি এতে পাল্টাবে না, ফোর্সও এগোবে এবং আমরা ক্যাম্পও বসাব আরও দ্রুত।
প্রসঙ্গত, গত ২৩ মার্চ রাজ্যের নারায়ণগড় জেলায় মাওবাদীরা পুলিশের একটি বাসে হামলা চালালে পাঁচজন ডিস্ট্রিক্ট রিজার্ভ গার্ড বা ডিআরজি সদস্য প্রাণ হারিয়েছিলেন। তবে মাওবাদীদের কোনও হামলায় কম করে বাইশজন জওয়ানের মৃত্যুর ঘটনা শেষবার ঘটেছিল ২০১৭ এর এপ্রিল মাসে, সেটাও এই সুকমাতেই।
ভারতে মাওয়াবাদী আন্দোলন
প্রথম সরকারবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ১৯৬৭ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নাকশালবাড়ি নামক এক সুদূর গ্রাম থেকে। একজন কৃষককে তার জমি চাষ করতে না দেয়া থেকে বিরোধ শুরু হয়ে তা রূপ নেয় সরকারবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে। যা স্থায়ী হয় ৭২ দিন। তবে ঐ সময় নাকশালবাড়িতে সংগঠিত আন্দোলন প্রতিরোধ করা গেলেও তা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা মাওবাদী মতাদর্শীদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠে।
নাকশালবাড়ি থেকেই পরবর্তীতে নাকশালবাদ শব্দটি আসে এবং নাকশালবাড়ি আন্দোলনের অনুকরণে সংঘটিত আন্দোলনে জড়িত ব্যক্তিরা নাকশালবাদী হিসেবে পরিচিতি পায়। এছাড়াও তাদেরকে মাওবাদী নাকশালবাদীও বলা হয়। তবে ১৯৭২ সালের মধ্যেই সরকারের কঠোর দমন নীতির ফলে প্রাথমিক পর্যায়ের মাওবাদী বিদ্রোহীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এরপর দীর্ঘদিন পর্যন্ত মাওবাদী বিদ্রোহীরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি।
ভারতের মাওবাদী আন্দোলনের বর্তমান পর্যায়টির সূচনা মূলত ২০০৪ সাল থেকে। ১৯৭৬ সালে ভারতের অন্ধ্র-প্রদেশে পিপলস ওয়ার গ্রুপ (পি ডব্লিউ জি) বা জনযুদ্ধ নামে (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী) একটি বিদ্রোহী সংগঠন সক্রিয় ছিলো। এছাড়া একই সময়ে পূর্ব ভারতের বিহার রাজ্যে মাওবাদী কমিউনিষ্ট সেন্টার (এম সি সি) নামে আরেকটি সংগঠন কার্যক্রম চালাচ্ছিলো। তারপর ১৯৯২ সালে ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টি (সি পি আই) নামে একটি মাওবাদী গ্রুপ যাত্রা শুরু করা যা ভারতের তিনটি রাজ্যঃ অন্ধ্র-প্রদেশ, ছত্তিশগড় ও মহারাষ্ট্রে কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে।
অবশেষে ২০০৪ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর পিপলস ওয়ার গ্রুপ ও ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টি একত্রিত হয়ে ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টি(মাওবাদী) নামে বর্তমান মাওবাদী বিদ্রোহের সূচনা করে। বর্তমানে ভারতের অন্ধ্র-প্রদেশ, ঝাড়খন্ড, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উড়িশ্যা, ছত্তিশগড় সহ বিভিন্ন রাজ্যে মাওবাদী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতে মাওবাদী বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা গুলো “রেড করিডোর” নামে পরিচিত।
মাওবাদী বিদ্রোহের কারণ
ভারতের মাওবাদী আন্দোলনের মূল লক্ষ্য দরিদ্র, নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায় করা। প্রাথমিকভাবে ১৯৬৯ সালে মাওবাদী নেতা মুপালা লক্ষন রাও এর নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গে কৃষাণ বিদ্রোহের মাধ্যমে মাওবাদী আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনের কারণ ছিলো গরিব কৃষকদের প্রতি ধনী হিন্দু ভূস্বামীদের অন্যায় আচরন ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলা। কিন্তু দরিদ্র কৃষকদের ক্ষোভ-দুঃখ প্রশমিত করার পরিবর্তে মাওবাদী বিদ্রোহীদের দমনে সমাজের উচ্চবিত্ত শোষক শ্রেণির সহায়তায় ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোরতা বিদ্রোহীদের সশস্ত্র আন্দোলনের দিকে ঠেলে দেয়।
একদম শুরু থেকে পর্যবেক্ষন করলে দেখা যায় যে, মাওবাদী বিদ্রোহ ও তাতে আদিবাসীদের সম্পৃক্ততার অনেক কারণ রয়েছে। সীমাহীন দারিদ্র, ভূমিকরদের শোষণ, সম্পদের অসম বন্টন, জীবন ধারণের মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত হওয়া ইত্যাদি। এছাড়াও নিরাপত্তা বাহিনীর অত্যাচার ও অকথ্য নির্যাতন থেকে বাঁচতে আদিবাসীরা মাওবাদী বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেয়।
নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে আদিবাসীদের যৌন নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও বিভিন্ন ধরণের হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংগঠনের কর্মীরা এই সকল বিষয়ে লেখালেখির ফলে তারাও নিরাপত্তা বাহিনীর লক্ষ্যে পরিণত হয়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত নজরদারি বাহিনী গুলো বিভিন্ন কারণে নির্দোষ গ্রামবাসীদের হয়রানি করে থাকে। এ সকল নজরদারি বাহিনীর বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতন ও হত্যা সহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। এসকল বিষয় গুলোই মাওবাদী আন্দোলন কে তরান্বিত করতে ভূমিকা পালন করেছে।
এসডব্লিউ/এসএস/২৩৫০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ