গণতান্ত্রিক সমাজ ও মানবাধিকার সুরক্ষায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অত্যাবশ্যক। সংবাদমাধ্যম সরকার ও নেতাদেরকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করে। দমন-পীড়ন, সহিংসতা, গ্রেফতারের ভীতি এবং সেল্ফ সেন্সরশিপ ছাড়াই গণমাধ্যমকর্মীদের কাজ করতে পারা উচিত।
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের দায়মুক্তি অবসানের আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে গতকাল সোমবার আর্টিকেল-১৯ এর উদ্যোগে আয়োজিত ভার্চুয়াল মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশী কূটনীতিকরা এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আগামী ১৬ নভেম্বর কানাডা ও বাতসোয়ানার যৌথ উদ্যোগে আহূত গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য বিশ্ব সম্মেলন সামনে রেখে আর্টিকেল-১৯ এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। মতবিনিময়ের ওপর ভিত্তি করে নেয়া ‘ঢাকা ঘোষণা’ গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য বিশ্ব সম্মেলনে উত্থাপন করা হবে।
সভার প্রথম অধিবেশনে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, আইন বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা নিজেদের মত তুলে ধরেন। সমাপনী অধিবেশনে জাতিসঙ্ঘের আবাসিক প্রতিনিধি মিয়া সেপ্পো, য্ক্তুরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার, ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট ডিকসন, কানাডার হাইকমিশনার বেনোয়া প্রিফনটাইন, নরওয়ের রাষ্ট্রদূত ইসপেন রিকেট এবং ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত উইনি পিটারসন বক্তব্য রাখেন। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূতরা এতে যোগ দেন। জাতিসঙ্ঘের আবাসিক প্রতিনিধি বলেন, সাংবাদিকরা আক্রান্ত হলে পুরো সমাজকেই মূল্য দিতে হয়। গণমাধ্যমকর্মীদের সুরক্ষা দিতে না পারলে আমাদের তথ্য জানার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে, যা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলে। সাংবাদিকরা নিরাপদে কাজ করতে না পারলে আমরা মহামারী নিয়ে তথ্যবিভ্রাটের শিকার হতে পারি।
আর্ল রবার্ট মিলার বলেন, যুক্তরাষ্ট্র মুক্ত গণমাধ্যমের জোরালো সমর্থক। সাংবাদিক ও মুক্ত সংবাদমাধ্যম আমাদের সত্য জানতে সহায়তা করে। এটা অনেক সময় সুখকর হয় না এবং এর সাথে অনেকে দ্বিমতও পোষণ করেন। তবে মুক্ত গণমাধ্যম নির্বাক মানুষের কণ্ঠস্বর। সংবাদমাধ্যম নেতাদেরকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করে, সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। সঙ্কটের সময়ে গণমাধ্যমের ভূমিকা আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেদের স্বাধীনতা, এমনকি জীবনও সাংবাদিকদের উৎসর্গ করতে হয়। এ সব সাহসী গণমাধ্যমকর্মীর প্রতি আমরা শ্রদ্ধা জানাই। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় সমাজকেও ভূমিকা রাখতে হয়।
কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য মুক্ত গণমাধ্যম অপরিহার্য মন্তব্য করে ব্রিটিশ হাইকমিশনার বলেন, মহামারীর সময়ে তথ্যের অবাধ প্রবাহ আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের সাংবাদিকরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে সুনামের অধিকারী। অনেক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ বেশ সক্রিয়, যারা বিভিন্ন ইস্যুতে বিতর্ক করেন। তিনি বলেন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ব্রিটেনের অনুসৃত নীতিগুলোর মধ্যে অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। সাংবাদিকদের সক্ষমতা বাড়াতে ও সমর্থন দিতে ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশন কাজ করে যাচ্ছে।
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের দায়মুক্তি অবসানের আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে আর্টিকেল-১৯ এর আয়োজনকে সমর্থন দিতে ঢাকায় অবস্থানরত বিভিন্ন দূতাবাস ও হাইকমিশনের এগিয়ে আসাকে স্বাগত জানান কানাডার হাইকমিশনার। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক সমাজ ও মানবাধিকার সুরক্ষায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অত্যাবশ্যক। সংবাদমাধ্যম সরকারকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করে। দমন-পীড়ন, সহিংসতা, গ্রেফতারের ভীতি এবং সেল্ফ সেন্সরশিপ ছাড়াই গণমাধ্যমকর্মীদের কাজ করতে পারা উচিত। তিনি বলেন, বিশ্বের অনেক দেশেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণœ হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তার অভাব মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পূর্ণ বাস্তবায়নে বাধা হয়ে আছে।
মতবিনিময় সভা শেষে নেয়া ঢাকা ঘোষণার খসড়ায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০১৮ সালে আর্টিকেল-১৯ সাংবাদিকসহ মতপ্রকাশের অধিকারের সাথে যুক্তদের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইন এবং পরবর্তী সময়ে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের (ডিএসএ) আওতায় ৭১টি মামলা রেকর্ড করেছে। ২০১৯ সালে ডিএসএর অধীনে মামলা হয়েছে ৬৩টি। আর চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই এ ধরনের মামলার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৩। মতপ্রকাশজনিত অপরাধের জন্য ২০৮ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সাংবাদিকের সংখ্যা ৫৩। অভিযুক্তদের মধ্যে ১১৪ জনকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাদের বেশির ভাগই এখনো জামিনের অপেক্ষায় রয়েছেন। ঘোষণায় মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বিলুপ্ত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ন্যাশনাল সাইবার ইনসিডেন্স রেসপন্স টিম (সিআইআরটি) গঠন এবং যথাযথভাবে কার্যকর করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য সিআইআরটিতে মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক ও বিচারিক কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের অনুমোদনের ভিত্তিতে ঢাকা ঘোষণা চূড়ান্ত করা হবে।
খবর : নয়াদিগন্ত,পৃষ্ঠা ১ / ০৩ নভেম্বর ২০২০
আপনার মতামত জানানঃ