কবির হোসেন : স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষ্যে শ্রীলংকায় তামিলদের বিরুদ্ধে গণহত্যায় সমর্থন এবং মিয়ানমারে গণহত্যা চালানো জান্তা সরকারের এক পার্টিতে অংশগ্রহণ করে সমালোচনার মুখে পড়ে বাংলাদেশ। দেশে চলমান স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করার পাশাপাশি দেশ দুইটির ঘৃণ্যতার সাথে বাংলাদেশ কেন একীভূত হলো যা বাংলাদেশের সম্পূর্ণ বিপরীত, এনিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়। সেসব সমালোচনার জবাব দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।কেন শ্রীলংকার গণহত্যায় বাংলাদেশ সমর্থন জানাল এবং মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রতিরক্ষা অ্যাটাশ কেন অংশগ্রহণ করেছিল তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি।
গতকাল বুধবার(৩১ মার্চ) ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলন নিয়ে আয়োজিত ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব প্রশ্নের ব্যাখ্যা দেন।
শ্রীলংকায় তামিলবিরোধী অভিযানে গণহত্যার অভিযোগ এনে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে একটি প্রস্তাব আনা হয়েছে। যেখানে বাংলাদেশ ওই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে শ্রীলংকার পক্ষে ভোট দিয়েছে। যদিও শ্রীলংকার বিপক্ষে আনা প্রস্তাবটি পাস হয়েছে। গণহত্যা প্রশ্নে শ্রীলংকাকে সমর্থনের কারণে বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থান সমালোচিত হচ্ছে।
জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তামিলবিরোধী যে অভিযান হয়েছিল, সেখানে তদন্তের প্রশ্নে শ্রীলংকা কখনো না বলেনি। বারবার বলেছে তদন্ত করবে। আর জাতিসংঘে কোনো দেশের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আনা হলে বাংলাদেশ তা সমর্থন করে ভোট দেয় না। এটা বাংলাদেশের অবস্থান।
তিনি বলেন, ‘এমনকি অতীতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে প্রস্তাবেও বাংলাদেশ ভোট দেয়নি। প্রতিবেশীদের প্রতি বাংলাদেশ সব সময় এ অবস্থান বজায় রাখে। তা ছাড়া এই যে প্রস্তাব আনা হচ্ছে, সেটা বিশেষ উদ্দেশ্যে কি না, সেটা দেখার আছে।’
স্বতন্ত্র তামিল রাষ্ট্রের দাবিতে পরিচালিত গৃহযুদ্ধ প্রায় আড়াই যুগ স্থায়ী হয় এবং তাতে প্রায় ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ লোকের মৃত্যু হয় বলে জাতিসংঘের অনুমান। ২০০৯ সালে তামিল বিদ্রোহের অবসান ঘটার পর জাতিসংঘ উভয় পক্ষের বিরুদ্ধেই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনে। তবে শ্রীলঙ্কার সরকার তখন দাবি করেছিল যে তামিল যোদ্ধারা বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। শ্রীলংকার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তখন চরম নিষ্ঠুরতার অভিযোগ ওঠে।
বিশ্লেষকরা বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় শ্রীলংকা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে সমর্থন না দিলে বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এভাবে হানা দেওয়া সম্ভব হতো না এবং বাঙালিদের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ এতটা ব্যাপকতা পেত না। ভারতের ওপর দিয়ে বিমান পরিচালনার অনুমতি না থাকায় তখন পাকিস্তান কলম্বোয় জ্বালানি নেওয়ার বিরতি নিয়ে ভারত সাগরের ওপরের করিডর দিয়ে ঢাকায় সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র পাঠায়।
তারা বলেন, নিজ দেশে ১৯৭১ সালে গণহত্যার ভয়াবহ ইতিহাস আছে আমাদের, এই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাই আমরা, এরজন্য পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিচার চাই। আর আমরা নিজেরা কিনা ভোট দেই শ্রীলঙ্কায় গণহত্যার বিচারের প্রস্তাবের বিপক্ষে!
এদিকে মিয়ানমারে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে গত মঙ্গলবার চীন, রাশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, লাওস ও ভিয়েতনামের পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা উপস্থিত হন। ওই দিন সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অন্তত ১১৪ জন নিহত হন। ওই কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণকারী দেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা হয়।
মিয়ানমারে সামরিক জান্তাবিরোধী আন্দোলনে যে দিন সবচেয়ে বেশি বিক্ষোভকারীর মৃত্যু ঘটেছে, সেই দিন নেপিডোতে দেশটির সশস্ত্র বাহিনী দিবসের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রতিরক্ষা অ্যাটাশের অংশগ্রহণ নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়। এ ঘটনায় শুধু মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামীরা ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়েছেন তা-ই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানবাধিকারকর্মী এবং গণতন্ত্রপন্থীরাও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশসহ আটটি দেশের অংশগ্রহণের ঘটনায় সমালোচনা চলছে এখনো।
এবিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমারের সেনা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে একা অংশ নেননি। বাংলাদেশসহ আটটি দেশের প্রতিনিধিরাও অংশ নিয়েছেন। আর সেটি একটি রুটিন অনুষ্ঠান।
আব্দুল মোমেন আরও বলেন, মিয়ানমারকে আমরা পর্যবেক্ষণে রেখেছি। তবে এটা (সশস্ত্র বাহিনীর অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ) নিয়ে যারা হইচই করছেন, তারা কিন্তু মিয়ানমারের সঙ্গে ব্যবসা বন্ধ করেননি। সেখানে ২৫ হাজার রোহিঙ্গা মারা গেল, নির্যাতন হলো, তখন তো তারা মিয়ানমারকে বর্জন করেননি।
পশ্চিমা দেশগুলোর সমালোচনা করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র মাত্র গতকাল (মঙ্গলবার) সেনাবাহিনীর একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবসা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তো সেখানে ব্যবসা অব্যাহত রেখেছে। তাদের ব্যবসা সেখানে সাড়ে তিন গুণ থেকে ১৫ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আপনারা এটার সমালোচনা করছেন, হইচই করছেন। অথচ যখন রোহিঙ্গাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হলো, তখন আপনারা কিছুই করেননি। উল্টো আপনারা মিয়ানমারে আপনাদের ব্যবসা চালিয়ে গেছেন। আপনারা যারা এখন বড় বড় কথা বলছেন বা বেশি সোচ্চার তাদের ব্যবসা তো আগের চেয়ে ১৫ গুণ বেড়েছে।
ড. মোমেন বলেন, আপনারা চাইছেন সু চিকে আবার সরকারে নিয়ে আসার জন্য। আমরা সু চি সরকারের অবস্থান দেখেছি। একটা সময়ে আমরাও সু চির জন্য রাস্তায় মিছিল করেছি। কিন্তু ওই সু চি যখন ক্ষমতায় আসলেন, তখন সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলো, কিন্তু তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি। আপনারা যারা সমালোচনা করছেন তাদেরও টনক নড়েনি।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশকে নিয়ে বিশ্ব পরিমণ্ডলে এক আদর্শ পরিচিতি পায়। গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে দেশব্যাপী নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়, দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসা হয় অনেক দেশের প্রধানদেরও। দেশের স্বাধীনতার এই সুবর্ণজয়ন্তীতেও শ্রীলংকার গণহত্যায় সমর্থন ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পার্টিতে অংশগ্রহণে বাংলাদেশের আদর্শগত যে পরিচিতি, এতে তার বিরুদ্ধ রুপটিই পরিলক্ষিত হয়েছে।
তারা বলেন, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে যেমন আদর্শের কোনো চর্চা নেই, ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক আদর্শের চর্চা করে যাচ্ছে, বাংলাদেশেরও তাই হলো। রাজনৈতিক দলগুলোর মতো বাংলাদেশেরও তেমন আর আদর্শগত গুরুত্ব নেই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯১৬
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ