যুক্তরাষ্ট্রের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও ইরান ২৫ বছর মেয়াদি সহযোগিতা চুক্তিতে সই করতে যাচ্ছে আজ শনিবার(২৭ মার্চ)। এ উপলক্ষে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই আজ তেহরান সফরে যাবেন বলে জানা গেছে। এ তথ্য জানিয়েছেন ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সাঈদ খাতিবজাদে। গতকাল শুক্রবার(২৬ মার্চ) রাতে দেশটির একটি টিভি চ্যানেলকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে এ তথ্য জানান তিনি। তবে বিশ্লেষকরা জানাচ্ছেন, নতুন এই ভূ-রাজনৈতিক সম্ভাবনা যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, তার মিত্র ভারতের জন্যও এটা নিঃসন্দেহে মাথাব্যথার কারণ। খবর এএফপির।
খতিবজাদেহ সরকারি টিভিকে জানান, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই গতকাল শুক্রবার রাতে তেহরানে পৌঁছেছেন। তার এ সফরে রাজনৈতিক, কৌশলগত ও অর্থনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে চুক্তি হবে। মুখপাত্র খতিবজাদেহ আরও বলেছেন, ইরান-চীনের সম্পর্ক গভীর করতে এই চুক্তি খুব কার্যকর হবে।
মুখপাত্র সাঈদ খাতিবজাদে বলেন, ইরান ও চীনের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে যাচ্ছে। ১৯৭১ সালে বেইজিংয়ের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে তেহরান।
খাতিবজাদে আরো জানান, চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ সফরে ইরানের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে বৈঠক করবেন। তবে তার সফরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক থাকবে দু’দেশের মধ্যে আড়াই দশক মেয়াদি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করা যার মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা কৌশলগত অংশীদারিত্বে উন্নীত হবে।
এ সহযোগিতা চুক্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ রোডম্যাপ থাকবে জানিয়ে খাতিবজাদে বলেন, চুক্তির কেন্দ্রীয় চালিকাশক্তি হবে অর্থনৈতিক সহযোগিতা। এছাড়া, এ চুক্তিতে চীনের বেল্ট এন্ড রোড পরিকল্পনায় ইরানের অংশগ্রহণের কথা বলা হয়েছে এবং দু’দেশের বেসরকারি খাতের মধ্যে ব্যাপকভিত্তিক সহযোগিতা গড়ে তুলতে তেহরান ও বেইজিং সম্মত হয়েছে।
চীনের সাথে ইরানের ২৫ বছর মেয়াদি চুক্তির খসড়া সম্প্রতি ইরানের মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে এবং চুক্তি স্বাক্ষরের বাকি পর্যায়গুলো সম্পাদনের দায়িত্ব ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দেয়া হয়েছে। গত বেশ কিছু দিন ধরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে চীনের সাথে ইরানের স্বাক্ষরিত হতে যাওয়া এই চুক্তি নিয়ে বেশ জল্পনা চলছে এবং পশ্চিমা দেশগুলো উৎকণ্ঠার সাথে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে।
বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশিত নানা তথ্যের ভিত্তিতে যা জানা গেছে, তাতে ইরানের তেল-গ্যাস, ব্যাংকিং, টেলিকম, বন্দর উন্নয়ন, রেলওয়ে উন্নয়ন এবং আরো কয়েক ডজন খানেক গুরুত্বপূর্ণ খাতে চীন ব্যাপক বিনিয়োগ করবে।
এই বিনিয়োগের পরিমাণ আগামী ২৫ বছরে কমপক্ষে ৪৪ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ হতে পারে।
সেই সাথে প্রস্তাবিত চুক্তিতে সামরিক ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ‘যৌথ প্রশিক্ষণ, মহড়া, গবেষণা, যুদ্ধাস্ত্র তৈরি এবং গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের‘ কথা রয়েছে।
মিডল-ইস্ট আই নিউজ ওয়েবসাইটে একটি রিপোর্টে লেখা হয়েছে, চুক্তির আওতায় চীন তাদের বিনিয়োগের সুরক্ষায় ইরানে পাঁচ হাজার পর্যন্ত সৈন্য মোতায়েন করতে পারবে।
সুতরাং এই চুক্তি সই হলে, মধ্যপ্রাচ্যে এই প্রথম সরাসরি চীনা সামরিক উপস্থিতির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
বিনিয়োগের বদলে জ্বালানি কেনার ক্ষেত্রে চীনকে অনেক ছাড় দেবে ইরান। বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক কম মূল্যে তেল-গ্যাস পাবে চীন এবং চীনা মুদ্রায় দেয়া সেই দাম পরিশোধ করতে পারবে।
পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরযোগ্য ডজন-খানেক মিডিয়ায় বিভিন্ন নিবন্ধে বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন ও ইরানের এই চুক্তি মধ্যপ্রাচ্য তথা এশিয়ার বিরাট একটি অংশের ভূ-রাজনৈতিক চালচিত্র বদলে দেবে।
তারা বলছেন, ইরানের সাথে চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে চীনের অবস্থান সংহত করবে। সেই সাথে ইরানের অর্থনীতির প্রভূত উন্নতি হবে। ফলে তাদের রাজনীতিও স্থিতিশীল হবে।
তাদের অনেকে মনে করেন, ইরানের সাথে সংঘাতের ব্যাপারে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের মধ্যে আগ্রহ কমবে। এমনকি উপসাগরের অনেক দেশে চীনের সাথে এই ধরণের বিশেষ চুক্তিতে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে।
তারা বলছেন, ইরান যদি চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয় তাহলে ঐ অঞ্চলের ভূ-রাজনীতির কৌশলগত সমীকরণ বদলে যাবে।
তারা বলেন, খুব ধীরে হলেও নিশ্চিতভাবে চীন-ইরান এবং পাকিস্তানের মধ্যে একটি কৌশলগত জোট দানা বাঁধছে, যার সাথে অদূর ভবিষ্যতে যুক্ত হবে আফগানিস্তান, ইরাক এবং সিরিয়া।
তাদের মতে, নতুন এই ভূ-রাজনৈতিক সম্ভাবনা যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, তার মিত্র ভারতের জন্যও এটা নিঃসন্দেহে মাথাব্যথার কারণ।
চলতি বছর একই সঙ্গে দুই ফ্রন্টে লড়াই শুরু করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। একদিকে চীন, আর অন্যদিকে ছিল ইরান। বাণিজ্যযুদ্ধের নামে যেমন চীনকে একঘরে করতে চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, তেমনি কাশেম সোলাইমানিকে হত্যার মধ্য দিয়ে ইরানকেও কোণঠাসা করার প্রকল্প ছিল ট্রাম্পের। এখন সেই চীন ও ইরানে হাত মেলাচ্ছে। আর তাতে যুক্তরাষ্ট্রের কপালে ভাঁজ বাড়ছে!
বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন ও ইরানের মধ্যে এমন চুক্তি হলে সেটি পুরো বৈশ্বিক রাজনীতিতে নতুন মাত্রা এনে দেবে। শুরু হবে এক নতুন বিশ্বব্যবস্থার যাত্রা। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র এত দিন মনে করত, সৌদি আরব বা সংযুক্ত আরব আমিরাতকে হাতে রাখার মাধ্যমে আরব বিশ্বে ছড়ি ঘোরানো সহজ হবে। এ ক্ষেত্রে সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাবও ছিল। কিন্তু চীন-ইরান দোস্তি হলে মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন বিশ্বশক্তির পা পড়বে। এতে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য খাতের পাশাপাশি সামরিক বিষয়েও চীনের প্রভাব বাড়বে। ইরানের বন্দরগুলোতে যদি চীনা প্রভাব বৃদ্ধি পায়, তবে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হবে।
চীনের সঙ্গে ইরানের এই চুক্তির মূল আলোচনা অবশ্য শুরু হয়েছিল সেই ২০১৬ সালে। তখন থেকেই ইরানকে বাগে আনার চেষ্টা চালাচ্ছিল চীন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত চাপের মুখেই এখন চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে ইরান। মূলত নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখার জন্যই এই পথ বেছে নিয়েছে হাসান রুহানির দেশ।
তারা বলেন, যদি এক হয়েই যায়, তবে তা যে বাইডেন প্রশাসনের নীতিকে নখদন্তহীন প্রমাণ করে ছাড়বে, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৪৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ