দেশের মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের খবরে শিউরে উঠছে সারা দেশ। যদিও মাদ্রাসাগুলোতে ক্রমবর্ধমান এই ধর্ষণ ও বলাৎকার নিয়ে মাথাব্যথা নেই সরকারের। দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো সরব নয়। নেই বার্ষিক কোন প্রতিবেদন। তাই এই সব নির্যাতনের প্রকৃত চিত্র থেকে যাচ্ছে অজানা। সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে সরকার ২০১১ সালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি নিষিদ্ধ করলেও দেশের মাদ্রাসা নিয়ে বহুদিন ধরে নির্যাতনের খবর প্রকাশ হয়ে আসছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের পর শিক্ষার্থীরা লজ্জা, ভয়, নানান কিছুর কারণে তা প্রকাশ করে না।
সম্প্রতি সাত বছরের এক শিশু হাটহাজারীর মারকাযুল ইসলামি অ্যাকাডেমি নামের একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ওই নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে পুলিশ প্রশাসন সেখানে ছুটে যায়৷
যদিও প্রথমে শিশুটির বাবা-মা শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করতে রাজি না হওয়ায় শিক্ষক মোহাম্মদ ইয়াহিয়াকে ছেড়ে দেন তারা৷ পরে অবশ্য তাকে গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার মুখে৷
হাটহাজারী থানার ওসি জানিয়েছেন, শিশুটির বাবাকে বুঝিয়ে মামলায় রাজি করানো হয়৷ আর ওই মামলায়ই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ শিক্ষক ইয়াহিয়াকে বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে হাজির করার পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে৷
এদিকে ওই ঘটনায় হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে বৃহস্পতিবার একটি রুল দিয়েছেন৷ শিশু নির্যাতনের ঘটনায় কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা স্থানীয় প্রশাসনকে ১৪ মার্চের মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে৷
এ ঘটনার পরই নড়েচড়ে বসেছে দেশের গণমাধ্যমগুলো।
পরিসংখ্যান কী বলছে
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী গত বছর (২০২০) সারাদেশে এক হাজার ৭৪১টি শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে৷ এরমধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের হাতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১২৫টি শিশু৷
এইসব ঘটনায় মোট মামলা হয়েছে আটটি৷ এই সময়ে শিক্ষকদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ১৪ জন শিক্ষার্থী৷ ছেলে শিশুরাও যৌন হয়রানীর শিকার হয়েছে৷
গত বছরের নভেম্বর মাসে দেশের কওমি মাদ্রাসায় ৪০ ছেলে শিশু বলাৎকারের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। গত বছরের ৯ ডিসেম্বর এ তথ্য জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামে একটি সংগঠন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসা সংবাদ বিশ্লেষণ করে এই পরিসংখ্যান পেয়েছে বলে জানিয়েছে সংগঠনটি। তারা বলছে, এসব ঘটনায় কেবল মামলা হয়েছে, চেপে যাওয়া ঘটনা আরও বেশি।
বাংলাদেশে প্রতি চারজন মেয়ে শিশুর মধ্যে একজন যৌন নিপীড়নের শিকার হয়৷ আর প্রতি ছয়জন ছেলে শিশুর মধ্যে যৌন নিপীড়নের শিকার হয় একজন৷
গত ২৫ জানুয়ারি অধিকারের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালে মোট ১ হাজার ৫৩৮ জন নারী ও মেয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৫৭৭ জন নারী, ৯১৯ জন মেয়েশিশু এবং ৪২ জনের বয়স জানা যায়নি। গত বছর ২৮১ জন নারী ও মেয়েশিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে দৈনিক পত্রিকার বরাত দিয়ে জানানো হয়।
নির্যাতনের কিছু ভয়াবহ চিত্র
২০২১
ফেব্রুয়ারি মাসে কুমিল্লার চান্দিনায় মাদরাসাতুল আবরার নামে একটি কওমি মাদরাসা থেকে এক ছাত্রের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। বুধবার (১০ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে ১১টায় চান্দিনা উপজেলার বাড়েরা ইউনিয়নের নরসিংহপুর এলাকার ওই কওমি মাদরাসা থেকে ছাত্রদের বেডিং এর স্তূপের নিচ থেকে রায়হান হোসেন (১০) নামে ওই ছাত্রের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
নিহতের পিতা মিজানুর রহমান জানান, বুধবার বেলা ১১টায় মাদ্রাসা থেকে বাড়িতে এসে খাবার খেয়ে দুপুর ১টায় মাদ্রাসায় চলে যায়। সন্ধ্যায় মাদ্রাসা থেকে ফোন করে জানায়, আমার ছেলে মাদ্রাসায় যায়নি। পরবর্তীতে আমরা বিভিন্ন স্থানে মাইকিং করাসহ আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে খোঁজাখুঁজি শুরু করি। রাত সাড়ে ১০টার পর মাদ্রাসার এক শিক্ষক আমার বড়ভাই মোস্তফা মিয়ার ফোনে কল করে আমাদের মাদ্রাসায় যাওয়ার জন্য বলেন। আমরা মাদ্রাসায় যাওয়ার পর ছাত্রদের বেডিংয়ের স্তূপের নিচে আমার ছেলের মরদেহ দেখান।
জানুয়ারিতে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার একটি মাদ্রাসা থেকে নিখোঁজের এক দিনের মাথায় স্বাধীন নামের আট বছর বয়সী এক শিশুর লাশ পাওয়া যায়। রোববার সকাল ১০টার দিকে উপজেলার বেলতলি হাফেজিয়া মাদ্রাসাসংলগ্ন গাংনাই নদী থেকে শিশুটির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
পুলিশ জানায়, শিশুটি বেলতলি হাফেজিয়া মাদ্রাসার আবাসিক শিক্ষার্থী ছিল। শনিবার দুই শিক্ষকের মধ্যে একজন মাদ্রাসায় অবস্থান করছিলেন। ওই শিক্ষক জানান, শনিবার সন্ধ্যায় শিশুটি টয়লেটে যাওয়ার কথা বলে পড়ার কক্ষ থেকে বের হয়। পরে আর ফিরে আসেনি। তবে রাতে তার পরিবারকে নিখোঁজের বিষয়টি জানানো হয়নি। এরপর সকালে তার লাশ পাওয়া যায়।
২০২০
ডিসেম্বরে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় এক মাদ্রাসাছাত্রকে (১২) বলাৎকারের অভিযোগে বেলাল হোসেন (২৮) নামে এক মাদ্রাসা শিক্ষককে আটক করে গণপিটুনির পর পুলিশের হাতে তুলে দেয় এলাকাবাসী।
নির্যাতিত ছাত্রের বাবা বলেন, পুকুরপাড় ফয়জুল উলুম মহিউচ্ছুন্নাহ কওমি মাদ্রাসার আবাসিক ছাত্র তার ছেলে। শিক্ষক বেলাল হোসেন তার ছেলেকে নিজের রুমে ডেকে প্রায়ই হাত পা ম্যাসেজ করাতেন। বৃহস্পতিবার (৩ ডিসেম্বর) রাতে ছেলেটিকে তার রুমে ডেকে নিয়ে বলাৎকার করেন। ভোরে ছেলেটি মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে বাড়ি এসে তার বাবা-মাকে বিষয়টি জানায়।
নভেম্বরে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে শিক্ষার্থীদের বলাৎকারের অভিযোগে ওঠে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে। পুলিশ জানিয়েছে, মাদ্রাসার ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাতেন শিক্ষক।
স্থানীয়রা জানায়, গত ১৫ নভেম্বর সকালে প্রধান শিক্ষক মানিক মাদ্রাসার পাঠদান কক্ষের ব্ল্যাকবোর্ডের পেছনে নিয়ে ৯ বছরের এক ছাত্রকে বলাৎকার করেন। এরপর আরো কয়েকদফা পাঠদান কক্ষেই ওই ছাত্রকে বলাৎকার করে তিনি। এ ঘটনার পর থেকে ওই ছাত্র মাদ্রাসায় আসা-যাওয়া বন্ধ করে দেয়। গত ২৫ নভেম্বর ওই ছাত্রকে তার বাবা বাড়ি থেকে ফের মাদ্রাসায় দিয়ে আসলেও সে বাড়ি ফিরে যায়। তার বাবা বাড়ি ফেরার কারণ জানতে চাইলে সে বলাৎকারের ঘটনা পরিবারকে জানায়।
অক্টোবরে জয়পুরহাটে চার শিশু শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে করা মামলায় আবদুর রশিদ (৪৫) নামের এক মাদ্রাসাশিক্ষককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। রোববার রাতে জয়পুরহাট সদর উপজেলার মুজাহিদপুর এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে নির্যাতনের শিকার এক শিশুর অভিভাবক থানায় মামলা করেন। সেখানে বলা হয়েছ, আর পাঁচটা দিনের মতোই রবিবার মাদ্রাসায় যায় ওই চার খুদে পড়ুয়ারা। সেখানে ছুটির পর তাদের একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে যৌন নিপীড়ন চালায় শিক্ষক আবদুর রশিদ। ভয় পেয়ে শিশুরা চিৎকার করলে স্থানীয়রা এগিয়ে গেলে পালিয়ে যায় অভিযুক্ত।
মার্চে ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় ময়মনসিংহের ভালুকার জামিরদিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী তাওহিদুল ইসলাম (১০)। তাওহিদুলের পড়া মুখস্থ না হওয়ার অপরাধে ওই মাদ্রাসার শিক্ষক আমিনুল ইসলাম ওই বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি লাঠি দিয়ে পিটিয়ে পাঁজরের একটি হাড় ও একটি পা ভেঙে দেন। তাওহিদুল গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তার পরিবার উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি করে। পরে সেখানেই তার মৃত্যু হয়।
ফেব্রুয়ারীতে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার শাইলগুন মাত্রাই গ্রামে এক হাফেজিয়া মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্র তার নিজ শিক্ষক দ্বারা বলাৎকারের শিকার হয়।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বলে, গত রমজান মাস থেকে হুজুর আমাকে বিভিন্ন কৌশলে বলাৎকার করে আসছে। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে সম্প্রতি আমার মামাকে বিষয়টি জানায়। তিনি আমার বাবাকে ঘটনাটি খুলে বললেই হৈচৈ পড়ে যায়।
২০১৯
এপ্রিলে ফেণীর সোনাগাজীর এক মাদ্রাসাছাত্রীকে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ কর্তৃক যৌন হয়রানি এবং তার জের ধরে পরবর্তীতে তাকে গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে মারার ঘটনা ঘটে।
২৭ জুলাই নারায়ণগঞ্জে একাধিক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি ও শ্লীলতাহানির অভিযোগে এক মাদ্রাসা অধ্যক্ষকে আটক করে র্যাব-১১। এসময় তার মোবাইল থেকে একাধিক রেকর্ডিং জব্দ করে র্যাব। ফতুল্লা ভুঁইগড় এলাকার দারুল হুদা মহিলা মাদ্রাসা থেকে তাকে আটক করা হয়। গ্রেফতারকৃত অধ্যক্ষের নাম মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে জসিম (২৯)। তিনি নেত্রকোণা লক্ষ্মীগঞ্জ কাওয়ালীকোণা গ্রামের বাসিন্দা ও দারুল হুদা মহিলা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ।
৪ জুলাই ফতুল্লার মাহমুদপুর এলাকায় ১২ ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে বাইতুল হুদা ক্যাডেট মাদ্রাসা অধ্যক্ষ মাওলানা মো. আল আমিনকে আটক করে র্যাব। এরআগে ২৭ জুন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে অক্সফোর্ড নামে একটি বেসরকারি স্কুলের ২০ জনেরও অধিক ছাত্রীকে ৪ বছর ধরে যৌন হয়রানিসহ ধর্ষণের অভিযোগে সহকারী শিক্ষক আরিফুল ইসলাম সরকার ওরফে আশরাফুল ও প্রধান শিক্ষক জুলফিকার ওরফে রফিকুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়।
৮ আগস্ট সকাল সাতটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রতিদিনের মতো পঞ্চম শ্রেণির চার ছাত্রী মাদ্রাসায় সুপারের কাছে আরবি পড়তে যায়। পৌনে আটটার দিকে মাদ্রাসার সুপার ইলিয়াছ জোমাদ্দার এক ছাত্রীকে রেখে অন্য তিনজনকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। পরে ওই ছাত্রীকে মাদ্রাসার লাইব্রেরিতে নিয়ে জোরপূর্বক ধর্ষণ করেন ইলিয়াছ। এ ঘটনা কাউকে না জানাতে হত্যার হুমকি দিয়ে শিশুটিকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন ওই মাদ্রাসা সুপার।
১২ অক্টোবর, শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে আমির হোসেন (৮) নামের এক মাদ্রাসা ছাত্রের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ ও স্থানীয়দের সূত্রে জানা গেছে, বুধবার সকালে অহেজান বেগম ছেলে আমিরকে মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দিয়ে গারো পাহাড়ে বালু তোলার কাজে যান। বিকেলে পাহাড় থেকে বাড়ি ফিরে তিনি ছেলেকে ঘরের চৌকির ওপর ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পান। এ সময় অনেক ডাকাডাকির পরও আমির সাড়া না দেওয়ায় তিনি ডাক-চিৎকার শুরু করেন। পরে প্রতিবেশীরা আমিরকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ঝিনাইগাতী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসা কর্মকর্তা সুলতানা পারভীন মৃত ঘোষণা করেন।
আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ
বাংলাদেশের আইনে ছাত্রদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেয়া দণ্ডনীয় অপরাধ৷ ২০১১ সালে হাইকোর্টের এক আদেশের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি বন্ধে নীতিমালা প্রণয়ন করে৷
আর তাতে শারীরিক ও মানসিক শাস্তির সংজ্ঞাও দেয়া হয়েছে৷ শারীরিক শাস্তি বলতে যেকোনো ধরনের দৈহিক আঘাত বলা হয়েছে৷ মারধর ছাড়াও আইনে কান ধরা, চুল টানা, বেঞ্চের নিচে মাথা রাখতে বাধ্য করাও দৈহিক শাস্তি৷ আর মানসিক শাস্তির মধ্যে শিশু বা তার পরিবারকে উদ্দেশ্য করে বাজে মন্তব্য বা যেকেনো আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি৷
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই দুই ধরনের শাস্তি দেয়াকেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলেছে৷ যাদের বিরুদ্ধে এই অপরাধ প্রমাণ হবে তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে৷ একই সঙ্গে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে৷
কিন্তু এরপরও বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেয়ার প্রবণতা বেশ লক্ষ্য করা যায়৷ বিশেষ করে মাদ্রাসায় এটা প্রকট৷
কেন মাদ্রাসাগুলোতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে নির্যাতন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মজিবুর রহমান বলেন, ‘‘এখানে শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার দর্শন অনুযায়ী গড়ে ওঠেনি। নানা ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত। কেউ কেউ মনেই করেন কিছুটা মারপিট সুশিক্ষার জন্য দরকার আছে। আর কওমি মাদ্রাসাগুলো যেহেতু সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই তাই তারা সরকারের নির্দেশও মানতে চায় না।’’
তিনি বলেন, ‘ওস্তাদের মার খেলে ওই জায়গাটা বেহেশতে যায়- এটা যদি হয় চিন্তা তাহলে মারপিট থামবে কীভাবে? হাটহাজারীও মাদ্রাসার শিশুটির বাবা এই ধরনের চিন্তার কারণেই প্রথমে মামলা করতে চাননি। তার মতে, সামাজিক এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই শিশুদের বলাৎকার করেও কেউ কেউ রেহাই পেয়ে যান।
লেখক ও গবেষক আফসান চৌধুরী মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর ওপর নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, আবাসিক মাদ্রাসা থেকেই শিশু শিক্ষার্থীদের শারীরিক নির্যাতন এবং যৌন নিপীড়নের অভিযোগ বেশি আসে। এখানে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার বিষয়কে তিনি অন্যতম একটি কারণ হিসেবে দেখেন।
“পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন কেউ যদি থাকে, সেখানে বাচ্চারা অনেক বেশি অনিরাপদ থাকে, বিশেষ করে সেখানে যদি বয়স্ক লোক থাকে। সামগ্রিকভাবে বাচ্চাদের অনিরাপদ পরিবেশটাই সমস্যা। এছাড়া বাচ্চারা এ ধরণের ঘটনা ঘটলে তা বলতে বা অন্য কাউকে জানাতে ভয় পায় এবং অনেক সময় তারা বিষয়টা বুঝতেও পারে না। এটাও একটা বড় কারণ।”
শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের প্রধান আবদুস শহীদ এএফপিকে বলেন, ‘‘বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় বছরের পর বছর ধরে তা প্রকাশ্যে আসেনি৷ ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা শিশু সন্তানদের মাদ্রাসায় পাঠান, কিন্তু তারা এই অপরাধগুলো নিয়ে কথা বলেন না এটা ভেবে যে এতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষতি হবে৷’’
মানবাধিকার কর্মীরা বলেছেন, আলিয়া মাদ্রাসা ছাড়া অন্য মাদ্রাসাগুলোতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ বা তদারকি সেভাবে নেই। সেজন্য যৌন নির্যাতন বা শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের সুযোগ থাকে। এছাড়া সেখানে পরিবেশ এমন যে, শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ অনেক সময় প্রকাশও হয় না।
মানবাধিকার কর্মীদের অনেকে আবার মনে করেন, মাদ্রাসাগুলোর নিজস্ব বোর্ড বা কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু সেখানেও ঘাটতি আছে।
মানবাধিকার কর্মী এলিনা খান বলেছেন, কওমি, এবতেদায়ী বা নূরানী-বিভিন্ন ধরনের মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য বেসরকারি উদ্যোগে কর্তৃপক্ষ যারা রয়েছে, তাদের তদারকি বাড়ানো উচিত বলে তিনি মনে করেন।
কী বলছেন মাদ্রাসার বোর্ডের কর্মকর্তারা
মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যাপারে মাদ্রাসা শিক্ষক এবং ইসলামী চিন্তাবিদদের নিয়ে একটি পরিচালনা কমিটি রয়েছে, সেই কমিটির একজন সদস্য মোঃ ফয়জুল্লাহ বলেছেন, সম্প্রতি মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে যে সব অভিযোগ উঠছে, এই পরিস্থিতি নিয়ে তারা গুরুত্বের সাথেই আলোচনা করছেন।
“বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার কথা আমরা শুনতে পাই। তারপরও এগুলোর সমাধান কীভাবে করা যায়, সেজন্য আমাদের উদ্যোগ, চিন্তা এবং পরিকল্পনা আছে।”
মাদ্রাসার বোর্ডের কর্মকর্তারা বা শিক্ষকদের অনেকে কোন ঘটনায় ব্যবস্থা না নেয়ার অভিযোগ মানতে রাজি নন।
দেশে কওমি মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য বেসরকারি উদ্যোগে ছয়টি শিক্ষা বোর্ড রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় শিক্ষাবোর্ড বেফাকের মহাপরিচালক জুবায়ের চৌধুরী বলেছেন, এখন বিচ্ছিন্ন কিছু অভিযোগ এলেও তারা চিন্তিত এবং করণীয় ঠিক করতে আলোচনা চালাচ্ছেন।
“সাদা কাপড়ে দাগ লাগলে, এটা ছোট হলেও খুব স্পষ্ট দেখা যায়। তো যদিও বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার কথা আসছে, কিন্তু এটা নিয়ে আমরা অত্যন্ত চিন্তিত। আমাদের বোর্ডের মুরুব্বী যারা আছেন, তাদের সাথে করণীয় নিয়ে আলোচনা করছি।”
তিনি আরও বলেছেন, তারা কিছু পদক্ষেপও নিচ্ছেন। আমরা মাদ্রাসাগুলোকে ম্যাসেজ দিচ্ছে যেনো তারা সতর্ক থাকে। আমরা তাদের সংশোধন এবং সতর্কীকরণের মাধ্যমে এর সুরাহা করতে চাই।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬১৩
আপনার মতামত জানানঃ