নাম, পিতার নাম, এলাকার নাম ইত্যাদি নামের সাথে কিঞ্চিৎ মিল থাকার কারণে কর্তৃপক্ষের ভুলে দেশে প্রায়ই নিরপরাধীর সাজা হয়ে থাকে। যেন তদন্ত করে আসল আসামি ধরায় তাদের কোনো আপত্তি আছে, এমনি দায়সারাভাবে আসামি ধরতে গিয়ে ধরে আনেন অন্যকোনো নিরীহ। সম্প্রতি এমনি আরেক ঘটনা ঘটেছে। পিতার নামের সাথে মিল থাকায় ‘বিনা অপরাধে’ চার মাস কারাভোগ করেন যশোরের মিন্টু মোল্যা নামে এক দিনমজুর। চার মাস কারাভোগের পর অবশেষে তিনি মুক্তি পেয়েছেন। একটি ঋণ খেলাপি মামলায় আশরাফ আলীর জায়গায় পুলিশ মিন্টুকে আটক করে জেলহাজতে পাঠায়।
মিন্টু মোল্যা বেনাপোলের দিঘিরপাড় এলাকার মৃত মোহর আলী মোল্যার ছেলে। আর সাজাপ্রাপ্ত আশরাফ আলী বেনাপোলের দিঘিরপাড়া এলাকার মৃত মোহর আলীর ছেলে।
পিতার নামের মিল থাকায় আশরাফ আলীর পরিবর্তে মিন্টুকে গত বছর ১৬ নভেম্বর আটক করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। মিন্টুর অভিযোগের ভিত্তিতে চার মাস পর বিষয়টি আদালতের নজরে আসায় অবশেষে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তিনি মুক্তি পান। ভুক্তভোগী মিন্টু মোল্যা পেশায় দিনমজুর।
ভুক্তভোগী মিন্টু মোল্লা জানান, তিনি পেশায় ভ্যানচালক ছিলেন। আবার কখনো দিনমজুরের কাজও করেন। গত বছরের ১৬ নভেম্বর রাত ১০টার দিকে তার বাড়িতে হাজির হন বেনাপোল পোর্ট থানার এসআই মাসুম ও একই এলাকার চৌকিদার কালা কবির। দিঘিরপাড়া এলাকার মৃত মোহর আলীর ছেলে আশরাফ আলীর নামে এক ব্যক্তির নামে আদালতের দেয়া এক বছরের সাজাপ্রাপ্ত একটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কপি হাতে মিন্টুকে আটকের চেষ্টা করেন তারা। এসময় তিনি আশরাফ আলম নয় জানান। কিন্তু কোন কথাই শুনতে রাজি হননি সেই দারোগা ও চৌকিদার। রাতেই তাকে আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
পরদিন সকালে পরিবারের লোকজন জন্ম নিবন্ধন সনদের কপি নিয়ে থানায় গেলেও তাকে পুলিশের হাত থেকে ছাড়াতে পারেনি। ফলে তাকে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠায় পুলিশ। কিন্তু জেলখানার মধ্যে দরবার ফাইলে অভিযোগ করেন মিন্টু। কোন কাজেই আসেনি তার নালিশ।
গত শনিবার যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শনে যান লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা। তাকে বিষয়টি জানালে তিনি আদালতকে অবহিত করেন। পরে লিগ্যাল এইডের সহযোগিতায় বৃহস্পতিবার কাগজপত্র যাচাই বাছাই করে জানতে পারেন আশরাফ আলী অন্য এক ব্যক্তি। ফলে এদিনই যশোরের যুগ্ম দায়রা জজ ও স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-৬ এর বিচারক মিন্টুকে খালাস দেন।
মিন্টুর স্ত্রী ফাহিমা বেগম বলেন, তার স্বামীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা নাই। দুটি ছেলে নিয়ে কোনোমতে দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালান তার স্বামী মিন্টু। ঘটনার দিন গত বছরের ১৬ নবেম্বর রাতে এলাকার চৌকিদার কালা কবির ও থানার এসআই মাসুম বিনা দোষে তার স্বামীকে আটকের পর জেলখানায় পাঠায়। প্রায় চার মাস তার স্বামী জেলখানায় থাকায় অর্ধহারে অনাহারে তাদের দিন পার হয়েছে।
ব্লাস্ট যশোরের কোঅর্ডিনেটর মোস্তফা হুমায়ুন কবীর বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, আটক মিন্টু সাজাপ্রাপ্ত আশরাফ আলী নন, সেটি নিশ্চিত হওয়ার পর আদালত তাকে মুক্তি দিয়েছে।
কয়েকদিন আগেও মাদক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত প্রকৃত আসামি ‘মানিক মিয়া’-এর পরিবর্তে মাছ ব্যবসায়ী ‘মানিক হাওলাদার’-কে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। শুধু নামের সঙ্গে মিল থাকায় মো. মানিকের মিয়ার স্থলে জেল খাটছেন শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জের মানিক হাওলাদার।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, সিরাজগঞ্জের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ এর একটি মাদক মামলার চার বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি মো. মানিক মিয়া, বাবা নজরুল হাওলাদার, গ্রাম ব্যাপারী কান্দির নামে একটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর সখিপুর থানায় আসে। আর সখিপুর থানার পুলিশ গত বছর ২৮ নভেম্বর ওই থানার আলম চাঁন ব্যাপারী কান্দি গ্রামের মৃত নজরুল ইসলামের ছেলে মানিক হাওলাদারকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। তিনি বর্তমানে সিরাজগঞ্জ জেলা কারাগারে রয়েছেন। আর দণ্ডপ্রাপ্ত মো. মানিক মিয়া এখনো পলাতক রয়েছেন।
তারও কয়েকদিন আগে নারায়ণগঞ্জে নামের বিভ্রান্তিতে জামাল হোসেন নামের আসামির বদলে কামাল হোসেনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগে জানা যায়, গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় লেখা জামাল হোসেন। এতে ওভাররাইটিং করে কামাল হোসেন লেখা হয়। এরপর নারায়ণগঞ্জ সদর থানা পুলিশের একটি টিম সৈয়দপুর পশ্চিম এলাকার মৃত সুরুজ মিয়ার ছেলে ও সৈয়দপুর বঙ্গবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সদস্য কামাল হোসেনকে গ্রেপ্তার করে। গত বুধবার (৩ মার্চ) সংবাদ সম্মেলনে এমন অভিযোগ করে ভুক্তভোগী। তিনি বলেন, গাঁজা উদ্ধারের যে ঘটনায় আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সে ঘটনার সময়ে আমি দক্ষিণ কোরিয়া ছিলাম।
এতো গেলো চলতি মাসে ঘটা কয়েকটি ঘটনা। এর বাইরেও যে চলতি মাসে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি, তাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। প্রায় নিয়মিতই অপরাধ না করেও পুলিশ কিংবা কর্তৃপক্ষের ভুলে নিরীহ কেউ সাজাভোগ করে যাচ্ছেন। জাহালম, আরমান বিহারী এমন উদাহরণ আরও রয়েছে। এদেশে এই সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশে নিরপরাধীর সাজাভোগের উদাহরণ খুঁজে দেখলে দেখা যাবে প্রকৃত আসামির সংখ্যার চেয়ে অতো একটা কম নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনের ভাষায় একটা কথা বিশ্বব্যাপী প্রচলিত আছে, প্রয়োজনে দশজন অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাক তবুও যেন একজন নিরপরাধীর সাজা না হয়। বিশ্বের সমস্ত বিচার ব্যবস্থায় এই কথাটি মোটা অক্ষরে স্মরণে রাখা হয়। নিরপরাধীর সাজা যেন না হয় সেজন্য সজাগ দৃষ্টি রাখা হয়। তারিখের পর তারিখ, বিভিন্ন সাক্ষ্য প্রমাণ যাচাই বাছাই শেষে আদালত এইজন্যই বিচারের রায় প্রদান করে থাকেন যাতে ফাঁক-ফোঁকরে কোনো নিরপরাধীর সাজা না হয়ে যায়। বাংলাদেশেও এই রীতি রয়েছে। তবুও কোথায় কার যেন ভুলে কীভাবে যেন নিরপরাধীর সাজা হয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা জানান, একটা মানুষের খুন হওয়ার ঘটনা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, দ্রুততম সময়ে আসামির ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাও তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। বছরের পর বছর কারাভোগের পর কেউ খালাস পেলেও তাকে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এবিষয়ে উচ্চ মহলের কড়া নজরদারির আহ্বান জানান তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০০
আপনার মতামত জানানঃ