এ.এস. শরীফ : আজকাল ‘ওয়াজ’ নামে যে তথাকথিত ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বাড়বাড়ন্ত দেখা যায় তার উৎপত্তি ঠিক কীভাবে বলা একটু কঠিন। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে এর প্রসার বেড়েছে। সাধারণত ‘ওয়াজ’ এমন একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে বোঝায় যার মাধ্যমে ইসলাম প্রচার করা হয়।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এই ধর্মীয় সম্মেলন এখন এক শ্রেণির ধর্ম ব্যবসায়ীদের মূল পেশা। এর মাধ্যমে তারা সাম্প্রদায়িকতা এবং জঙ্গিবাদের প্রচার করছে প্রকাশ্যেই।
সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের বার্তা ছড়ানো হচ্ছে এর মাধ্যমে। সংখ্যাগুরু মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে সন্ত্রাসবাদী চেতনা ও কর্মকাণ্ডে। ওয়াজের বক্তাদের পুরো বক্তব্যজুড়েই থাকে নারীবিদ্বেষ, প্রগতিশীলতা এবং সুস্থ ধারার বিনোদনের বিরোধিতা। ওয়াজের এসব বক্তা জাতীয় পতাকা এবং সঙ্গীতের প্রতি বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচার করে হরহামেশাই। এই ওয়াজ থেকেই প্রকাশ্যে দেয়া হয় জিহাদের মতো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ডাক। কিশোর ও উঠতি তরুণদের মধ্যে যার প্রভাব পড়ে মারাত্মকভাবে।
ওয়াজের এসব বক্তা জাতীয় পতাকা এবং সঙ্গীতের প্রতি বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচার করে হরহামেশাই। এই ওয়াজ থেকেই প্রকাশ্যে দেয়া হয় জিহাদের মতো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ডাক। কিশোর ও উঠতি তরুণদের মধ্যে যার প্রভাব পড়ে মারাত্মকভাবে।
রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এই বিষবাষ্প। ক্রমেই ধারণ করছে ভয়াবহ রূপ। এই ওয়াজের আয়োজনে তোলা হয় কোটি কোটি টাকা। দিনের পর দিন ধরে বিকট শব্দে বাজতে থাকে মাইক।
ওয়াজের জন্য টাকা তোলার কাজটি করে থাকে কওমি মাদ্রাসা, আলিয়া মাদ্রাসা, স্থানীয় মসজিদ কমিটি, বিভিন্ন তরুণ সংঘ, ধর্মব্যবসায়ীদের সংগঠন। আর চরমোনাই পীরের (দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ওয়াজকারীদের একজন) বার্ষিক মাহফিলের জন্য চাঁদা তোলার কাজটি করে মুজাহিদ কমিটি।
সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে দেয়ার এই মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়নে বড় ভূমিকা রেখেছে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মতো চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী এবং বরিশালের চরমোনাই পীরের মতো ভূমিদস্যুরা। হাল আমলে তাদের উত্তরসূরীর দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে অর্থ কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত মিজানুর রহমান আজহারী এবং সরকারি মদদপুষ্ট হেফাজতে ইসলামের একাধিক নেতাকে।
গত কয়েক দশকে প্রযুক্তিগত আবিষ্কারেরও সুফল নিয়েছে এসব মৌলবাদীরা। সহজলভ্য স্মার্টফোনের সহায়তায় ঘৃণা আর বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে ইন্টারনেটে। প্রযুক্তির এই সহজলভ্যতা নিজ নিজ এলাকার গণ্ডি ছাড়িয়ে এসব বক্তাকে পরিচিতি দিয়েছে বড় পরিসরে। এখন তারা ইউটিউব, ফেসবুকে ভিডিও আপলোড করেই বিষোদগার করে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি।
সহজলভ্য স্মার্টফোনের সহায়তায় ঘৃণা আর বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে ইন্টারনেটে। প্রযুক্তির এই সহজলভ্যতা নিজ নিজ এলাকার গণ্ডি ছাড়িয়ে এসব বক্তাকে পরিচিতি দিয়েছে বড় পরিসরে।
সাঈদীর বক্তব্যে শোনা গেছে দেশবিরোধী এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া। চরমোনাই পীর সৈয়দ মো. ফাইজুল করিমের বক্তব্য মানেই আক্রমণাত্মক এবং উস্কানিমূলক বার্তা। হেফাজত তো কথায় কথায় সবকিছু অচল করে দেয়ার হুমকি দেয়। চরমোনাই পীরের ভাষ্য, ‘মুসলিমদের দমিয়ে রাখতে বিশ্বব্যাপী ইহুদি-খ্রিস্টানরা ষড়যন্ত্র করছে।’ তার স্লোগান হলো, ‘আমরা হলাম রাসুল সেনা। ভয় করি না বুলেট-বোমা।’
২০১৬ সালে দেয়া এক বক্তব্যে চরমোনাই পীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সে আখ্যা দিয়েছিল ‘একটি মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবে। তার ভাষ্য অনুযায়ী সেখানে কোনো অমুসলিম ছাত্রের পড়াশোনার সুযোগ নেই। আশ্চর্যের বিষয় হলো প্রকাশ্যে এমন বক্তব্য দেয়ার পরেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এর কোনো প্রতিবাদ জানায়নি। কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষ। ফাইজুল করিমকে প্রায়ই বলতে শোনা যায়, ‘এই দেশে শুধুই মুসলিমদের। এখানে নাস্তিকদের জায়গা নেই।’
মূলতঃ সব ওয়াজকারীই সাম্প্রদায়িকতা এবং জঙ্গিবাদে উসকানি দেয়। সাম্প্রতিক বছরে র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয় নিষিদ্ধ ঘোষিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের দুই সক্রিয় সদস্য। চরমোনাই পীরের বক্তব্যই তাকে এ পথে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছে বলে জানায় তাদের একজন।
সমাজে ওয়াজের এমন বিরূপ প্রভাব থাকা সত্বেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো বিভিন্ন সময় সাংসদ, জেলা প্রশাসক, এসপি, ওসির মতো সরকারি কর্মচারিদের দেখা গেছে ওয়াজের অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকতে। এসবের পৃষ্ঠপোষকতাও করেন তারা। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল হেফাজতের একজন চিহ্নিত অনুসারী। অথচ ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের তাণ্ডবের কথা সবাই জানে।
তবে শেষ পর্যন্ত উপায়ন্তর না দেখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ২০১৯ সালের ১ এপ্রিল ১৬ ওয়াজ বক্তাকে চিহ্নিত করে। যাদের বক্তব্য দাঙ্গার উসকানি, জঙ্গিবাদে মদদ, ব্যক্তিবিশেষকে হেয় করে। এসব বক্তাকে বেঁধে দেয়া হয় ৬টি নির্দেশনা।
তবে সরকারের এ সিদ্ধান্তকে ভালো চোখে দেখেনি ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে ওঠা মৌলবাদী চক্র। কোনোরকম যৌক্তিক ব্যাখ্যা ছাড়াই আল্লামা মামুনুল হক, মুফতি হেদায়েতুল্লাহ আজাদীসহ অনেকেই সরকারের এ সিদ্ধান্তকে ‘ইসলামবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করে এবং তারা তাদের ‘বাকস্বাধীনতার চর্চা’ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেয়।
এই সংঘবদ্ধ চক্র খুব সূচতুরভাবে তরুণ সম্প্রদায়কে ঠেলে দিচ্ছে জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার দিকে। জনগণের নিস্পৃহতা, ধর্মভীতি এবং সরকারের মদদ দিনে দিনে তাদের করে তুলছে আরও শক্তিশালী।
এসডব্লিউ/এএসএস/নসদ/২০২৪
আপনার মতামত জানানঃ