কয়েক বছর ধরে ইউরোপে একাধিক আইএস হামলার পরে বোরকার বিরুদ্ধে সরব হয়েছে বেশ কিছু দেশ। এর আগেই ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, বুলগেরিয়া, বেলজিয়াম ও ল্যাটভিয়া— ইউরোপের এই সাতটি দেশে বোরখা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পাশাপাশি কিছু মুসলিম দেশেও নিষেধাজ্ঞা জারি আছে বিশেষ এই পোশাকটির বিরুদ্ধে। সম্প্রতি সময়ে সুইজারল্যান্ডও সে পথেই হাঁটল। এমন কিছু দেশ সম্পর্কে জানা যাক, যেখানে বোরকা পরা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
সুইজারল্যান্ড
সম্পূর্ণ মুখ ঢাকা পোশাকে জনসমক্ষে বেরোনোর উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি হল সুইজারল্যান্ডে। রবিবার এই বিষয়ে গণভোট দিয়েছিলেন দেশের সাধারণ মানুষ। ফল প্রকাশিত হওয়ার পরে দেখা গিয়েছে, ৫১.২ শতাংশ দেশবাসী ভোট দিয়েছেন এই ধরনের পোশাকের বিরোধিতা করে।
গণভোটের ফল প্রকাশিত হওয়ার পরেই জনসমক্ষে সম্পূর্ণ মুখ ঢাকা পোশাকের উপর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে সরকার। নির্দেশিকায় ‘বোরকা’ বা ‘নিকাব’ শব্দগুলির উল্লেখ না-থাকলেও স্পষ্ট, কোন ধরনের পোশাককে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে।
তবে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এই নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে না। নিরাপত্তার কারণে বা কোনও চিকিৎসার প্রয়োজনেও সম্পূর্ণ মুখ ঢাকা পোশাকে বাইরে বেরোনো যাবে বলে নির্দেশিকায় জানানো হয়েছে। প্রসঙ্গত, করোনার প্রকোপ রুখতে এ দেশে এখনও মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক।
উল্লেখ্য, ২০০৯-এ এক গণভোটে মসজিদের উপরে গম্বুজ বানানোর উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল সুইৎজ়ারল্যান্ডে। তখন অনেকেই সেই আইনের সমালোচনা করেছিলেন। এ বারও নতুন আইনের বিরোধিতায় সরব হয়েছেন দেশের বহু মানুষ ও সংগঠন। বার্নে পার্লামেন্টের সামনে রবিবার বিক্ষোভ দেখান শ’দেড়েক মানুষ। ইসলামিক সেন্টার কাউন্সিলের কথায়, মুসলিম-বিদ্বেষ এ বার দেশের সংবিধানেও ঠাঁই পেয়ে গেল।
ফ্রান্স
ফ্রান্স ইউরোপের প্রথম দেশ, যেখানে বোরকা আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়৷ ফ্রান্সে ৫০ লাখ মুসলমানের বাস৷ ২০১১ সালের ১১ এপ্রিল এই আইন কার্যকর হয়৷ বোরকা বা নেকাব পড়লে জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে আইনে৷ ফ্রান্সে বোরকা পড়লে ৩২ হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত জরিমানার বিধান আছে আইনে। এর বিরুদ্ধে ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত পর্যন্ত গিয়েছিল ফ্রান্সের মুসলিমরা। কিন্তু তাদের চেষ্টা সফল হয়নি।
ফ্রান্সে কেবল বোরকা নয়, মুখ ঢাকা যে কোন পোশাক, মুখোশ, বালাক্লাভা, হেলমেট বা হুড – যা পরিচয় গোপন রাখতে সহায়তা করে, তা নিষিদ্ধ। পশ্চিম ইউরোপের মধ্যে ফ্রান্সেই সবচেয়ে বেশি মুসলিম বসবাস করে। কিন্তু সেখানে মাত্র দু হাজার মুসলিম মহিলা এই আইন হওয়ার সময় বোরকা পরত।
বেলজিয়াম
২০১১ সালের জুলাইয়ে বেলজিয়ামেও নেকাব নিষিদ্ধ হয়৷ অর্থাৎ কোনো নারী তার পুরো মুখ কাপড়ে ঢেকে রাখতে পারবে না৷ ইউরোপে ফ্রান্সের পর বেলজিয়াম দ্বিতীয় দেশ, যেখানে এ ধরনের আইন কার্যকর হয়েছিল। এ আইন ভঙ্গ করলে ১৯৭ মার্কিন ডলার জরিমানা বা সর্বোচ্চ সাতদিনের কারাদণ্ডের বিধান আছে।
রাশিয়া
দেশটির দক্ষিণ পশ্চিমের স্টাভরোপোল এলাকায় সরকারি স্কুলে হিজাব নিষিদ্ধ। বিতর্কিত এই পদক্ষেপকে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট ২০১৩ সালের জুলাইয়ে সমর্থন দেয়। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার সুপ্রিম কোর্ট রিপাবলিক অব মরডোভিয়ার স্কুলগুলোর ক্ষেত্রেও একই ধরনের নির্দেশে সম্মতি দেয়।
নেদারল্যান্ডস
নেদারল্যান্ডসে ২০১৫ সালে আইন করে বোরকা নিষিদ্ধ করা হয়৷ বিশেষ করে জনসমক্ষে, অর্থাৎ স্কুল, হাসপাতাল ইত্যাদির মতো জায়গায বোরকা ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে৷ অবশ্য শুধু বোরকা নয়, পুরো মুখ ঢাকা হেলমেট বা বালাক্লাভার ক্ষেত্রেও এ নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য৷ আইনটি কার্যকর হয় ২০১৯ সালের ১ আগস্ট৷
কেউ বোরকা পরে এসব স্থানে ঢুকতে চাইলে কর্তৃপক্ষ তাদেরকে মুখ দেখাতে বলতে পারবেন৷ কেউ এতে আপত্তি জানালে তাদের সেসেব স্থানে ঢুকতে দিতে অস্বীকৃতি জানাতে পারবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ৷ নির্দেশ অমান্যে ১৫০ ইউরো (প্রায় ১৫ হাজার টাকা) জরিমানাও করা হতে পারে৷
স্পেন
স্পেনের কিছু কিছু শহরে বোরকা ও নিকাব নিষিদ্ধ। ২০১৩ সালে স্পেনের সুপ্রিম কোর্ট কয়েকটি শহরের ওপর থেকে এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়।
কোর্ট মন্তব্য করেছিল, নিষেধাজ্ঞা ধর্মীয় স্বাধীনতা সীমিত করে দেয়। অন্যদিকে ২০১৪ সালে মানবাধিকার বিষয়ক ইউরোপিয়ান কোর্ট এক আদেশে বলে, নিকাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়।
তুরস্ক
তুরস্ক প্রধানত মুসলিম দেশ। তবুও ২০১৩ সাল পর্যন্ত দেশটির সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্কার্ফ পরা নিষিদ্ধ ছিল। বিচার বিভাগ, প্রতিরক্ষা ও পুলিশ বাহিনী ছাড়া নারীরা এখন সর্বত্র নিকাব পরতে পারে।
ব্রিটেন
ব্রিটেনে প্রচুর মুসলিমের বাস, তাই সেখানে কোনো ইসলামি পোশাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা নেই৷ তবে স্কুলগুলোতে নির্দিষ্ট পোশাক পরতে হয়৷ ২০০৭ সালে বেশ কয়েকটি মামলার পর স্কুল কর্তৃপক্ষ ঠিক করে, স্কুলে কেউ বোরকা বা নেকাব পরতে পারবে না৷
ইতালি
ইতালি ২০১০ সালে নিকাব নিষিদ্ধ করে। তবে সেটা দেশব্যাপী নয়। শুধুমাত্র নোভারা শহরে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তবে সেখানে বর্তমানে কোন জরিমানার বিধান নেই।
ইতালির কিছুকিছু স্থানে বুরকিনি নিষিদ্ধ। বুরকিনি আঁটোসাঁটো বোরকা যা মুসলিম নারীরা সাঁতারের সময় পরিধান করে। এতে শুধু মুখ খোলা ছাড়া সারা শরীর ঢাকা থাকে। সাঁতারের জন্য বেশ হালকা পোশাক বুরকিনি
অস্ট্রিয়া
ইউরোপের দেশ অস্ট্রিয়া ২০১৭ সালে আদালত ও স্কুলে নিকাব পরা নিষিদ্ধ করে। এ বিষয়ে একটি আইন পাশের পর পুলিশ দেশটিতে ২৯টি মামলা দায়ের করে। তবে আইন প্রয়োগে বিড়ম্বনার অভিযোগ এনেছে পুলিশ।
এই ২৯টি মামলার ৪টি করা হয়েছে নিকাব পরার জন্য এবং সেটা একই নারী ক্ষেত্রে। আর বাকিগুলো হয়েছে শীত থেকে বাঁচার জন্য মুখোশ দিয়ে মুখ ঢেকে রাখার জন্য। যারা বরফে স্কি করেন তারা এক ধরনের মাস্ক বা মুখোশ পরে মুখ ঢাকেন। নিকাব নিষিদ্ধের আইনের আওতায় এটাও নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া প্রাণীর মাসকট পরার কারণে কেউ কেউ মামলা খেয়েছেন।
জার্মানি
জার্মানির বাডেন ভুর্টেমব্যার্গ রাজ্যের স্কুলে বোরকা-নিকাব নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ প্রশাসন জানিয়ে দিয়েছে, স্কুলে বোরখা বা নিকাব পরে যাওয়া যাবে না। এমন কিছু পরা যাবে না, যা মুখ ঢেকে রাখে। আগেই শিক্ষিকাদের জন্য এই নিয়ম জারি করেছিল রাজ্যটি।
জরিপে দেখা গেছে, প্রায় তিন-চতুর্থাংশ জার্মানও প্রকাশ্যে বোরকাধারী মহিলাদের দেখতে নারাজ৷
এদিকে, দেশটির গাড়ি চালানো অবস্থায় নিকাব পরলে জরিমানার বিধান রয়েছে। ২০১৭ সালে জার্মানি এই ট্রাফিক আইন প্রণয়ন করে।
শাড
শতকরা ৫৫ ভাগ মুসলিম জনসংখ্যার দেশ শাডে বোরকা ও নিকাব নিষিদ্ধ করা হয় ২০১৫ সালে। সে সময় জুন মাসে দুটি বোমা হামলার দুই দিন পর নারীদের মুখ ঢাকা পোশাক নিষিদ্ধ করে দেশটি।
বোরকা কোথাও বিক্রি করা হচ্ছে দেখলে তা সঙ্গে সঙ্গে পুড়িয়ে ফেলা হবে বলেও ঘোষণা দেন শাডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী৷ কেউ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে রাখা হয়েছে কারাদণ্ডের বিধান৷
প্রধনমন্ত্রী কালজেবু পাহিমি দেবিত বোরকাকে ‘ছদ্মবেশ’ বলে অভিহিত করে বলেন, বিক্রির জন্য যত বোরকা পাওয়া যাবে সব আগুনে পোড়ানো হবে। নারীরা বোরকা পরিধান করলে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হবে।
ক্যামেরুন
শাডে মুখ ঢাকা পোশাক নিষিদ্ধ হওয়ার এক মাসের মাথায় আফ্রিকার দেশ ক্যামেরুনও একই সিদ্ধান্ত নেয়৷ বর্তমানে দেশটির পাঁচটি প্রদেশে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রয়েছে৷
বুলগেরিয়া
বুলগেরিয়ার পার্লামেন্ট ২০১৬ সালের অক্টোবরে প্রকাশ্যে মুখ ঢাকার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এই আইন ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে এক হাজার ১১৫ ডলার জরিমানার বিধান রয়েছে।
তাজিকিস্তান
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে এশিয়ার মুসলিমপ্রধান দেশ তাজিকিস্তান বোরকা ও হিজাব নিষিদ্ধ করে৷ ইসলামি মুখঢাকা পোশাক পরার চেয়ে দেশটির ঐতিহ্যগত পোশাক পরায় মনোযোগী হতে নারীদের আহ্বান জানায় দেশটির সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়৷
এই আইন অমান্য করলে কোনো সাজার ব্যবস্থা রাখা হয়নি, তবে শিগগিরই জরিমানা বা কারাদণ্ড চালু করা হতে পারে বলে আলোচনা চলছে দেশটিতে৷
মরক্কো
আফ্রিকার ৯৯ শতাংশ মুসলিম ধর্মাবলম্বীর দেশ মরক্কোতে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে বোরকার উৎপাদন, আমদানি ও বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়৷ তবে এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি দেশটির সরকার৷
বোরকা পরার ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা রয়েছে কিনা, তাও স্পষ্ট করা হয়নি৷ এর ফলে দেশটিতে এখনও এ নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা রয়েছে৷
নাইজার
শতকরা ৯৯ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নাইজার। দেশটির দিফা শহরে নিকাব নিষিদ্ধ রয়েছে। শহরটিতে মুসলিম গেরিলা সংগঠন বোকো হারাম হামলা করলে দেশটি এই সিদ্ধান্ত নেয়। হিজাব ও মাথার স্কার্ফ নিষিদ্ধ করার জন্য দেশটির প্রেসিডেন্টের পরামর্শের পর এই নিয়ম চালু করা হয়।
দেশটির প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, প্রয়োজনে মাথা ঢাকা পোশাক হিজাবও আসতে পারে নিষেধাজ্ঞার আওতায়৷
শ্রীলঙ্কা
২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল খ্রিস্টানদের ইস্টার সানডের প্রার্থনা চলাকালে গির্জায় আত্মঘাতি বোমা হামলায় নিহত হন অন্তত ২৫৩ জন৷ এর এক সপ্তাহ পরেই মুখ ঢাকা পোশাক নিষিদ্ধ করে দেশটির সরকার৷
তিউনিসিয়া
২০১৯ সালের ৫ জুন গণজমায়েতের স্থান, গণপরিবহন ও সরকারি অফিস-আদালতে নিকাব নিষিদ্ধ করে তিউনিসিয়া সরকার৷ জঙ্গি আক্রমণ মোকাবেলাই এর প্রধান কারণ বলে জানায় আফ্রিকার মুসলিমপ্রধান দেশটির সরকার৷
কঙ্গো
কঙ্গোর রাজধানী ব্রাজাভিলে সন্ত্রাসী হামলার ভয়ে ২০১৫ সাল থেকে বোরকা নিষিদ্ধ আছে। কঙ্গো মধ্য আফ্রিকার যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশ। খৃষ্টান অধ্যুষিত কঙ্গোতে শতকরা ১২ ভাগ মুসলিম বাস করে।
ক্যামেরুন
চাদের দেখাদেখি দুই মাস পর প্রতিবেশী দেশ ক্যামেরুনে নিরাপত্তার অযুহাতে বোরকা ও নিকাব নিষিদ্ধ করা হয়। বর্তমানে দেশটির পাঁচটি প্রদেশে এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ আছে।
নরওয়ে
২০১৮ সালের জুনে নরওয়ের পার্লামেন্ট স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বোরকা নিষিদ্ধের পক্ষে ভোট দেয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৫২
আপনার মতামত জানানঃ